• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিকের একজন সহকারী শিক্ষিকার বড় ভাইয়ের গল্প


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০, ১১:০০ এএম
প্রাথমিকের একজন সহকারী শিক্ষিকার বড় ভাইয়ের গল্প

ফাইল ছবি

ঢাকা : প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা উত্তীর্ণ একজন বোনকে নিয়ে তার ভাইয়ে লেখা আবেগঘন ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। প্রাইমারি টিচার্স গ্রুপের কল্যাণে সেই পোস্টটি সোনালীনিউজের হাতে এসে পৌঁছেছে। যা পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো - ২০০০ সালের আগস্ট মাসে জন্ম নেয় আমাদের পরিবারে ছোট্ট একটা পরি, তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, নিন্মবিত্তের সংসার আমাদের, আমি বড় ভাই, আমার ছোট ভাই টাকে সে বছরই হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করি, বাবা মায়ের অভাব অনটনের সংসার, টেনেটুনে চলছে জীবন, এভাবেই কেটে যায় বছরগুলো। আমি সবে এসএসসি দিলাম ২০০২ সালে সংসারে অভাব দিনদিন বেড়েই চলেছে, তার মাঝে ভর্তি হলাম কলেজে, ছাত্র তেমন ভালো না হওয়ায় পড়াশোনা ও ভালো ছিলাম না এভাবেই কেটে গেলো আরো ২ টি বছর। 

২০০৪ সালে এইচএসসি দিয়ে করলাম ফেল, ভাবলাম আবার পরীক্ষা দিবো কিন্তু পরিবারের সবার অবস্থা চিন্তা করে একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম নাহ আমি আর পড়াশোনা করবো না, বাকী ২ ভাই বোনকে পড়াশোনা করাবো, ২০০৫ সালে বোনকে দিলাম বাড়ীর সামনের প্রাইমারিতে ভর্তি করে, সেই যেদিন প্রথম তাকে কোলে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসলাম সেদিন বলেছিলেন তুই একদিন বড় স্যার হবি, বাবার পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম কর্মজীবী হয়ে, শুরু হয়ে গেলো জীবন যুদ্ধ। 

আমার পরিটা ক্লাস ২ থেকে প্রতি বছর রোল নাম্বার ১ নিয়ে এগিয়ে চললো, হতে থাকলো আমার স্বপ্ন পুরণ, ক্লাস ফাইভে বৃত্তি দেওয়ার জন্য স্যারেরা চাপাচাপি শুরু করলো, খরচের কথা চিন্তা করে বাবা-মার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিলো কম, বাবা-মা আমার ভয়ে বললো আচ্ছা দিক ও পরীক্ষা, অবশেষে পরী আমার ঘড়িহানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে টেলেন্ডপুল বৃত্তি পায়, তারপর নতুন যুদ্ধ শুরু, আমার বাড়ী থেকে বালিথুবা স্কুলের দুরত্ব দেড় মাইল, পায়ে হেঁটে এসে যেয়ে পরী আমার শুরু করলো পড়াশোনা, জেএসসি পরীক্ষায় সে গোল্ডেন পেয়ে উত্তীর্ণ হলো সাথে বৃত্তি,আমাদের সংসারে ততদিনে অভাব নামের শব্দটা আস্তে আস্তে মুচে যেতে লাগলো, আমার পরীটা স্কুলে কোনদিন রোল নং ৩ হয়নি, হয়তো ১ নয়তো ২, এভাবেই চলতে লাগলো সময় গুলো ২০১৫ তে এসএসসি পরীক্ষা পরীর,সাইন্সের ছাত্রী সে, পরীক্ষা ভালো ই দিলো অবশেষে রেজাল্টের দিন, সে জিপিএ ফাইভ পায়নি।  এনিয়ে স্কুলের হেড স্যার বললো আমার সাথে চলেন আমি বোর্ডে যাবো, যে ছাত্রীর টেস্টে আমি ১০০ মার্কস থেকে গণিতে ১ কাটতে পারলাম না সে কিভাবে অংকে ‘A-’ পায়, তার হায়ার মেথ ও ‘A’ ছিলো, তারপর ভাগ্য মেনে নিলাম, শুরু হলো পরীর কলেজ জীবন, নতুন কলেজ হলো শোল্লা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, স্যাররা বাড়ী আসলো ওকে যেন সে কলেজে ভর্তি করি, বাড়ির আশপাশে হওয়ায় দিলাম ভর্তি করে শোল্লা কলেজে। স্যাররা ঘোষণা দিলো মেধা তালিকা যাচাইয়ের মাধ্যমে উপবৃত্তি এবং বেতন ফ্রি করে দিবে। পরী আমার সেখানে ও ফাস্ট। 

