• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা সনের ইতিকথা


মো. জোবায়ের আলী জুয়েল এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৩:২৮ পিএম
বাংলা সনের ইতিকথা

ঢাকা : মানবসভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষ সময় ও দিনকালের হিসাব রাখার প্রয়াসে দিন-রাত্রি, চন্দ্র-সূর্যের উদয় অস্ত, তারকার গতিবিধি নানাভাবে নিরীক্ষণ করে চলেছে উৎসুক জ্যোতিষী, গবেষক, বিজ্ঞানী ও উৎসাহী পণ্ডিতকুল। আর এ জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস পেয়েছে আদিকাল থেকে বর্ষ গণনার।

ইতিহাসের তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, আদি সভ্যতার লীলভূমি মিসরই বর্ষপঞ্জি উদ্ভাবনের সূতিকাগার। মিসরীয়রা নীল নদের পানিপ্রবাহে বন্যার গতিধারা নিরূপণে তারকার গতিবিধিকে নীল নদের নিয়ন্ত্রক বলে বিশ্বাস করত। সে কারণে মরু অঞ্চল ও সাগরবেলা থেকে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করত এবং লুব্ধক নক্ষত্রকেই নীল নদের জলের ভাগ্যবিধাতা বলে বিশ্বাস করত। আর সেই বিশ্বাস থেকেই ক্রমাগত প্রয়াসে সৃষ্টি হয় জ্যোতিবিদ্যার। মিসরীয় জ্যোতিবিদরা তারকারাজির গতিবিধি বিশ্লেষণ করে রাশিচক্র নির্ণয়ে সক্ষম হন এবং রাশিগুলোকে মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন- এই বারোটি নামে অভিহিত করেন। মিসরীয়রাই কৃষির প্রয়োজনে দিন ও রাতকে হিসাব করে ৩৬৫ দিনে এক বছর হওয়ার পদ্ধতি বের করেন, যা সৌর বর্ষ হিসেবে আজো চলমান। কালের বিবর্তনে ব্যাবিলনীয় জ্যোতির্বিদরা বছরকে মাস ও সপ্তাহে এবং রাত ও দিনের সময়কে বিভাজন করে নিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে ঘণ্টা ও মিনিটে বিভাজন হয়ে অধুনা সময় নির্ণয় পথ উন্মুক্ত করেছে। মিসরীয় সময় গণনা পদ্ধতির হাত ধরেই পৃথিবীময় জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা চলতে চলতে মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রিক, ভারতীয় ও আরবীয় জ্যোতির্বিদরা বেশ কয়েকটি বর্ষ গণনা পদ্ধতি বের করেন। আর এভাবেই তৈরি হয় সৌর, চন্দ্র ও নক্ষত্র বর্ষপঞ্জির, তবে নক্ষত্র বর্ষপঞ্জি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সৌর ও চন্দ্র বর্ষ আজ ও বিশ্বব্যাপী সময় গণনার জনপ্রিয় রীতি হিসেবে স্বীকৃত।

পৃথিবীর আর সব দেশের কথা বাদ দিলেও কেবল ভারত বর্ষেই ৩০টি সন বা অব্দের হিসাব খুঁজে পাওয়া যায়, যা ত্রিপুরাব্দ, শকাব্দ, মঙ্গীঅব্দ, বলাব্দ, পালাব্দ, লক্ষণসংবৎ, হর্ষাব্দ, সদরসন, মল্লাব্দ, বিষ্ণপুরী সন, বিশ্ব সিংহ অব্দ, দানিশব্দ, চৈতন্যাব্দ, পরগনতি অব্দ, গুপ্তাব্দ, শঙ্করাব্দ, নসরৎ শাহী অব্দ, হোসেন শাহী অব্দ, সপ্তমী অব্দ, তেলেগু অব্দ, পরশুরামাব্দ, নেয়াব্দ, মারাঠা সুরাব্দ, কালীযুগাব্দ, বিক্রমাব্দ, জালালী সন, সালী বাহন সন, সেকেন্দার সন, বুদ্ধাব্দ, এলাহী সন, হিজরি সন এবং সবশেষে বঙ্গাব্দ। সন বা বর্ষ গণনাগুলো বিভিন্ন রাজন্যবর্গের এবং ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্ষ শুরু বা বর্ষপঞ্জির হিসাব করা হয়েছিল। তবে বঙ্গাব্দ বাদেও খ্রিস্টাব্দ ও হিজরি সন আজো বাংলাদেশসহ সারা ভারতবর্ষে প্রয়োজনীয় এবং জনপ্রিয় সাল হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে।

বঙ্গাব্দ, বাঙালি, বাংলাদেশ শব্দ তিনটি এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত যে একে আলাদা করে ভাবাই যায় না। তবু বঙ্গ সনের ইতিবৃত্ত নিয়ে অনেক তত্ত্ব, যুক্তি-তর্ক ও বিভিন্ন দৃষ্টি কোণ থেকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রকৃত প্রবর্তন এবং তা বর্ষপঞ্জি আকারে প্রচলিত করেন। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণ করার দীর্ঘদিন পর সম্রাটের আদেশে রাজা টোডর মল ভূমি ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার করে ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু চন্দ্রবর্ষ হিজরি এবং সৌরবর্ষ শকাব্দ বর্ষপঞ্জিতে যে দিন ও মাসের ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়, তাতে করে ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়, আইনি ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সে কারণে সম্রাট  আকবর  তার  সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীকে খাজনা আদায়, আইন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে একটি সঠিক ও কাল উপযোগী বর্ষপঞ্জি প্রণয়নের নির্দেশ প্রদান করেন।

