• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বন্দিদের তৈরি ‘কারাপণ্য’ অর্থনীতির নতুন জোগান


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৯, ১০:৩৪ পিএম
বন্দিদের তৈরি ‘কারাপণ্য’ অর্থনীতির নতুন জোগান

ঢাকা : বদলে যাচ্ছে কয়েদিদের জেল জীবন। কারাগার এখন কেবল বন্দিশালা নয়, বরং সংশোধনাগার হিসেবে তৈরি করার লক্ষ্যে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বদলে যাচ্ছে ২৭২ বছরের পুরনো নিয়ম। এখন থেকে কারাবন্দিদের দেওয়া হবে উন্নত খাবার। কয়েদিদের দেওয়া হচ্ছে উপার্জনমুখী প্রশিক্ষণ। তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বাহারি রকমের গৃহস্থালি পণ্য।

দেশের বিভিন্ন কারাগারে হাজার হাজার বন্দিদের হাতে তৈরি করা এই কারা পণ্য নতুন সম্ভাবনার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে। এই কার্যক্রমের পরিধি প্রকল্প আকারে গৃহীত হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা যাবে।

জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি হাজার হাজার মানুষকে কর্মসংস্থানে যুক্ত করে এই কার্যক্রম প্রকল্প আকারে আরো বিস্তৃত করবে সরকার।

বর্তমানে বন্দিদের তৈরি যেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর লভ্যাংশ থেকে বন্দিদের অংশ জমা হচ্ছে তাদের নামে। এই অর্থ তারা জেলমুক্ত পরবর্তী জীবনে কাজে লাগাতে পারবে। এর ফলে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের হাতে তৈরি পণ্য বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

কারাগারে বন্দি জীবনে আয়ের সুযোগ ঘটছে তাদের, যা মুক্ত জীবনের পাথেয় হিসেবে ভুমিকা রাখবে। আর এসব করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে। একই সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুনভাবে জীবন সাজাতে পারবে। এর ফলে বন্দি-পরবর্তী জীবনে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে বলে মনে করছেন কারা কর্তৃপক্ষ।

সবাই জানেন, কারা জীবন মানেই অপরাধের শাস্তি হিসেবে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী বন্দি জীবন কাটানো। কিন্তু এতে করে কোনো মানুষের অপরাধবোধ শেষ হয় না। বরং তার মুক্ত জীবনে নতুন করে বাঁচার আশা নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণেই কারাগার শব্দটির পরিবর্তে সংশোধনাগার করা হয়।

কারা জীবন যাতে বেদনাবিধুর না হয়ে পড়ে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কারাগারের বন্দিদের পরবর্তী মুক্ত জীবনে স্বাভাবিক কাজ করার মানসিকতা তৈরি করার জন্য নেওয়া হয়েছে নানান ধরনের উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বন্দিদের খাবারে নিয়ে আসা হচ্ছে বিরাট পরিবর্তন। তাদের প্রতিদিনের আটার রুটি আর আখের গুড়ের পরিবর্তে সপ্তাহে দুদিন খিচুড়ি, একদিন হালুয়া রুটি ও চারদিন সবজি রুটি দেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে পাঠানো এ সংক্রান্ত একটি চিঠি অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই ২৭২ বছরের পুরাতন ও প্রচলিত নিয়ম ভেঙে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।

জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ডায়েট স্কেল অনুযায়ী চলমান খাবার নিয়ে কারাবন্দিদের চাপা ক্ষোভ ছিল দীর্ঘদিনের। ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রংপুর জেলা প্রশাসক রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে গেলে বন্দিরা তাদের সকালের নাশতায় রুটি, হালুয়া, খিচুড়ি ও সবজি দেওয়ার দাবি জানায়।

কারা কর্মকর্তাদের মতে, অনেক বন্দি পিসির মাধ্যমে বাড়ি থেকে টাকা এনে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ক্যান্টিন থেকে উন্নত নাশতা খাওয়ার সুযোগ নিলেও সক্ষমতা না থাকায় এ সুযোগ সবার জন্য হয় না। প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে সব কারাগারে একযোগে সকালের নাশতার মেনু পরিবর্তন হবে।

