• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম কিবলা আল আকসার রক্তক্ষয়ী ইতিহাস


ধর্মচিন্তা ডেস্ক জুলাই ৩১, ২০১৭, ০২:৩৩ পিএম
প্রথম কিবলা আল আকসার রক্তক্ষয়ী ইতিহাস

ঢাকা: মুসলিমদের প্রথম কিবলা বায়তুল আকসা বছরের বেশিরভাগ সময়ই আলোচনায় থাকে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী ইসরাইলদের বসতি স্থাপনের প্রস্তাব করার পর থেকেই এই আলোচনার জন্ম। 

পরে ১৯৬৭ সালে ইসরাইলি বায়তুল আকসা এলাকা দখল করার পর থেকেই হাজার হজার ফিলিস্তিনিকে এই দখলদারদের হাতে জীবন দিতে হয়েছে। যার সর্বশেষ ঘটনাহলো- ১৪ জুলাই দুই ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীকে হত্যার অজুহাতে সৃষ্ট সংকট। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫ ফিলিস্তিনকে জীবন দিতে হয়েছে, আহত হতে হয়েছে শত শত ফিলিস্তিন নারী, পুরুষ ও শিশুকে। 

ঘটনার শুরু গত ১৪ জুলাই সকালে, যখন তিনজন ইসরায়েলি আরব মুসলমান, জেরুজালেমের আল-আক্বসা মসজিদ প্রাঙ্গনে দুই ইসরায়েলি পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাদের হত্যা করে। আক্রমণকারীরা তিনজনই ছিল ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর উম্ম-আল-ফাহ্‌মের অধিবাসী। 

তারা মসজিদ প্রাঙ্গণের উত্তরে অবস্থিত লায়ন গেট দিয়ে মসজিদ এলাকায় প্রবেশ করে এবং দুই পুলিশকে পেছন থেকে গুলি করে। তাদের কাছে ছিল ঘরে তৈরি মেশিনগান, যেগুলো তারা জামার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। ইসরায়েলি পুলিশ তাদের পেছনে ধাওয়া করলে তারা মসজিদ কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে এবং সেখানেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।

হত্যাকান্ডের পরপরই ইসরায়েলি পুলিশ মসজিদ সংলগ্ন পুরো এলাকা বন্ধ করে দেয় এবং ১৯৬৯ সালের পর প্রথবারের মতো মসজিদে নামাজ বাতিল করে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পুলিশের পরামর্শে মসজিদ প্রাঙ্গণে মেটাল ডিটেক্টর সম্বলিত ইলেক্ট্রনিক গেট স্থাপন করার নির্দেশ দেন, যেন আর কেউ অস্ত্র নিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে না পারে। 

মূলত মেটাল ডিটেক্টর সম্বলিত ইলেক্ট্রনিক গেট স্থাপন করার পরপরই মুসল্লীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তারা ইসরায়েলি পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত ইলেক্ট্রনিক গেটের মধ্য দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং মসজিদের বাইরে অবস্থান নেয়।

পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে মেটাল ডিরেক্টর সরিয়ে নেয় ইসরাইল। এ ঘটনায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, ইসরাইল বায়তুল আকসা দখলের ষড়যন্ত্র করেছিল। সেই সাথে বিশ্বের সমর্থবান মুসলিমদের জেরুজালেমে অবস্থিত তাদের প্রথম কিবলা পরিদর্শনে যাওয়ার আহবান জানান। 

কিন্তু, কেন এই মেটাল ডিরেক্টর স্থাপনের বিরোধীতা?
বর্তমান বিশ্বে মেটাল ডিটেকটর নতুন কিছু নয়। ইসরাইলে তো বটেই, বিশ্বের প্রায় সবদেশেই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর প্রবেশপথে, এমনকি কিছু মুসলিম দেশের গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের প্রবেশপথেও মেটাল ডিটেক্টর আছে। 

ইসরায়েল দাবি করছে, এই মেটাল ডিটেক্টর বসানোর উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন কেউ অস্ত্রসহ মসজিদ এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন যে, নামাজ পড়তে আসা মুসলমানদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা এই ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে মুসলমানরা কেন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে?

ব্যাপারটা হচ্ছে, আল-আকসা কম্পাউন্ড বিশ্বের অন্য যে কোনো স্থানের মতো না। ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান হওয়ায় এর উপর ইসরাইলের একক কোনো কর্তৃত্ব নেই। চুক্তি অনুযায়ী একটা বিশেষ ‘স্ট্যাটাস ক্যু’ অনুযায়ী এটি নিয়ন্ত্রিত হয়। আকসা কম্পাউন্ডে আগে থেকেই মসজিদের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ওয়াক্বফের সিকিউরিটি চেক পয়েন্ট আছে। 

