• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা কাগজে নিয়মিত!


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ২১, ২০১৯, ১১:৫৩ পিএম
বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা কাগজে নিয়মিত!

ঢাকা : এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াল ব্যাংক খাতের পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল আইনের শাসন, প্রভাব খাটিয়ে ঋণ বের করে নেওয়া, অভ্যন্তরীণ পরিপালন ব্যবস্থায় ঘাটতিসহ নানা কারণে বাড়ছে ঋণ নিয়মিতকরণের পরিমাণ। এই অবস্থা ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত ভয় তৈরি করছে। চাপ বাড়ছে ব্যাংকারদের। বছরে গড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা নিয়মিতকরণ করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ পুনঃতফসিলীকরণের এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে ব্যাংকারদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। ঋণ দেওয়ার সময় যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে। বাছ-বিচার ছাড়া ঋণ দেওয়ায় সেসব ঋণ ফেরত আসছে না। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে পুনঃতফসিল করে দিতে হচ্ছে।

বিধি মোতাবেক, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ একটি ঋণ তিনবার পুনঃতফসিল করতে পারে। ন্যূনতম ১০ শতাংশ পরিশোধ করে সেটি করার সুযোগ রয়েছে। তবে প্রভাব খাটিয়ে ৮-১০ বার পুনঃতফসিল করে দেওয়া হচ্ছে কোনো কোনো গ্রাহকের ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, গত ৭ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ১৫ হাজার ১২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। এর আগে ৭ বছরে যার পরিমাণ ছিল ৮৯ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, গত সাত বছরে গড়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা কাগজে নিয়মিত করা হয়েছে।

তফসিলি ব্যাংকগুলোর বড় বড় গ্রাহকরা এই বিপুল পরিমাণ ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করেছেন। কিন্তু আদায় হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছরই বাড়ছে ঋণ পুনঃতফসিলের হার। ২০১২ সালে ব্যাংকগুলো থেকে বিভিন্ন গ্রাহক ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ ন্যূনতম কিস্তি পরিশোধ করে নিয়মিত করে নেন। তবে পরের বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা মোতাবেক এই সুযোগ কমে যায়। ফলে কমে যায় ঋণের পুনঃতফসিলের হার। ২০১৩ সালে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করার অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

২০১৪ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে মোট ১৫ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল হয়েছে। তবে পুনঃতফসিলে বড় উল্লম্ফন হয়েছে ২০১৬ সালে। প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ঋণের পুনঃতফসিল করে নিয়েছেন গ্রাহকরা। ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। সেটি আবার বেড়েছে বিদায়ী বছরে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পুনঃতফসিল করা ঋণের অর্ধেকের বেশিই এক সময় খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। কিছু গ্রাহক সাময়িক ব্যবসায়িক লোকসানে পড়ে আইনি এই সুযোগ নিলেও বেশিরভাগ গ্রাহক এটিকে ফায়দা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।

সরকারি-বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক এখানে বেশি ঝুঁকিতে। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ব্যাপক হারে গ্রাহকের ঋণ পুনঃতফসিল করে বেঁচে আছে। এভাবে ঋণ বিতরণে অনিয়ম করার ফলে ব্যাংক খাতে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এর মধ্যে ঋণ পুনঃতফসিল করার শর্ত কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। এর ফলে দৃশ্যত খেলাপি ঋণ কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার কোটি টাকা। আর এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের হিসাবের খাতা থেকে অবলোপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মোতাবেক, ঋণের সবচেয়ে বেশি পুনঃতফসিল হয় তৈরি পোশাক খাতের ঋণ। মোট পুনঃতফসিল ঋণের ৫ ভাগের এক ভাগ এই খাতের। অথচ দেশের রফতানি আয়ের বড় অংশ আসে এই খাতের মাধ্যমে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। প্রায় ৩০ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় এসেছে পোশাক খাতের মাধ্যমে।

হিসাব বলছে, পোশাক খাতের মোট ঋণের ১৫ শতাংশ হারে প্রতিবছর পুনঃতফসিল করে নেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। আর ঋণের পুনঃতফসিল হার সবচেয়ে কম চলতি মূলধনের জোগান হিসেবে প্রদত্ত অর্থে। ঋণ পুনঃতফসিলের অর্ধেকই করা হয়ে থাকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে। মোট পুনঃতফসিল ঋণের ৫১ শতাংশ করে থাকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ ব্যাপারে বলেন, ব্যাংক খাতে চাপ তৈরি করছে ঋণ পুনঃতফসিল করার ধারা। ঋণ দেওয়ার আগে বাছ-বিচার করা হচ্ছে কম। সুশাসনের ঘাটতি থেকে এই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। পুরো খাতে একটি ভয় তৈরি করছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ঋণ পুনঃতফসিল করার সুযোগটি একটি আইনি সুযোগ। এটি যদি কোনো গ্রাহক অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে সেটি আসলে শনাক্ত করা কঠিন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!