• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
সিটি নির্বাচন

প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ১৯, ২০২০, ০৩:২৪ পিএম
প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক

ঢাকা : আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক চলছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। মেয়র কিংবা কাউন্সিলর সব প্রার্থী ভাঙছেন আচরণবিধি। অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়লেও নির্বাচন কমিশন যেন নিধিরাম সর্দার। আচরণবিধি লঙ্ঘনে শনিবার (১৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেনি কমিশন।

নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া অভিযোগ ও মাঠ পর্যায়ে ঘুরে তথ্য পাওয়া গেছে, এদিকে প্রার্থীদের কার্যত কোনো মনোযোগই নেই। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী প্রচারের বিধি-বিধান থাকলেও সেসব মানছেন না ঢাকার দুই সিটির ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি নির্বাচনে অংশ নেওয়া মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। প্রার্থীদের পক্ষ থেকেই সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা পড়ছে ডজন ডজন অভিযোগপত্র। দুই সিটিতে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে ইতোমধ্যে অর্ধশতাধিক আবেদন জমা পড়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা।

যে কারণে আলোচনায় উঠে এসেছে এ নির্বাচনে যেন আচরণবিধি ভঙ্গের হিড়িক পড়েছে। নির্বাচনী বিধি ভঙ্গে এগিয়ে রয়েছে সরকার দলীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। এ অভিযোগ খোদ নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের।

এদিকে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ৩০ জানুয়ারি। প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আসন্ন মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা।

গত কয়েকদিন সরেজমিন দুই সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে দেখা গেছে, প্রচারে এক ওয়ার্ডে একাধিক মাইকের ব্যবহার, নির্ধারিত সময়ের পরেও উচ্চ স্বরে মাইকের ব্যবহার, দেয়ালে পোস্টার লাগানো, বিধি ভঙ্গ করে পোস্টার ছাপানো, পোস্টারে নিয়মের অতিরিক্ত ছবি ব্যবহার, প্রতীক ও প্রার্থীর ছবি সম্বলিত টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে প্রচার এবং মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনের শো-ডাউন, মিছিল ও পথসভা করে যানজটের সৃষ্টি করাসহ নানাভাবে আরণবিধি লঙ্ঘন করছেন প্রার্থীরা।

গত কয়েকদিন সরেজমিনে দেখা যায়, প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারে বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে দিনের বেলায় তো মাইকে প্রচারণা চলেই। রাত ৮ টার পরও উচ্চ আওয়াজে সাউন্ড বক্স ও মাইকে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হচ্ছে অনেক এলাকায়। এতে করে পড়াশোনার ব্যঘাত ঘটছে ছাত্র ছাত্রীদের। অথচ আর কিছুদিন পরই পরীক্ষা।

পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অভিযোগ, ফলাফল খারাপ হলে কি বিষয়টা তারা দেখবেন। তারা তো নির্বাচিত হতে পারলেই শেষ।

একাধিক পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেছেন, প্রচারণার নির্ধারিত সময় আছে। রাত ৮টা পর প্রচারণা চালানো নিষেধ। কিন্তু কেউ তা মানছেন না। প্রতিদিন রাত ১০-১১টা পর্যন্ত প্রচারণা চলছে। এতে করে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে পারছে না। এগুলো দেখার কি কেউ নেই।

এছাড়া প্রচারণায় মোটর শোভাযাত্রা ও যানবাহনের ব্যাবহার নিষিদ্ধ থাকলেও প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা তা মানছেন না। ফলে প্রতিদিনই যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

গত কয়েকদিনে রাজধানীর মানিক নগর, খিলগা, কমলাপুর, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকা ও যাত্রাবাড়ি এলাকায় প্রচার চালিয়েছেন দক্ষিণ সিটির আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ফজলে নূর তাপস ও বিএনপির ইশরাক হোসেন।

অপরদিকে উত্তরা, বাড্ডা, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় প্রচার চালিয়েছেন উত্তর সিটির আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ও বিএনপির তাবিথ আওয়াল।

এর মধ্যে একাধিক দিন প্রচারকালে ভ্যানে বড় সাউন্ড বক্স ও রিকশায় মাইক নিয়ে প্রচার চালিয়েছে। এসময় সরকার দলীয় প্রার্থীর গণসংযোগে ‘জিতবে এবার নৌকা, তাপস ভাইয়ের সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন’। এমন থিম সং বাজছিল।

গত ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রচারের নবম দিন ছিল গতকাল শনিবার। এদিন দুপুর পর্যন্ত শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে জমা পড়েছে আচরণ বিধি লঙ্ঘণের ৪২টি অভিযোগ। এর বাইরে কত ঘটনা ঘটছে তা এ সংখ্যা থেকেই অনুমেয়। এছাড়াও উত্তর সিটিতে গত শুক্রবার পর্যন্ত জমা পড়েছিল ১০ টি অভিযোগ।

এদিকে সরকারি দলের প্রার্থী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘণের অভিযোগ তুলে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও বলেছেন, আচরণবিধি যারা প্রণয়ন করার দায়িত্বে, তাদের মধ্য থেকেই বিধি ভঙ্ঘ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশের খবরকে বলেছেন, নির্বাচনী আচরণবিধি সবার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা তা ভঙ্গ করার অভিযোগ রয়েছে। সরকারদলীয় প্রার্থীরাই বিধি ভঙ্গে এগিয়ে রয়েছেন।

নাগরিকদের প্রতিনিধি নির্বাচনের এ প্রতিযোগিতায় বিধি মেনেই প্রচার চালানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।

ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের শাস্তির বিষয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর হওয়া উচিত। সরকারি বা বিরোধী দল বিবেচনায় কোনো ভূমিকা রাখা কাম্য নয়। সামনে পরীক্ষা। এটাও প্রার্থীদের মাথায় রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দক্ষিণের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, প্রার্থীরা নানা অভিযোগ দিচ্ছেন। আমরা তা খতিয়ে দেখছি, আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট ও কর্মকর্তারা নিয়মতি মনিটরিং করছেন।

তিনি জানান, নির্বাচনী প্রচারণা চলবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত আমরা ৪২টি আচরণবিধি লঙ্ঘনর অভিযোগ পেয়েছি। ব্যবস্থাও নিচ্ছি। বাকি দিনগুলোতে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আমাদের কর্মকর্তারা।

বিধিতে সিটি নির্বাচনে আচরণবিধি অমান্য করলে প্রার্থী বা তার সমর্থকের সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রার্থিতা বাতিলসহ নিবন্ধিত দলকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করারও বিধান করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জেল-জরিমানা করার ক্ষমতা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।

নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী, মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রতি থানায় একটির বেশি নির্বাচনী ক্যাম্প বা অফিস স্থাপন করতে পারবেন না। আর কাউন্সিলর প্রার্থী ৩০ হাজার ভোটারের জন্য একটি ক্যাম্প এবং সর্বোচ্চ তিনটি ক্যাম্প বা অফিস ব্যবহার করতে পারবেন।

প্রার্থী বা তার দল বা অন্য কোন ব্যক্তি ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেল বা অন্য কোনো যান্ত্রিক যানবাহনে করে মিছিল, মশাল মিছিল বা শোডাউন করতে পারবেন না। প্রচারণায় হেলিকপ্টার বা অন্য কোন আকাশযান ব্যবহার করা যাবে না।

প্রার্থীর ছবি বা প্রতীক চিহ্ন সম্বলিত শার্ট, জ্যাকেট বা ফতোয়া ব্যবহার করা যাবে না। মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো যাবে না। একটি ওয়ার্ডে পথসভা বা নির্বাচনী প্রচারণার কাজে একের অধিক মাইক্রোফোন বা বেশি মাত্রার শব্দের যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। নির্বাচনী এলাকায় দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে মাইক ব্যবহার করা যাবে। তবে প্রার্থীদের দাবি, তারা আচরণবিধি মেনেই প্রচারণা চালাচ্ছেন।

ইশরাকের গণসংযোগ : শনিবার (১৮ জানুয়ারি) কোতোয়ালি থানাধীন বাংলাবাজার চৌরাস্তা মোড় থেকে শুরু করে আহসান উল্লাহ মঞ্জিল, ইসলামপুর, আহসান উল্লাহ রোড, নবাববাড়ি গেট, জিন্দাবাহার, বাওয়ানী স্কুলের গলি, আরমানিটোলা, নয়াবাজারের বাগডাসা লেন, সাত রওজা, আগামাসিহ লেন, সিদ্দিক বাজার, কাপ্তান বাজার হয়ে জয়কালি মন্দিরের সামনে গিয়ে দিনের কর্মসূচি শেষ করেন ধানের শীষের প্রার্থী প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন।

গণসংযোগ শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত পথসভায় তিনি বলেন, আমি আপনাদের ভোটে নির্বাচিত হলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াসহ ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেব। ক্লিন ঢাকা গড়ে তুলতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তাপসের গণসংযোগ : শনিবার (১৮ জানুয়ারি) যাত্রাবাড়ীর টনি টাওয়ার থেকে শুরু করে নির্বাচনী এলাকার ৬০, ৬১, ৬২ হয়ে ৪৮ ও ৪৯ নং ওয়ার্ড ঘুরে দিনব্যাপী নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

এসময় তিনি বলেছেন, আমরা যেখানেই যাচ্ছি অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। আমাদের উন্নয়নের যে রূপরেখা দিয়েছি ঢাকাবাসী সেটা সাদরে গ্রহণ করেছে।

তাবিথের গণসংযোগ : শনিবার (১৮ জানুয়ারি) উত্তরের ২২, ২৩, ৩৫ ও ৩৬ নং ওয়ার্ডের খিলগাঁও, মালিবাগ, শান্তিনগর, মধুবাগ, বনশ্রী, মগবাজার, হাজীপাড়া, রামপুরাসহ আশপাশের এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালান। এলাকায় গণসংযোগ করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল।

এসময় তিনি নির্বাচন কমিশনারের ওপর আস্থা নেই অভিযোগ করে বলেন, গণতন্ত্র হরণ করা হয়েছে। এখন জনগণ ভোট দিতে পারে না। এবার বিএনপির নেতাকর্মীরা ভোটারদের সাহস দেবে ভোট কেন্দ্রে যেতে। ভোটাররা যাতে সুশৃঙ্খলভাবে ভোট দিতে পারে সে সহযোগিতা করবে।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারপরেও আমরা দেখতে চাই নির্বাচন কমিশন কি করে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত।

আতিকুলের গণসংযোগ : শনিবার (১৮ জানুয়ারি) উত্তরে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম মিরপুর কচুক্ষেত বাজারের সামনে থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত পথ সভায় বলেন, নির্বাচিত হলে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের স্বপ্নের ইউলুপগুলো সচল করে এবং বাসরুট রেশনালাইজ করে একটি যানজটমুক্ত স্মার্ট ঢাকা উপহার দেব।

তিন মাসের মধ্যে ‘আমার ঢাকা অ্যাপস’ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আতিকুল বলেন, আমি আগেও বলেছি স্মার্ট ঢাকা গড়ব। এরই মধ্যে আমার ঢাকা অ্যাপস’র সকল কার্যক্রম করে ফেলেছি। নগরবাসী যেখানে যে সমস্যা দেখবে অ্যাপসের মাধ্যমে জানালে আমরা সমাধান করব।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!