• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরীক্ষায় পাস করেছেন নাসির চাকরি পেয়েছেন ডিজির ভাতিজা


সোনালীনিউজ ডেস্ক জুন ২১, ২০১৯, ০৯:৪২ এএম
পরীক্ষায় পাস করেছেন নাসির চাকরি পেয়েছেন ডিজির ভাতিজা

ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে পরীক্ষায় পাস করেও নিয়োগ পাননি রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ছাত্র নাসির উদ্দিন শেখ। ওই পদে নিয়োগ পেয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজালের ভাতিজা রেযোয়ানুল আলম।

পাস করেও চাকরি না পেয়ে দুই বছর ধরে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরছেন নাসির উদ্দিন। ততদিনে চাকরি স্থায়ী হয়ে গেছে ডিজির বড় ভাই শফিকুল আলমের ছেলে রেযোয়ানুলের। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় আবেদন করে নাসির বঞ্চিত হলেও ইফার সাবেক পরিচালক হারুনুর রশিদের ছেলে নাজমুস সাকিব সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগ পেয়েছেন। হারুনুর রশিদের মুক্তিযোদ্ধার সনদ ভুয়া বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০০৯ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পান সাবেক জেলা জজ সামীম আফজাল। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আন্দোলনে নেমেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পরিচালকদের সভায় তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহম্মদ আবদুল্লাহ বলেছেন, নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি অভিযোগ পেয়েছেন। দুদক এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। মহাপরিচালককে জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে এক সপ্তাহ ঘুরেও ডিজির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ইফা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মহাপরিচালকের চার ভাতিজা ও চার ভাগনি-ভাগনেসহ আটজন ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রথম শ্রেণির পদে চাকরি পেয়েছেন। পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে আরও ২৯ জনকে বিভিন্ন পদে চাকরি পেয়েছেন ইফায়। এসব নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মহাপরিচালকের ভাতিজা, ভাগনেদের নিয়োগের কারণে বঞ্চিত হয়েছেন যোগ্য প্রার্থীরা।

নাসির উদ্দিন তাদেরই একজন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ধর্ম, জনপ্রশাসন ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন তিনি। নাসির বলেছেন, যোগ্য হয়েও চাকরি পাননি এর চেয়ে হতাশার আর কী আছে! এখন তাকে প্রতিকার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। তবে হাল ছাড়েননি নাসির উদ্দিন। তথ্য অধিকার আইনে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ার .তথ্য চেয়ে একের পর এক আবেদন করে চলেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন তথ্য না দেওয়ায় তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কার্যবিবরণী পাওয়ার পর বেরিয়ে আসে জাল-জালিয়াতির চিত্র।

নিয়োগ প্রক্রিয়ার নথিতে দেখা যায়, ডিজির ভাতিজা ও পরিচালকের ছেলেকে নিয়োগ দিতে দু'বার নিয়োগ কমিটির কার্যবিবরণী করা হয়েছে। প্রথম কার্যবিবরণী ২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর। দ্বিতীয়টি ওই বছরের ১১ নভেম্বর। দুই কার্যবিবরণীতে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের নম্বরেও গরমিল রয়েছে। প্রথম কার্যবিবরণীতে দেখানো হয়েছে ডিজির ভাতিজা মৌখিক পরীক্ষায় ১২ নম্বর পেয়েছেন। পরের কার্যবিবরণীতে দেখানো হয়েছে ১৬ নম্বর।

পদোন্নতি ও নিয়োগের জন্য বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ড. মো. আফজাল হোসেনের স্বাক্ষর নেই প্রথম কার্যবিরণীতে। সে সময়ে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। পদাধিকারবলে তিনি নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। তার স্বাক্ষর না পেয়ে সদস্য সচিবই বদলে ফেলা হয়। আফজাল হোসেনকে ছুটিতে দেখিয়ে (লিভ সাবস্টিটিউট) সদস্য সচিব করা হয় পরিচালক তাহের হোসেনকে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় আবেদন করলেও নিয়োগ কমিটির কার্যবিবরণীতে নাসির উদ্দিনকে সাধারণ কোটার প্রার্থী হিসেবে দেখানো হয়।

বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত রয়েছেন ড. আফজাল হোসেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনে নিয়োগে শতভাগ দুর্নীতি হয়েছে। ডিজির ভাতিজাকে চাকরি দিতে নম্বর বাড়ানো হয়। একজন প্রার্থীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তাই তিনি স্বাক্ষর করেননি। ফলে তাকে ছুটিতে দেখিয়ে আরেকজনকে সদস্য সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ তিনি ছুটিতে ছিলেন না। আফজাল হোসেন জানান, সামীম আফজালের ইচ্ছাতেই নিয়োগে জাল-জালিয়াতি করা হয়।

