• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিএনপির আইনি সহায়তা কমিটি

‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৯, ১১:০৭ পিএম
‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’

ঢাকা : বিএনপির ভাষায় রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় জড়িত নেতাকর্মীদের কার্যত দেখভাল করার কেউ নেই। ফৌজদারি মামলা পরিচালনা, গ্রেফতারকৃত বা হুলিয়া মাথায় নিয়ে দৌড়ের ওপর থাকা সক্রিয় নেতাকর্মীরা প্রতিশ্রুত বিনামূল্যে আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দলীয় আইন সহায়তা কমিটি এখন কাগুজে কমিটিতে রূপ নিয়েছে। তাদের কাছে সহায়তা বা সহানুভূতি কোনো কিছুই মেলে না। পয়সা ছাড়া কথা বলতেও চান না ওইসব আইনজীবী। এমনটাই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

প্রায় আট বছর আগে ২০১১ সালের জুন মাসে বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনকে প্রধান করে ২১ সদস্যের এই আইনি সহায়তা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘোষিত হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলন করে খন্দকার মাহবুব জানিয়েছিলেন, ভিকটিম বা তাদের পরিবার দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট বারসহ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম নেতাদের সঙ্গে সমস্যার কথা জানালে তাদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে।

দলীয় সূত্র জানায়, আইনি সহায়তা কমিটি গঠনের পর থেকে এর সদস্যদের নিয়ে কখনো কোনো বৈঠক হয়নি। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি হামলা-মামলা অব্যাহত থাকলেও নিষ্ক্রিয় কমিটিকে সক্রিয় করা যায়নি। এর কোনো পরিবীক্ষণ (মনিটরিং) সেল নেই। সারা দেশে নেতাকর্মীদের নামে রুজুকৃত নানাবিধ ফৌজদারি অপরাধের মামলা ও গ্রেফতার বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই এই কমিটির কাছে। মাঝেমধ্যে কমিটির সদস্যরা যে তথ্য দেন তাও পরস্পরবিরোধী বলে অভিযোগ রয়েছে।

আইনি সহায়তা কমিটির ‘বিনামূল্যে সেবা’ সম্পর্কে খোদ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের দফতর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারি তার নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।   

তিনি বলেন, ‘ভাই আওয়ামী লীগ জামানায় বাবা-মা’র সংসারের বড় বোঝায় পরিণত হচ্ছি। ডজনখানেক মামলা নিয়ে ঘুরছি যাযাবরের মতো। দলীয় আইনজীবীর বিনামূল্যের সহায়তা তো দূরের কথা, উল্টো শোষণের শিকার হচ্ছি। টানা চার মাস বন্দিদশায় ছিলাম। কারামুক্ত হয়ে নগদ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে নিজ দলের আইনজীবীকেই।’

মনে ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়ে এসব কষ্টের কথা জানালেন সাত্তার পাটোয়ারি। তিনি আরো জানান, ছাত্রদলের আরেক নেতা করিম সরকারের সঙ্গে মারপিট হয়েছে মামলার টাকা নিয়েই। বিচার দেওয়া আছে আইনজীবী সমিতিতে।

তার ভাষ্যমতে, যদিও দলীয় সামান্য আর্থিক বরাদ্দ রয়েছে এ কমিটির জন্য। তবু ছাত্রদলের কোনো নেতাকর্মী  বিনামূল্যে সেবা পেয়েছে এমন তথ্য তার কাছে নেই। তার ধারণা, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলার সংখ্যা তিন লক্ষাধিক।

ছাত্রদলের আরেক নেতা নাম প্রকাশে ভীত নরসিংদীর তাসলিম (ছদ্মনাম) ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা জানান। রাজনৈতিক এক সহকর্মীর মুক্তির দাবিতে পুরান ঢাকায় পোস্টার লাগাতে গেলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তাসলিম বলেন, একই ধারার মামলায় অন্য আসামিরা দু’তিন সপ্তাহের মধ্যে জামিনে মুক্তি পায়। তার ক্ষেত্রে লেগেছে ছয় সপ্তাহেরও বেশি। মুক্ত হয়ে তিনি জেনেছেন মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে তার পরিবারকে।

তিনি বলেন, ‘নিম্ন আদালতে জামিনের আবেদন দাখিল না করেই বলা হয়েছে শুনানির তারিখ পড়েছে। উচ্চ আদালতের বেলায়ও তাই করা হয়েছে। দলীয় আইনজীবীর কাছে সুবিধার বদলে প্রতারণার শিকার হয়েছি।’