এইচএসসি পরীক্ষার পরপর নিয়ে আসলাম ঢাকায় স্বপ্ন তার ডাক্তার হবে, শুরু করে দিলাম শান্তিনগর মেডিকোতে কোচিং। চললো কঠিন যুদ্ধ, পুরো পরিবার শিফট করলাম ঢাকায়, পরীর কোচিংয়ের জন্য, এর মাঝে যখন রেজাল্ট আসলো পরী ‘A+’ পায়নি, সাইন্স থেকে ৪.৮৭ নিয়ে ২০১৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি শেষ করলো, তার কান্নাকে দেখে, পুরো বাসায় যেন মরাবাড়ী, আবদার করলো আমি আবার পরীক্ষা দিবো HSC, রাজী হয়ে গেলাম, আবার দিস, এর মধ্যে মেডিকেলে এবং ঢাবিতে দিলো ভর্তি পরীক্ষা কিন্তু বিধিবাম কোনটাতেই উত্তীর্ণ হলো না। 

এর মাঝেই চাঁদপুর সরকারি কলেজে এপ্লাই করে ফেললাম, পরীর শর্ত একটাই ক্যামেস্টি পেলে পড়বো নচেৎ না, বললাম আচ্ছা দেখা যাক কি হয়। অবশেষে তার পছন্দের সাবজেক্ট ই পেলো। চাঁদপুর সরকারি কলেজে, মজার বিষয় হলো প্রথম বছর পরী শুধু এইচএসসি নিয়েই পড়াশোনা করেছে এবং আবারও পরীক্ষা দিয়েছে এবং রেজাল্ট পেল সেই সেইম পুরনোটাই। 

চলছে পরীর পড়াশোনা, তারমধ্যে তার বিয়ের জন্য সেই ক্লাস এইট থেকেই আসছে প্রপোজাল। আমি পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে একবাক্যে না, এখনি নয়, ও আরো পড়ুক, এত সকালে বিয়ে নয়, এই না না করতে করতে বাবা-মা পুরো পরিবারের বিপক্ষে চলে গেলাম। পরী শুধু আমার বোন না পিচ্চি বন্ধু ও বটে তাকে কেউ প্রপোজ করলে সবার আগে আমিই জানি। 

এবিষয়টা, আমি বলি দেখ, বোন আমি তোকে যার হাতে তুলে দিবো তাকে এতটুকু বলতে পারবো, ভাই নিজ হাতে গড়ে তোলা বোন আমার, আমার পরী আজকের এই দিনে আজও ফোন ব্যবহার করে না। ভাইয়ার ফোনই তার ভরশা বাবার বাটন ওয়ালা ফোনই তার ক্লাসের বান্ধবীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম।  এরই মাঝে খবর পেলাম প্রাইমারিতে শিক্ষক নিয়োগ।

জিজ্ঞেস করলাম দিবি পরীক্ষা? বললো দেখী ট্রাই করে। দিলো পরীক্ষা, আমি আশা করিনি কারণ ও তীরে গিয়ে তরী ডোবা কপাল, কিন্তু না পরীক্ষার রেজাল্ট আসলো সে উত্তীর্ণ। দিলো ভাইবা সেখানে ও উত্তীর্ণ, সংসারে এলো খুশির বন্যা। এক সাথে ২০ কেজি মিষ্টি হাতে বাড়ি গেলাম তাকে সারপ্রাইজ দিতে, আমি সরকারি চাকরিজীবির বড় ভাই।

হয়তো এ চাকরিটা না হলে পরীর বা আমাদের কিছু হবে না, কিন্তু এক হতভাগ্য ভাইয়ের কলিজায় যে কি পরিমাণ আগাত লেগেছে একমাত্র ভাই বা গার্ডিয়ান ছাড়া এ ব্যাথা কেউ বুঝবে না। দুয়া রইলো সকল নতুন শিক্ষক দের জন্য, উজ্জ্বল হোক তোমাদের আগামীর প্রতিটি মুহূর্ত পরী=(নাছরিন সুলতানা প্রীতি) রোল ৫২১৮৩৮৮ ফরিদগঞ্জ চাঁদপুর।

সোনালীনিউজ/এএস

Wordbridge School
Link copied!