তদনুসারে আমীর সিরাজী হিজরি ও শকাব্দের সংমিশ্রণ করে হিজরি সন থেকে ২৬ দিন পিছিয়ে দিয়ে ২৯ বছর আগে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিনকে স্মারক হিসেবে ধরে নিয়ে হিজরি ৯৯২ সনের ৮ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ১০ মার্চ ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সৌরভিত্তিক যে বর্ষ গণনা পদ্ধতি প্রচলন করেন, সেটিই বঙ্গাব্দ নামে আজো বিদ্যমান। কাজেই হিজরিকে বঙ্গাব্দের মা আর শকাব্দকে বঙ্গ সনের অগ্রজ হিসেবে বলা হলে দোষের কিছু আসে না; কারণ আমীর সিরাজী উদ্ভাবিত বঙ্গাব্দ সন প্রণয়নের ফসল ও সৌর পদ্ধতি অবলম্বন করে  বৈশাখকে প্রথম মাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সত্য কিন্তু মূল ভিত্তি ছিল হিজরি সন; কারণ হিজরি ৯৬৩ সনকে বঙ্গাব্দে ৯৬৩ সন ধরেই বর্ষ পরিক্রমা প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে বঙ্গাব্দ হিজরি সনের হাত ধরাধরি করে এদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে এ কারণে যে, ফসল আর ঋতু বৈচিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, অপেক্ষাকৃত নির্ভুল, বিজ্ঞানসম্মত এবং আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খেয়ে চলার সামর্থ্য রাখে। যে কারণে এই সনটি স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় বর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে সেই সঙ্গে হিজরি সনের জনপ্রিয়তায় এতটুকু ঘাটতি পড়েনি।

বাংলা একাডেমি বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে একটি পরিষদ গঠন করে, যার সদস্য ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক এমএ হামিদ, পণ্ডিত শতীশচন্দ্র শিরোমনি জ্যোতিভূষণ, পণ্ডিত তারাপদ ভট্টাচার্য, অবিনাশ চন্দ্র কাব্য জ্যোতিতীর্থ। এই বর্ষপঞ্জি সংস্কার পরিষদ ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা বর্ষপঞ্জিতে পহেলা বৈশাখকে বাংলা বছরের প্রথম দিন ও বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথম মাস এবং ৩৬৫ দিনে এক বছর হিসেবে বাংলা সন এবং সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রচলিত বঙ্গাব্দ অনুসারেই গণনা প্রবর্তনে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। বাংলা সনের ইতিবৃত্ত যা-ই হোক না কেন, ভারতবর্ষে বাংলা সাহিত্য যেমন মুসলমান কবি-সাহিত্যিক ও মুসলিম সুলতানদের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয়ে পূর্ণতার পথে পা বাড়িয়েছিল, ঠিক তেমনি বাংলা সনও মুসলিম খানদানে জন্ম নিয়ে মুসলিম সম্রাটের ছত্রছায়ায় স্থায়িত্বের দিকে চলতে শুরু করে। কালক্রমে বাংলা হিন্দু মুসলিম সবার কাছে সমান প্রিয় হয়ে পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হতে থাকে এবং তারই ধারাবাহিকতায় বৈশাখ হয়ে ওঠে বাঙালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস এবং পহেলা বৈশাখ হয় শুভক্ষণের দিন। সারা বছরের ভাগ্য নির্ণয়ের দিন, খাজনা নেওয়া-দেওয়া, শুভ হালখাতা ইত্যাদি হরেক রকম মেলা, পূজা, ভালো খাওয়া, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার আনুষ্ঠানিক দিন।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশের মানচিত্রে স্থান করে নিল। ছুটির দিন হিসেবে পহেলা বৈশাখ পেল সরকারি মর্যাদা। একাডেমির চেষ্টায় ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে বর্ষ সংস্কার কমিটিতে সুপারিশ বাস্তবায়িত হলো বাংলাদেশের দেয়াল পঞ্জি প্রকাশের মাধ্যমে।

আজ বৈশাখকে কেন্দ্র করে পালিত হয় বৈশাখী মেলা, লাঠি খেলা, পুতুল নাচ, জাদু দেখানো, পালা গান, কবির গান, বলী খেলা, রকমারি অনুষ্ঠান। বাংলার কুলবধূরাও অংশ নেয় পূজা-পার্বণ, সিঁদুরের টিপ, হুলুধ্বনি, মনের আকুলি মেশানো আলপনা আঁকা, রকমারি আয়োজনে মেহমানদারি করার প্রাণের উচ্ছ্বাস। পিছিয়ে থাকে না আদিবাসী গারো, হাজং, মুরং, মগী নরনারীরাও। চৈত্রের শেষ দুদিন, বৈশাখের প্রথম দিন মিলে তিন দিনব্যাপী আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পালন করে বৈশাখী অনুষ্ঠান। বৈশাখ বাঙালির মাস, বৈশাখ বাংলার উৎসবের মাস। বৈশাখ পুরঃনারীর উচ্ছ্বাসের মাস, কবি-সাহিত্যিকদের রুদ্র বৈশাখ। পুরাতনকে বিসর্জন আর নতুনকে স্বাগত জানানোর মাস। বৈশাখ আসুক বাঙালির ঘরে ঘরে আনন্দ আর নব জীবনের উজ্জীবনী প্রেরণা হয়ে অনাদিকাল ধরে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!