• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রাথমিকের শিক্ষক ৭ বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক, পাঁচতলা দুটি বাড়ি


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৮, ২০২০, ১২:১৩ পিএম
প্রাথমিকের শিক্ষক ৭ বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক, পাঁচতলা দুটি বাড়ি

ঝালকাঠি: ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার সরই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহতাব হোসেন টিটু মাত্র সাত বছরে দুর্নীতির করে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অবৈধপথে আয় করা টাকায় বরিশালের রূপাতলী এবং নলছিটি শহরে একাধিক বাড়ি বানিয়েছেন তিনি।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে শিক্ষক টিটুর দুর্নীতি অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বরিশাল অফিসেও তার বিরুদ্ধে জমা পড়েছে একাধিক অভিযোগ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নলছিটি উপজেলার দেলদুয়ার গ্রামের ফজলুর রহমানের ছেলে মাহতাব হোসেন টিটু ২০১২ সালের আগস্ট মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। নলছিটি বন্দরের চাল ব্যবসায়ী জালাল মিয়ার দোকানের কর্মচারী ছিলেন টিটুর বাবা। 

সহকারী শিক্ষকের চাকরিতে যোগ দিয়েই নলছিটি উপজেলায় একটি শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন টিটু। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেন নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। টিটুর মাধ্যম ছাড়া শিক্ষকদের বদলি, ছুটি ও ইনক্রিমেন্ট হয় না।

শিক্ষা অফিস থেকে যেকোনো ধরনের বরাদ্দের অর্থ ছাড়াতে টিটুকে টাকা দিতে হয়। এসব টাকার একটি অংশ নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাও পান। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পছন্দের ব্যক্তি হওয়ায় বছরের বেশির ভাগ সময় বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিসের কাজ তদারকি করেন টিটু। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে বিনা ছুটিতে ২০১৬ সালে ভারত এবং ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেন তিনি।

২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে কাগজে-কলমে পিটিআই প্রশিক্ষণে থাকলেও টিটুকে ঝালকাঠি টিইও অথবা ডিপিইও অফিসে দেখা যায়। আবার কোনো দিন নলছিটি টিইও অফিসে আড্ডা দিতে দেখা যায়। টিটুর নানা অনিয়ম, দালালি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদক এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে জমা পড়েছে একাধিক অভিযোগ।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে টিটুর দুর্নীতি তদন্তের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম গত ১১ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠি আসেন। নলছিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসে টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ করেন তিনি। সরেজমিনে তদন্তের চার মাস অতিবাহিত হলেও টিটুর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবেদন জমা দেননি সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম।

এ বিষয়ে সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন শেষ পর্যায়ে। টিটুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। এসবের কিছু ভিডিও আছে। ভিডিও এখনও আমার হাতে আসেনি। সব প্রমাণ হাতে পেলেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেব।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সহকারী শিক্ষক মাহতাব হোসেন টিটু আরও চারজন শিক্ষককে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়েছেন। সিন্ডিকেট দিয়ে নলছিটি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের বদলি, ছুটি, টেন্ডার প্রক্রিয়া ও কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণ করেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিশুদের খেলার সামগ্রী কেনার বরাদ্দ থেকে প্রতি বিদ্যালয় থেকে ৫০০ টাকা হারে মোট ৯০ হাজার টাকা নেন টিটু।

২০১৭ সালে ৬২ জন শিক্ষকের কাছ থেকে ৬-১০ হাজার টাকা করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে চাহিদা মতো বিদ্যালয়ে পদায়ন দেন। এতে টিটুকে সহায়তা করেন ওই সময়ের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) ছাইয়াদুজ্জামান। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নলছিটি উপজেলার ২৬টি পুরোনো বিদ্যালয়ের ভবন নিলামে বিক্রির আয়োজন করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। তিন লাখ টাকায় ২৬টি পুরোনো ভবন কিনে ৫২ লাখ টাকা বিক্রি করেন টিটু।

নতুন শিক্ষক যোগদানের সময় জনপ্রতি টিটুকে এক হাজার টাকা দিতে হয়। উপজেলার ১৬৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট জনপ্রতি পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা, রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন শিক্ষকপ্রতি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা নেন টিটু। যেকোনো ধরনের বদলি পাঁচ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা নেন। মৌখিক ডেপুটেশন জনপ্রতি ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা নেন। বিভিন্ন বরাদ্দে বিদ্যালয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে বিদ্যালয়প্রতি ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, স্লিপ রুটিন মেইনটেনেন্স থেকে বিদ্যালয়প্রতি দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার, ওয়াস ব্লক এক হাজার টাকা নেন।

এছাড়া কোনো শিক্ষক পেনশনে গেলে টিটুকে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। গত বছরের জুন মাসে নলছিটি উপজেলা শিক্ষা অফিসের ফ্লোরে ৯৫ হাজার টাকার টাইলস লাগিয়ে তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা বিল তুলে নেন। সরকারি চাকরি করেও নামে-বেনামে ঠিকাদারি কাজ করেন টিটু।

বর্তমানে নলছিটি থানার সামনে বড় গেট নির্মাণ করছেন তিনি। তার অবৈধ আয়ের নির্দিষ্ট অংশ চলে যায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও নলছিটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এজন্য টিটুর অবৈধ কাজে সহযোগিতা করেন ডিপিইও এবং টিইও। বিনা ছুটিতে মালয়েশিয়া ভ্রমণ করলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

চাকরির সাত বছরে টিটু অবৈধভাবে আয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা। অবৈধ টাকায় বরিশালের রূপাতলীতে সাত শতাংশ জমির ওপর বানিয়েছেন পাঁচতলা বাড়ি। নলছিটি শহরে বানিয়েছেন পাঁচতলা ফাউন্ডেশনের দোতলা বাড়ি।

এসব বিষয়ে মাহতাব হোসেন টিটু বলেন, আমার বিরুদ্ধে দালালির যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্য নয়। সহকর্মীদের বিপদে-আপদে সহযোগিতার জন্য মাঝেমধ্যে শিক্ষা অফিসে যেতে হয়। আমি চাকরির আগে ঠিকাদারি করতাম। ঠিকাদারির আয় থেকে আমি বরিশালে এবং নলছিটিতে বাড়ি বানিয়েছি। আমার অবৈধ কোনো আয় নেই।

ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নবেজ উদ্দিন সরকার বলেন, আমি এখানে নতুন এসেছি। তবে শুনেছি মাহতাব হোসেন টিটুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে ঢাকা মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে একজন সহকারী পরিচালক এসেছেন। যেহেতু বড় কর্মকর্তারা বিষয়টি তদন্ত করছেন তাই এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।

সোনালীনিউজ/টিআই

Wordbridge School
Link copied!