হস্তশৈলীতে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন আসবাবপত্র : ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ স্লোগান বাস্তবায়নে কারা কর্তৃপক্ষ সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের ঢাকা আহছানিয়া মিশনের সহযোগিতায় হস্তশিল্পসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলেন। ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে বিভিন্ন মেয়াদে বন্দিদের নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই দেওয়া হচ্ছে বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণ।

কয়েদি পুরুষ ও মহিলাদের তাঁত, রান্না, সেলাই, ইলেকট্রিক অ্যান্ড হাউজ ওয়্যারিং, লন্ড্রি, বেকারি, নার্সারি, বিউটি পার্লার ও কুটিরশিল্পের বিভিন্ন কাজ শেখানো হচ্ছে। এই প্রশিক্ষণ নিয়ে কয়েদিরা কাঠ, বেত, বাঁশ, তাঁত, সুতা ও বিভিন্ন ধরনের উপকরণ দিয়ে তৈরি করছে ছোট-বড় মোড়া, চেয়ার, ঝুড়ি, বাঁশের দোলনা, কলমদানি ও বেতের ঝুড়িসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ব্যবহারিক সামগ্রী।

কয়েদিদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও মানসিক বিকাশে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে জীবনমান বদলে দেওয়ার জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিফলন হিসেবে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েদিরা নিপুণ কারিগর হয়ে উঠছেন। তৈরি করছেন বাঁশ, বেত ও কাঠের দৃষ্টিনন্দন বাহারি আসবাব ও গৃহসামগ্রী। কারা কর্তৃপক্ষের মতানুযায়ী, এসব প্রশিক্ষিত বন্দিরা মুক্তিলাভের পর নতুনভাবে নিজেদের কর্মজীবন শুরুর পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।

বাণিজ্য মেলায় সাড়া ফেলেছে কারাপণ্য : এবারের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় পুরো একটি প্যাভিলিয়ন সাজানো হয়েছে কয়েদিদের তৈরি করা পণ্যের সমাহারে। এই আয়োজনটি ছিল কয়েদিদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা পরিবর্তন করা। এর মাধ্যমে কয়েদিদের প্রতি একধরনের সহানুভূতির জন্ম নিয়েছে সাধারণ জনগণের মাঝে। ক্রেতা দর্শনার্থীরা আগ্রহ নিয়ে বেছে বেছে কিনেছেন কয়েদিদের তৈরি নান্দনিক গৃহসামগ্রী।

কয়েদিদের তৈরি বাহারি পণ্য তালিকায় রয়েছে পুতিদানার তৈরি হাতব্যাগ, ফুলদানি, নকশিকাঁথা থেকে শুরু করে বুটিক ও বাটিকের থ্রিপিস। প্রায় ২শ’ রকমের পণ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে কারাপণ্য প্যাভিলিয়ন।

এশিয়ার সর্বাধুনিক ও বৃহত্তম মডেল কারাগার : শত বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুরে স্থানান্তর করা হয়েছে। রাজধানীর কেরানীগঞ্জে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রায় ৪ হাজার ৫৯০ জন বন্দি রাখার জন্য এ কারাগারটি নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বের আধুনিক সব কারাগারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কারাগারটি নির্মাণ করা হয়।

কারাগারে প্রথম পোশাক কারখানা : চালু করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে পূর্ণাঙ্গ গার্মেন্ট কারখানা। এটিই দেশের কোনো কারাগারে স্থাপিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ গার্মেন্ট কারখানা। সমাজসেবা অধিদফতর ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তায় ‘কারা গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি’ নামে এ গার্মেন্ট কারখানা নির্মাণ করা হয়। এখানে দুই শিফটে তিনশ বন্দি কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। কারা বিভাগ বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান।

১৭৮৮ সালে তৎকালীন শাসকদের দ্বারা একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তথা কারা বিভাগের যাত্রা শুরু। পরে ১৮১৮ সালে রাজবন্দিদের আটকের জন্য বেঙ্গল বিধি জারি করা হয়। ১৮৩৬ সালে জেলা ও তৎকালীন মহকুমা সদর ঢাকা, রাজশাহী, যশোর ও কুমিল্লায় কারাগার নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯২৯ সালে ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারকে কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে জেল বা বিডিজে’র যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার রয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!