• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফের আলোচনায় খালেদার মুক্তি


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২১, ২০১৯, ০৪:২৮ পিএম
ফের আলোচনায় খালেদার মুক্তি

ঢাকা : আইনি প্রক্রিয়ায় কিংবা রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে নয়, খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন রাজনৈতিক সিগন্যালে। গত কয়েক মাস ধরে সরকারের সঙ্গে পর্দার অন্তরালে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা চলে। বিএনপি চেয়ারপাসনকে মুক্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ছে।

সমপ্রতি বিরোধী দলীয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার মুক্তির আশা আরও বেড়ে যায় বিএনপিতে। যদিও এর আগে থেকেই খালেদা জিয়ার জামিন এবং মুক্তি নিয়ে সরকারের দিকে বিএনপি নেতারা তাকিয়ে ছিলেন।

বিএনপির ভাষ্য, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সরকারের হাতে চলে গেছে। দল চাইলেও খালেদাকে মুক্ত করতে পারবে না, যদি সরকার আন্তরিক না হয়। সে জন্যই খালেদা জিয়া আটকের পর তার মুক্তির আন্দোলন শুধু দলীয় কার্যালয় ও প্রেসক্লাবে কালো পতাকা মিছিল আর কয়েকটি মানববন্ধনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিলো।

এখন বিরোধী দলীয় নেতার মৃত্যুর পরপরই হঠাৎ খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। বরিশালে বিএনপির সমাবেশ থেকে তৃণমূল নেতাদের দেয়া হবে মুক্তির বার্তাও।

দলের বৈদেশিক সম্পর্ক দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা এক শীর্ষ নেতা আমার সংবাদকে জানান, আসছে ঈদুল আজহার আগেই খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন। মুক্তি পেলেই তিনি ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন।

রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক সব দিক থেকেই এমন একটি ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ওই নেতার ধারণা, এরশাদের মৃত্যুর পর সরকারও আর খালেদা জিয়াকে বন্দি রাখতে ইচ্ছুক না। কারণ এরশাদের মৃত্যুর পর দেশে বিরোধী দলের বড় সংকট হয়ে পড়েছে।

মুক্তি পেয়ে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সরব থাকলে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়ক হবে। সেদিক থেকে এখন সরকারই চাচ্ছে বিএনপি ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হোক। খালেদা জিয়া আবার রাজনীতির মাঠে ফিরে আসুক। দেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজনীতির চর্চা হোক।

সরকার খালেদা জিয়াকে এতদিন যে উদ্দেশ্যে আটক রেখেছে, ইতোমধ্যে তা সফল। অযথা আন্তর্জাতিক চাপ নিতেও আর সরকার ইচ্ছুক না। তবে বিএনপির অন্য একটি সূত্রের ভাষ্য, খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে তারেক জিয়ার কারণেই।

তারেক জিয়া যখন তার পছন্দের লোকদের দিয়ে একটা সেটআপ দাঁড় করাবে ঠিক তখনই আকস্মিক খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে যাবেন। কারণ তখন খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে বিএনপিতে বড় আকারে ভাঙন তৈরি হবে।

আর সরকারও সেই সুযোগটি ব্যবহার করবে। সমপ্রতি বিএনপির কাউন্সিল সামনে রেখে তারেক জিয়া তার সেটআপ তৈরি করে রেখেছেন। এখন খালেদার মুক্তি হলেই তারেকপন্থিরা বাদ পড়ে যাবেন। সেদিক থেকেও খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমপ্রতি বলেছেন, খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করবে না সরকার। কিন্তু যে দুটি মামলায় তার সাজা হয়েছে, সেগুলো ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়ের করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন খালেদা জিয়ার মুক্তিতে শুধু বিএনপি নয়, সরকারের উচ্চমহলও হিসাব-নিকাশ কষছেন বলে সূত্রের মত।

এদিকে জিয়া পরিবারের আস্থাভাজনদের একজন ড. কর্নেল অলি আহমদ। সমপ্রতি তিনিও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সরব। বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘ দেড় বছরেও মুক্ত না হওয়ায় জিয়া পরিবারের অনেকের মাঝে ক্ষোভ রয়েছে, তেমনি এই রাজনীতিবিদেরও।

বিএনপির রাজনীতিতে খালেদাকে মাইনাস করে অন্য কিছু ঘটছে বলেও এর আগে ইঙ্গিত দিয়েছেন কর্নেল অলি। বর্তমানে তারেক জিয়ার নির্দেশনায় দল পরিচালনায় তিনি অনেক আগ থেকেই অসন্তুষ্ট। তারেক জিয়া যেভাবে দলকে ঢেলে সাজাচ্ছেন এতে করে খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।

এ নিয়ে তারেকপন্থিদের ধারণা, খালেদা জিয়া এখন যদি হঠাৎ করে মুক্তি পেয়ে যান তাহলে তার পুরো ভূমিকা নিতে চান রাজনৈতিক দূরদর্শী অলি আহমদ। কেননা, খালেদা জিয়া জেল থেকে বের হলেই দলের বর্তমান সেটআপ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক রদবদলও আসবে।

তখন ফের বিএনপিতে প্রবেশ করা অলি আহমদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। যেহেতু রাজনীতিতে চলমান সব নেতার চেয়ে তিনি সিনিয়র তাই মহাসচিব কিংবা বড় পদটিও তার জন্য অপেক্ষা করতে পারে।

