• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আড়িয়ল বিলেই হোক


গোলাম কাদের জানুয়ারি ২৭, ২০১৯, ০১:২৭ পিএম
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আড়িয়ল বিলেই হোক

ঢাকা : প্রাচীন বিক্রমপুর পরগনা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে আজ ৬টি উপজেলা নিয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক বিক্রমপুর প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের জনপদ। এ ভূমি স্বমহিমায় হাজার বছর ধরে সভ্যতার আলো ছড়িয়ে আসছে, যার নাম উল্লেখ পাই— মনুসংহিতায়, লঘু ভারতে, গড়ুর পুরাণে, মৎস পুরাণে, রামায়ণে, মহাভারতে, শ্রীচৈতন্য ভগবতে এবং আইন-ই-আকবরিতে। মিনহাজ-ই-সিরাজ বিক্রমপুরকে তার তরিকত-ই-নাসিবাতে সমতট বলে উল্লেখ করেছেন।

নবদ্বীপ, সোনারগাঁও, ঢাকা, সপ্তগ্রাম, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের মতো স্থানগুলো যখন সাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে, তারও বহু আগে থেকে বিক্রমপুর ভাষা, শিক্ষা, সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে, ভাস্কর্যে ও ললিতকলার বিভিন্ন দিকে দেশ-বিদেশে কীর্তি খ্যাতি গৌরব অর্জন করেছিল। যার ধারা আজো অব্যাহত গতিতেই বয়ে যাচ্ছে। এ এলাকা শাসন করেছে চন্দ্রবর্ম, দেববংশীয় পাল, সেন। সুলতানী আমলে এ এলাকা পেয়েছে খ্যাতি। আজকের মুন্সীগঞ্জ জেলা ছিল সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। বর্তমানে বিভিন্ন প্রত্ন স্থাপনা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সেই সত্যই উদঘাটিত হচ্ছে। এখানে পাল, সেন, সুলতানী আমলকে ঘিরে তিনটি ধর্মান্দোলন হয়েছে। বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান এখানে তাদের বিকাশ সাধন করেছে।

বহু সভ্যতার উত্থান-পতনে বহু শাসক বদল হয়েছে। ইতিহাসে তাদের নাম অক্ষয় হয়ে আছে। তার চেয়েও অক্ষয় হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘নাম মানুষকে বড় করে না, মানুষই নামকে জাঁকাইয়া তোলে।’ ঠিক তেমনি বিক্রমপুর। বিক্রমপুরকে প্রসিদ্ধ করেনি, বিক্রমপুরের মানুষই বিক্রমপুরকে জগতের কাছে সুপরিচিত করেছে— বিক্রমপুরের কৃতী সন্তানের নাম শুনে কোনো কোনো দেশের রাজা শ্রদ্ধায় মাথা নত করে দাঁড়াতেন।

হাজার বছর আগে শীলভদ্র, যার জন্ম মুন্সীগঞ্জ সদরের গণকপাড়ার কাছে; অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, যার জন্মস্থান ব্রজযোগিনী গ্রামে-যিনি হাজার বছর আগে সুদূর চীনে গিয়ে ধর্মরক্ষায়, তৎকালীন সমাজের অবক্ষয় রোধে কাজ করে জগদ্বিখ্যাত হয়েছিলেন, যিনি হাজার বছর আগে চীন-বাংলা মৈত্রী স্থাপন করে গেছেন। এ ছাড়া আছেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সি আর দাসের মতো দেশপ্রেমিক, মানবপ্রেমিক, রাজনীতিক। এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন ব্রিটিশ ভারতের চিফ জাস্টিস চন্দ্রমাধব ঘোষ, বিপ্লবী যুগের বিনয় বাদল, প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. নলিনী কান্ত ভট্টশালী, পাঞ্জাব ট্রিবিউনের সম্পাদক শীতলাকান্ত, আয়ুর্বেদিক আচার্য শ্রীশ চন্দ্র সেন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পণ্ডিত ক্ষীতিমোহন সেন, কবি সৈয়দ এমদাদ আলী, রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ প্রমুখ।

ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে ৯০০ বর্গমাইলের বিক্রমপুর ৩৬২ বর্গমাইলে এসে ঠেকেছে ১৯৮৮ সালের বন্যায় ও ভাঙনের কবলে পড়ে। এখন হয়তো ৩০০ বর্গমাইলে এসে ঠেকেছে। ১৮৭৪ সালে ৪৫৮টি গ্রাম নিয়ে দক্ষিণ বিক্রমপুর গঠিত হয় যা আজ ফরিদপুুরের অংশ। উত্তর বিক্রমপুর আজ মুন্সীগঞ্জ জেলা। নড়িয়া, শিবচর এখন দক্ষিণ বিক্রমপুরের অংশ।

আড়িয়ল বিল বিক্রমপুরের সৌন্দর্যের আধার। ১৩৬ কিলোমিটারের এই বিল দেশের মধ্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিল। জীববৈচিত্র্য ও নয়নাভিরাম এ বিলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। নিম্ন অঞ্চলের জল আর মেঘ, মেঘের গুরুগুরু আকর্ষণ, প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা স্বাদুপানির মাছের খনি বললে ভুল হবে না এ বিলকে। এখানে বহু মালিকের প্রায় পাঁচশ পুকুর রয়েছে, রয়েছে খাসভূমি, বহু হিন্দু ভূস্বামীর জায়গাজমি। এগুলো লুটেপুটে খাচ্ছে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল। শুধু তা-ই নয়, পদ্মা সেতু ও তার আশপাশের মেগা প্রকল্পের ভারে ভূমিদস্যুরা হাউজিং প্রকল্প করে নিম্নভূমি ভরাট করে বিক্রমপুরের আদি ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য নষ্ট করছে। প্রশাসনের সেদিকে খেয়াল নেই।

এই আড়িয়ল বিলকে ঘিরে আরেকটি মেগা প্রকল্প পাখা মেলার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য আড়িয়ল বিল ছিল একটি উত্তম বিবেচনা। স্বার্থান্বেষী চক্রের বিরোধিতায় তা স্থগিত হয়ে যায়। জনগণের বিরুদ্ধে কিছু লোক আড়িয়ল বিল লুটেপুটে খাচ্ছে। তাদের স্বার্থে আঘাত লাগায় তারা আন্দোলনে নামে। পুরো বিক্রমপুর এখন ভূমিদস্যুদের কবলে পড়েছে। সরকার ভূমিদস্যুদের উচ্ছেদ করে জাতির স্বার্থে আড়িয়ল বিলেই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ করুক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শক্ত হাত এ প্রকল্পের জন্য ব্যবহার করবেন আশা করি। আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আজ মুন্সীগঞ্জবাসীরই দাবি নয়, সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলসহ জাতীয় দাবি। বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের আকাশপথে যোগাযোগ বাড়ানোর এখন একটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। ঢাকার অদূরে আন্তর্জাতিক মানের একটি বিমানবন্দর এই মুহূর্তে নির্মাণ না করা হলে আমরা পিছিয়ে যাব। বর্তমান ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি নির্মাণ করা হয় ষাটের দশকে। ঢাকা তখন পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী। তখন জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি। ২ হাজার একর জমিতে দুটি রানওয়ে নিয়ে শুরু হওয়া এ বিমানবন্দর এখনো সচল। দেশে এখন ১৮ কোটি মানুষ। সুপরিসর বিমানের অবতরণ ও উড্ডয়নের সুযোগ নেই। এছাড়া নানা অবকাঠামো গড়ে ওঠায় বিমানবন্দরের জায়গাও সংকুচিত হয়েছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ বিমানের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডেনিশ উপদেষ্টা র্যামবল ২০০৬ সালে একটি মাস্টার প্ল্যান দিয়েছিলেন। সেখানে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নানা জটিলতা তুলে ধরে ঢাকার খুব কাছে একটি বিমানবন্দর স্থাপনের উপদেশ দিয়েছিলেন। সেই পরামর্শ মোতাবেক বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

আগামী ২০ বছরে এশিয়ায় বিমানপথ সবচেয়ে সম্প্রসারিত হবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের কর্মসংস্থান, বাজার, ব্যবসা, শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। বাংলাদেশের শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তা ছাড়া এরই মধ্যে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে আমাদের দক্ষ শ্রমিকের জন্য বাজার খুলে যাচ্ছে। এখানে জাপানের শ্রমবাজারের কথা উল্লেখ করার মতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর মধ্যেই অনুধাবন করে বলেছেন, ২০২৯ সালের মধ্যে বিমানযাত্রীর সংখ্যা যে পরিমাণে দাঁড়াবে, তাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রীসেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।

আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর হলে বিমানপথ বাড়বে। আয় বাড়বে। সেই আয়ের অংশীদার হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনগণ। আগের সমীক্ষায় নতুন এই বিমানবন্দরের জন্যই আড়িয়ল বিল নির্ধারণ করা হয়। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর হলে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ ও দ্রুত হবে। সমগ্র দেশের সঙ্গে যোগাযোগের একটি সহজ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যাবে। তার মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-খুলনা হাইওয়ে, ঢাকা-কেরানীগঞ্জ-কায়কোবাদ ব্রিজ, নবাবগঞ্জ-দোহার-শ্রীনগর আঞ্চলিক মহাসড়ক, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ- সিরাজদিখান-শ্রীনগর আঞ্চলিক মহাসড়ক, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ- বালিগাঁও- লৌহজং-শ্রীনগর সড়ক আড়িয়ল বিলকে ঘিরে ঢাকার সড়কপথের নেটওয়ার্ক। এখানে বিমানবন্দর হলে প্রস্তাবিত সড়কগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্রীনগর-নিমতলা- বসিলা-আমুলি- বঙ্গবন্ধু সেতু জাতীয় সড়ক যা উত্তরবঙ্গকেও সমৃদ্ধ করবে।

শ্রীনগর-দোহার-পাটুরিয়া জাতীয় সড়ক, নবাবগঞ্জ-সিঙ্গাইর- ঢাকা জাতীয় মহাসড়ক গড়ে উঠবে। মোংলা ও চট্টগ্রাম থেকে লাইটারেজ জাহাজে ভাগ্যকূলে এভিয়েশন ফুয়েল সরবরাহের জন্য নৌবন্দর নির্মিত হবে। ফলে আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলে সারা দেশে সড়কপথে এক অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হবে। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর হলে উপর্যুক্ত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যত সহজে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হবে, অন্য কোনখানে করলে ততটা সহজ হবে না। তা রাজধানী থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন থাকবে। আড়িয়ল বিলে এই কাঙ্ক্ষিত বিমানবন্দর হলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প আরো বিকশিত হবে। সর্বোপরি ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। পাল্টে যাবে বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ জেলা তথা বাংলাদেশ। জনবহুল ঢাকার ওপর চাপ কমবে, পরিচ্ছন্ন ঢাকা হয়ে উঠবে বাসযোগ্য। সম্প্রতি বিমানমন্ত্রী বলেছেন, সাইট সিলেকশন চূড়ান্ত হওয়ার পথে। মুন্সীগঞ্জের সাইট সেখানকার কিছু মানুষের বিরোধিতার কারণে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পদ্মার ওপারেই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হবে।

উপরে উল্লেখিত সুবিধাদি বিবেচনায় এনে আমরা যাতে একটি বিচ্ছিন্ন জায়গায় বিমানবন্দরটি না করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার দৃঢ়চেতা মন নিয়ে দক্ষতা দিয়ে জাতীয় স্বার্থের সমস্ত সুবিধা দেখে আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেবেন- এমনটাই আশা করি।

পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করা হচ্ছে। এখন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণে বিশ্বসমাজ এগিয়ে আসবে সানন্দে। পদ্মাপাড়ের ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পেয়ে খুশি। তারা আশা করে, সরকার আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণে নতুন করে মুন্সীগঞ্জ জেলার দলমত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে আলোচনা করে পদ্মা সেতুর মতো একটি স্বপ্নময় বিমানবন্দর জাতিকে উপহার দেবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও শক্ত হাতে তার দৃঢ়চেতা মনোবল। আশা করি আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারো ভাববেন এবং জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি বড় বড় চ্যালেঞ্জ যেহেতু মোকাবেলা করে সফল হয়েছেন, আশা করি আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের চ্যালেঞ্জও তিনি গ্রহণ করে এগিয়ে যাবেন এবং সফল হবেন।

লেখক : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!