এ ছাত্রদল নেতার আরো অভিযোগ, আর্থিকভাবে দুর্বল নেতাকর্মীদের অনেকের মামলা চলছে কচ্ছপ গতিতে। টাকার জোগান দিতে ব্যর্থ নেতাকর্মীর মামলা থমকে যায়। আটক অনেকেরই কারাবাস অযথা দীর্ঘ হয়। অথচ তাদের বিনা পয়সায় আইনি সহায়তা পাওয়ার কথা।

জেলা পর্যায়ের চিত্র আরো করুণ বলে জানান অসচ্ছল নেতাকর্মীরা। লক্ষ্মীপুর জেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদ আলম। একাধিক মামলায় কারাবাস করেছেন তিনি। বিনাপয়সায় আইনি সেবা পাননি, উল্টো পরিবারের সদস্যরা দলীয় আইনজীবীদের কাছে হয়রানির শিকার হয়েছে।

মোর্শেদ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা শাঁখের করাতের মতো হয়রানির শিকার। সরকার মামলা ঠুকে হয়রানি করে, আর বিএনপির আইনজীবীরা টাকার জন্য হয়রানি করে।’ তার প্রশ্ন, এই বেহাল অবস্থায় দলের সক্রিয় নেতাকর্মীরা রাজনীতির ময়দানে ঝুঁকি নিয়ে নামবে কেন?

শরিয়তপুরের বিএনপি নেতা জহুরুল ইসলাম। তিনি জানান, তার জেলায় আইন সহায়তা কমিটির হদিস নেই। নিগৃহীত নেতার হিসেবে রাখবে কে? তার মতে, জেলাপর্যায়ে নেতাকর্মীরা নিজ নিজ সামর্থ্যে মামলার লড়াই করে টিকে আছে। প্রতিটি ঘরেই মামলার শিকার কর্মী-সমর্থক আছে, কিন্তু সহযোগিতা করার মতো নেতা মহল্লাতে মিলছে না। তার আশঙ্কা, একবার যে জেলে গেছে, জামিনে মুক্তি পেয়ে সে আর চলমান রাজপথের আন্দোলনে ফিরবে কি না বলা মুশকিল।

জামালপুরের মাদারগঞ্জের ফরিদ আহমেদ। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, বিস্ফোরকসহ বিভিন্ন মামলায় ৫ মেয়াদে সাড়ে ৬ মাস কারাভোগ করেছেন। ৯ মামলার মধ্যে ৪টি নিষ্পত্তি হয়েছে। অন্য মামলার মতো চলমান ৪ মামলাতেও দলীয় আইনজীবীদের কোনো সহযোগিতা পাননি এই বিএনপি নেতা।

তার অভিযোগ, আইনজীবীরা পয়সা ছাড়া কথাও শোনে না। কথা বলতেও চান না। নেতাকর্মীরা কিংবা তাদের পরিবার এই কমিটির কাছে আইনি সহায়তার জন্য গেলে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসতে হয়। তার ভাষায়, দলীয় আইনজীবীদের আচরণ নিষ্ঠুরতার শামিল। চাহিদামতো টাকা না দিলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেও দ্বিধা করে না।  

এ বিষয়ে আইন সহায়তা কমিটির চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ২০১১ সালে কমিটি করা হয়েছিল। সেবাও দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কত নেতাকর্মীকে সেবা দেওয়া হলো তার হিসাব জানা নেই। বিষয়টি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম দেখাশোনা করছে বলে জানান তিনি।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘আমি কমিটিতে নেই। কমিটি গঠনকালে আমি ছিলাম না। কত ভিকটিমকে (মামলার শিকার) সেবা দেওয়া হয়েছে এমন তথ্যও আমার জানা নেই। তবে আমি একজন সাধারণ আইনজীবী হিসেবে নেতাকর্মীদের যতটুকু সম্ভব সেবা দিচ্ছি।’

জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী এই নাজুক ও সংবেদনশীল বিষয়টি স্বীকার করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাব ছিল বয়ঃকনিষ্ঠ (জুনিয়র) আইনজীবীমণ্ডলি নিয়ে কমিটি গঠন করার। এর সমর্থনে যুক্তি ছিল জ্যেষ্ঠ (সিনিয়র) আইনজীবীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে  যা হবার তাই হয়েছে। বিনামূল্যে আইনি সহায়তা অপস্রিয়মাণ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!