খালেদা জিয়ার মুক্তিতে হয়তো কোনো সবুজ সংকেতেই তিনি তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন। জামায়াতের জনপ্রিয়তা বিএনপির ঘরে ধরে রাখতে প্রশ্নবিদ্ধ এই দলটিকেও বিশুদ্ধতার সনদ দিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পর্দার আড়ালে সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বৈঠক হয়। আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ে হয়েছে বড় আকারের লবিং। একই সঙ্গে আইনি লড়াই জোরদার করতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন আইনজীবী ও দলীয় নেতারা।

এর সঙ্গে থাকছে আজ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভাগীয় শহরে সমাবেশ। ১৮ তারিখ বরিশালে, ২০ তারিখ চট্টগ্রাম ও ২৫ তারিখ খুলনায়। লোক সমাগমের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে তৃণমূলকে কৌশলে ম্যাসেজ দেয়া হবে।

রাজনৈতিক পরিস্থিতির নতুন কোনো মেরুকরণ না হলে বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির পথে বড় কোনো বাধা নেই। ঈদুল আজহার আগেই খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন বলে আশা করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতা ও আইনজীবীরা।

জানা যায়, সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের সঙ্গে বিএনপির দুজন শীর্ষ নেতার কয়েক দফা গোপন বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে খালেদা জিয়ার বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনা করে উন্নত চিকিৎসার লক্ষ্যে দ্রুত জামিনে মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়। প্যারোল নয়, জামিনেই মুক্তি পেতে খালেদা জিয়ার অনড় মনোভাবের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন বিএনপি নেতারা।

অন্যদিকে বৈঠকের বিষয়বস্তু সরকারের শীর্ষ মহলকে অবহিত করার কথা জানান ওই প্রতিনিধি।জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার ১৭ বছরের জেল হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ৩৬ মামলার ৩৪টিতেই জামিনে রয়েছেন তিনি। সাজাপ্রাপ্ত এই দুটি মামলায় জামিন পেলেই মুক্তি পেতে পারেন তিনি।

সূত্র আরও জানায়, ইতোপূর্বে গোপন বৈঠকে আলোচনার আলোকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে রাজি হন খালেদা জিয়া। এখন ফের সমঝোতায় হাসপাতাল থেকে চির মুক্তির দ্বার খুলছে। যদিও খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর মাসখানেক রাজপথে বেশ সক্রিয় ছিল বিএনপি।

বিক্ষোভ, কালো পতাকা মিছিল, কালোব্যাচ ধারণ, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি, অনশন ও স্মারকলিপি কর্মসূচিসহ তারা জনসভা ও সমাবেশও করেছে বিভাগীয় পর্যায়ে। কিন্তু এপ্রিলে এসে ভাটা পড়ে দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির আন্দোলন।

কর্মসূচি চলাকালে সরকারি বাধার মুখে রাজপথের কর্মসূচি থেকে সরে এসে নয়াপল্টন ও প্রেসক্লাবভিত্তিক কর্মসূচিতে সরব ছিল দলটি। অন্যদিকে, দীর্ঘ দেড় বছরেও দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে কিছুই করতে পারেনি।

অভিযোগ রয়েছে, সুবিধাভোগীরা অর্থসম্পদ রক্ষায় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছেন। বাকি নেতারা ভুগছেন সিদ্ধান্তহীনতায়।

দলটির তৃণমূল নেতাদের ক্ষোভ, বিএনপিতে এখন খালেদা জিয়ার চর্চা নেই বললেই চলে। তৃণমূল নেতারা বলছেন, বিএনপির শীর্ষ নেতারা আসলে খালেদা জিয়ার মুক্তি চায় কিনা এ বিষয়েও তাদের সন্দেহ রয়েছে।

তবে নানা ক্ষোভের মাঝে রাজনীতিতে ফের খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির একটি ইঙ্গিত ইতোমধ্যে তৃণমূল নেতাদেরও দেয়া হয়েছে। আজ থেকে বিএনপির যে বিভাগীয় সমাবেশ শুরু হচ্ছে এখান থেকেই খালেদার মুক্তির বার্তা দেয়া হবে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে এবং সরকার কোনো হস্তক্ষেপ না করলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে বের হয়ে আসতে পারবেন।

আন্তর্জাতিক উইংয়ের সিনিয়র সদস্য ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার। আমাদের আশা, শিগগির খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন। এ লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।

খালেদা জিয়ার মুক্তির আশা প্রকাশ করেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকারও। তিনি বলেন, সরকার বাধা না দিলে অনেক আগেই খালেদা জিয়ার জামিন হয়ে যেত। আমরা আশা করি সরকার বাধা না দিলে তিনি খুব শিগগিরই জামিন পাবেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তার মুক্তি হবে কি হবে না, এটা এখন সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার। কারণ বিচারকদের সরকার যা বলবে, তারা তাই করবেন। কেবল আইনি লড়াইয়ে বেগম জিয়াকে মুক্ত করে আনা সহজ হবে না।

সরকারের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আজ দেড় বছরেরও বেশি সময় বেগম জিয়া কারাগারে আছেন। আইনি প্রক্রিয়ায় তার জামিনের জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কিন্তু তার সত্যিকারের মুক্তি আসবে আন্দোলনের মাধ্যমে। রাজপথেই বেগম জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত হতে পারে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও আশা প্রকাশ করে বলেন, এ মুহূর্তে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসা মানে খালেদা জিয়ার মুক্তি। তার মুক্তি হলে, সেটি হবে গণতন্ত্রের মুক্তি, গণমাধ্যমের মুক্তি, গণমানুষের মুক্তি। খালেদা জিয়ার মুক্তিতে আমাদের যে আন্দোলন চলছে তা অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!