ইসরায়েল চাইলে তাদের সাথে আলোচনা করে তাদের দ্বারাই মেটাল ডিটেকটর বসানোর প্রস্তাব করতে পারতো। সেটা না করে, ফিলিস্তিনী নেতাদের সাথে বা ওয়াক্বফের সাথে আলোচনা না করে, নিজেদের সৈন্যদের দ্বারা পরিচালিত ইলেক্ট্রনিক গেট স্থাপন করাকে তাই ইসরায়েলের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুরভিসন্ধিমূলক আচরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তাছাড়া ইসরায়েলের উগ্রপন্থী একটা অংশ বরাবরই বিভিন্ন অযুহাতে আল-আকসা মসজিদ ভেঙ্গে সেখানে ইহুদীদের ধর্মীয় উপাসনালয় তৈরির দাবি করে আসছে। ইসরায়েলের সরকার এবং পুলিশও বিভিন্ন সময় তাদের পক্ষে ভূমিকা নিয়েছে। 

কাজেই ইসরায়েলের মেটাল ডিটেক্টর বসানোটাকে আল-আক্বসার উপর জায়নবাদীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটা অপচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফিলিস্তিনী মুসলমানদের প্রতিবাদটা তাই শুধু মেটাল ডিটেক্টরের বিপক্ষে না, বরং সেটা ইসরায়েলি পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত নিরাপত্তা ব্যবস্থারও বিরুদ্ধে।

আল-আকসা মসজিদের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ, ওয়াক্বফের ডেপুটি মিনিস্টার ইবরাহিম আওয়াদাল্লাহ বলেন, ইসরায়েল এই ব্যবস্থা নিয়েছে মুসলমানদেরকে নামাজ পড়তে বাধা দেয়ার জন্য। তার মতে, এটা কোনো সুপার মার্কেট বা নাইট ক্লাব না। বিশাল সংখ্যক মানুষ এখানে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়তে আসে। মেটাল ডিটেক্টরের মধ্য দিয়ে তাদেরকে যেতে বাধ্য করার অর্থ হচ্ছে তাদেরকে দেরি করিয়ে দেয়া এবং তাদেরকে হেনস্থা করা।

বায়তুল আকসার ইতিহাস:
ইতিহাস থেকে জানা যায়, তিন ধর্মের কাছে এই পবিত্র মসজিদটি হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব (আ.) জেরুজালেমে নির্মাণ করেন। তারপর হযরত সুলাইমান (আ.) এই পবিত্র মসজিদের পুনঃনির্মান করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে ইসলামের প্রথম কিবলা। 

পবিত্রতার দিক থেকে মক্কা-মদিনা মুনাওয়ারার পরের তৃতীয় পবিত্র স্থান। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববী এবং মসজিদে আকসা-এর উদ্দেশ্যে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা অন্য কোন মসজিদ সম্পর্কে করেননি। 

৬৩৮ ঈসায়ীতে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে পুরো বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের আয়াত্বে চলে আসে। ১০৯৬ সনে খৃষ্টান ত্রুসেডারগণ পুরো সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করার পর মসজিদে আকসা-এর ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গীর্জায় পরিণত করে ফেলে। তারপর ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর গাজী সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবি জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। 

সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবির হাতে পরাজিত হওয়ার পর খৃস্ট শক্তি কিছুটা পিছু হটলেও ইয়াহুদী চক্র বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি রাখে। এবং তারা ফিলিস্তিন থেকে নিয়ে সুদূর মদিনা পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম এলাকা নিয়ে বৃহত্তর ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করে বসে। 

এরই প্রেক্ষিতে তারা তুরস্কের তৎকালীন শাসক সুলতান আবদুল হামিদ-এর নিকট ফিলিস্তিনে জমি কেনার অনুমতি চায় এবং এর বিনিময়ে তারা তুরস্কের সকল বিদেশী ঋণ পরিশোধ করে দেবে বলে অঙ্গীকার করে। কিন্তু সুলতান তাদের ষড়যন্ত্রমূলক এ প্রস্তাবে রাজি হননি। 

তা সত্ত্বেও ইয়াহুদীরা গোপনে জমি কিনতে থাকে। ১৯১৭ সনে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে ও ১৯২০ সনে সেখান পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং ‘স্যার হার্বাট স্যামুয়েল’ নামক একজন ইয়াহুদীকে সেখানে বৃটিশ কমিশনার নিযুক্ত করে। এই জমি কেনার ফলে বহিরাগত ইয়াহুদীদের জন্য ফিলিস্তিনের দরজা খুলে যায়। 

আমেরিকা ইয়াহুদিবাদী উগ্র সংস্থাগুলোকে ফিলিস্তিনে বসবাস ও জমি কেনার জন্য কোটি কোটি ডলার প্রদান করে। ফলে অতি অল্প দিনের মধ্যে বহু সংখ্যক ইয়াহুদি ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। 

১৯৪৮ সনের ১৫ ই মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে যায়নবাদী অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইয়াহুদিরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের কচুকাটা করতে থাকে। তাদের অত্যাচারে জর্জরিত আরবরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সত্ত্বেও তখনও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের দখলে ছিল। 

কিন্তু আরবদের দুর্বলতার মুখে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের মাধ্যমেও তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, সেই থেকেই বায়তুল আকসা মসজিদ চত্ত্বর জর্ডান ও ফিলিস্তিনের ওয়ক্ফ প্রতিষ্ঠান এবং এর বাইরের অংশ অর্থাৎ পুরাতন জেরুসালেম ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সূত্র: আলজাজিরা ও উইকিপিডিয়া। 

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!