১১টি প্রথম শ্রেণির পদসহ ৪৮টি পদে নিয়োগে ২০১৫ সালের ৭ মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয় বিজ্ঞপ্তিতে। ২০১৪ সালের শুরু থেকেই প্রকাশনা বিভাগের গবেষণা কর্মকর্তা পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োজিত ছিলেন নাসির উদ্দিন শেখ। ডিজির ভাতিজা প্রকাশনা বিভাগে কাজ না করলেও প্রেস বিভাগের অস্থায়ী কাজের অভিজ্ঞতায় চাকরি পেয়ে যান। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রকাশনা ও প্রেসের কাজ ভিন্ন।

নিয়োগপত্র দিতেও করা হয় অনিয়ম। ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ দেওয়া হয় রেযোয়ানুল আলমকে। তার নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেন সামীম আফজাল। কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নীতিমালা অনুযায়ী কেবল সচিব নিয়োগসহ যে কোনো চুক্তি ও দলিলে সই করবেন।

পরীক্ষার নম্বর বণ্টনেও ছিল পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগের সুযোগ। শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য ১২ নম্বর, লিখিত পরীক্ষায় ৬০ নম্বর এবং মৌখিক পরীক্ষায় ২৮ নম্বরসহ পূর্ণমান ছিল ১০০। নাসির উদ্দিন ৫২ দশমিক ৫ নম্বর পান। রেযোয়ানুল হক পান ৬২ দশমিক ৫ নম্বর। কিন্তু পরীক্ষায় তার প্রথম হওয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ড. আফজাল হোসেন বলেছেন, এ নিয়ে তার সন্দেহ রয়েছে।

নাসির উদ্দিন বলেছেন, ১১টি পদের বিপরীতে তিনটি পদ মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু একজনকে নিয়োগ দিয়ে বাকি দুটি পদ শূন্য রাখা হয়। অথচ কোটার প্রার্থী হিসেবে তার নিয়োগ পাওয়ার কথা ছিল। তিনি তথ্য অধিকার আইনে নিয়োগের কার্যবিবরণী হাতে পেয়ে জানতে পারেন, তাকে কোটার প্রার্থী হিসেবে দেখানোই হয়নি। তাই চাকরি পেয়ে যান ডিজির ভাতিজা। কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, কোটার যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি। কিন্তু দ্বিতীয় কার্যবিবরণীতে তাকে মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থী হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু সেখানে রেযোয়ানুল আলমের মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে মোট নম্বর করা হয় ৬৬ দশমিক ৫।

তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। চাকরি পাওয়া নাজমুস সাকিবের বাবা হারুনুর রশিদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক ছিলেন। চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ২০১০ সালে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন। অথচ ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন পরিচালক (লাইব্রেরি) হারুনুর রশিদ নিজেই একটি চিঠিতে (সূত্র ; ২০১৯/ ইসঃ ফাউঃ গ্রন্থাঃ/৬/৯১ অংশ-৬)/০৮) জানান, তার বিভাগে কোনো মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবী নেই।

নাজমুস সাকিব চাকরির আবেদনে নিজেকে ঢাকা জেলার বাসিন্দা দাবি করেছেন। কিন্তু তার উপস্থাপন করা বাবার 'মুক্তিযোদ্ধা সনদে' স্থায়ী ঠিকানা নোয়াখালী। সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে নোয়াখালীর প্রার্থীর কোটা ছিল না। নাজমুস সাকিব অনিয়ম ও সনদ বিক্রির অভিযোগে বন্ধ হয়ে যাওয়া দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন।

আর্টিস্ট পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের আত্মীয় ফারজীমা মিজান শরমীনের নিয়োগ নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। প্রথম কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, তিনি মৌখিক পরীক্ষায় ১৫ নম্বর পেয়েছেন। দ্বিতীয় কার্যবিবরণীতে দেখা যায় তিনি ১৭ নম্বর পেয়েছেন। আর্টিস্ট পদে নিয়োগের যোগ্যতা ছিল চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। কিন্তু তিনি কম্পিউটারে গ্রাফিক্সের একটি কোর্সের ডিগ্রিধারী।

হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মেসবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া ডিজির আত্মীয়। তিনি জেলা কোটায় চাকরি পেয়েছেন। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সামীম আফজালের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কার্যবিবরণীতে মেসবাহকে ঢাকা জেলা কোটার প্রার্থী হিসেবে দেখানো হয়েছে।-সমকাল

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!