• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রাণের উৎসবে রঙিন পাহাড়


খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০২:৩৯ পিএম
প্রাণের উৎসবে রঙিন পাহাড়

ঢাকা : পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। এই তিনটি সম্প্রদায়ই তিন নামে জাঁকজমকভাবে বর্ষবরণ উৎস পালন করে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ‘বৈসু’, বড়ুয়া সম্প্রদায়ের মারমারা ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমারা ‘বিজু’ নামে এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করে। এই তিন সম্প্রদায়ের উৎসবের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে বৈসাবি নামকরণ করা হয়েছে। ধর্মের দিক থেকে মিল থাকলেও এদের বর্ষবরণে ধরন কিছুটা ভিন্ন। প্রত্যেকেই নিজস্ব রীতি অনুযায়ী উৎসবটি পালন করে। বৈসাবি উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে শুরু হয় নতুন বর্ষবরণ।

বাংলা নতুন বছরকে কেন্দ্র করে বৈসাবির আনন্দে ভাসছে পার্বত্য অঞ্চল। চাকমা, ত্রিপুরা, মারমাসহ ১৩টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে চলছে নানা প্রস্তুতি।  নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে গতকাল শুক্রবার শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব। প্রাণের এই উৎসব ঘিরে পাহাড় এখন রঙে রঙিন। বৈসাবির প্রথম দিন গতকাল শুক্রবার সকালে চেঙ্গী নদীতে ফুল ভাসিয়ে শুরু করা হয় বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা।

চাকমা ও ত্রিপুরারা উৎসবের প্রথম দিনে পাহাড় থেকে সংগৃহীত ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। সবার মঙ্গল কামনায় কলাপাতায় করে শ্রদ্ধাভরে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে ফুল ভাসিয়ে পুরাতন বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরের শুভকামনা করে। প্রত্যাশা করা হয়, পাহাড়ে হানাহানি ভুলে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে আসবে শান্তি ও সম্প্রীতি। ত্রিপুরারা বৈসু উৎসব করে তিন দিন। ২৯ চৈত্র পালন করে হারি বৈসু। ৩০ চৈত্র বিসুমা এবং পহেলা বৈশাখে বিসিকাতাল উৎসব। হারি বৈসুতে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুল সংগ্রহ করে, গৃহপালিত পশুদের স্নান করায়। ঘরে রক্ষিত দেবতাসন ফুল দিয়ে সাজানো হয়। বিসুমার দিনে নানা রকমের সবজি দিয়ে পাঁচন রান্না করে। তাছাড়া পিঠা, মুড়ি, মোয়া তৈরি করা হয়। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গীতা পাঠ করা হয়। বিসিকাতালের দিনে মেহমানদের আপ্যায়ন করা হয়। এ দিনের উৎসবে প্রাধান্য পায় গড়াইয়া নৃত্য। পাশাপাশি চলে দেবদবীর নামে পূজা অর্চনা ও বলিদান।

মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাগ্রাই’ উৎসব চারভাগে বিভক্ত। আকিয়ানিহ (কোলা সাংগ্রাহ), আক্রাইনিহ (পূর্ণ সাংগ্রাই), আতানিহা আক্যা ও বৈশাখের দ্বিতীয় দিনে আতাদা নিহ বা লাছাইংতারা। আকিয়ানিহের দিনে তারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন রকম ফুল সংগ্রহ করে বাড়িঘর ও বুদ্ধদের আসন সাজায়। কেয়াং (ধর্মীয় ঘর) পরিষ্কার করে। বিকালে ক্যায়াংয়ে দিয়ে শীল পালন করে। আক্রাইনিহ্বা পূর্ণ সাংগ্রাইয়ের দিন খুব ভোরে ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে গৃহপালিত পশুপাখিদের ধান ও চাল খাওয়ায়। একে অন্যের বাড়ির পশুপাখিদের খাদ্য আদান-প্রদান করে।

তারপর ছেলেমেয়েরা নদী, ঝরনা ও কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে। ওই পানি দিয়ে মুরুব্বিদের স্নান করিয়ে পুণ্য লাভে আশীর্বাদ কামনা করে। পানি দিয়ে একে অন্যকে গোসল করিয়ে বা পানি খেলায় মেতে ওঠে। সকাল ১০টায় ফুল ও প্রসাদ নিয়ে ক্যায়াংয়ে গিয়ে পূজা করে। দুপুরে পিণ্ড দান ও ধর্মীয় সভায় যোগ দেয়। সকাল বুদ্ধমূর্তিকে স্নান করিয়ে সাজায়। এদিন মারমারা কোনো ধরনের পানীয় নেশা গ্রহণ করে না। সন্ধ্যায় দেবতার পূজা করে। আতানিহনের দিনে তাদের তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। এদিন পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন খেলায় মেতে থাকে। আতাদানিহ বা লাছাইংতারা দিনে সবাই ভালো খাবার তৈরি করে। একে অন্যের বাড়িতে খেয়ে আনন্দ করে। জলকেলি বা পানি খেলা হলো মারমাদের সাংগ্রাইয়ের প্রধান আকর্ষণ।

বিজু চাকমাদের উৎসবের নাম। চাকমা সম্প্রদায় পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের বিজু উৎসব চলে তিন দিনব্যাপী। ২৯ চৈত্র ফুল বিজু, ৩০ চৈত্র মূল বিজু এবং পহেলা বৈশাখের দিন ‘গইজ্যা পইয্যা দিন’ অর্থাৎ বছরের প্রথম দিন। ২৯ চৈত্র ফলু বিজুর দিনে ছেলে মেয়েরা সকালে ঘুম থেকে উঠে বিভিন্ন রকমের ফুল সংগ্রহ করে। ওই ফুল দিয়ে বুদ্ধের মূর্তিসহ পুরো ঘর ফুল দিয়ে সাজায়। ফুল দিয়ে বুদ্ধের পূজা করে। খাল ও নদীতে ফুল ভাসানো হয়। পরে বাড়িতে সবাই মিলে পূজা-অর্চনা করে কাটায়। ৩০ চৈত্র মূল বিজুর দিনে ছেলেমেয়েরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে। গৃহপালিত পশুপাখিকে ভালো খাবার দেয়।

পাড়া-প্রতিবেশীদের পশুপাখিকেও খাবার দিয়ে থাকে। এদিন কোনো মাছ-মাংস রান্না করা হয় না। ঘরে বুদ্ধের আসনে সবজির তৈরি পাঁচন দিয়ে পূজা করে। একে অন্যের বাড়িতে পাঁচন খায় ও আনন্দ উৎসব করে। গইজ্যা পইজ্যা (পহেলা বৈশাখ) দিনে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো খাবার তৈরি করে। ভালো খাবারের পাশাপাশি বিন্নি চালের পানীয় তৈরি করে মেহমানদের আপ্যায়ন করা হয়। বৈসাবি উৎসব পার্বত্যাঞ্চলে সাম্যের প্রতীক। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি জনপদে কয়েকটি র‍্যালি বের করা হয়। র‍্যালিতে পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়িদের নিজস্ব পোশাক পরা হয়। বৈসাবিতে সমতল থেকে দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। পার্বত্যাঞ্চল হয়ে ওঠে উৎসবমুখর।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!