• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ হবে ইলিশের নতুন বাজার


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৬, ১১:২৮ এএম
বাংলাদেশ হবে ইলিশের নতুন বাজার

বিশেষ প্রতিনিধি

উৎপাদন বেড়েছে ইলিশের। ১৯৮৬-৮৭ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদন হতো ১ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০১১-১২ সালে সেই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার টন। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলা হচ্ছে, সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ আট মাস যদি জাটকা শিকার বন্ধ রাখা যায় তাহলে ২১ থেকে ২৪ হাজার কোটি নতুন পূর্ণ বয়স্ক ইলিশ পাওয়া যাবে। ইলিশের নতুন বাজার সৃষ্টি সম্ভব হবে বাংলাদেশে। এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৬ সাল থেকে ইলিশ উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণ নির্ণয়ে গবেষকরা বলেছেন, ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার জন্য জাটকা নিধনই দায়ি। পরে জাটকা নিধন বন্ধে শুরু হয় সামাজিক আন্দোলন। ইলিশের উৎপাদন আগের তুলনায় বৃদ্ধি পায়।

সূত্র জানায়, দেশের ১০০টি নদীতে কমবেশি ইলিশ পাওয়া গেলেও ইলিশের প্রজনন ও পরিপক্বতা দক্ষিণাঞ্চলের নদীতেই হয়। এ অঞ্চলের মেঘনা নদীর ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার, ভোলার শাহবাজপুর চ্যানেল, তেঁতুলিয়া নদী, পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ-এই ৫টি চ্যানেলকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে।

১ নভেম্বর থেকে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা আহরণ,পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে জাল উৎপাদনের কারখানাগুলো বন্ধ রাখা, আটক জাল ধ্বংস করা, নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের যথাযথ পুনর্বাসন করা গেলে জাটকা নিধন অনেকটা কমবে।

অক্টোবর ও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিকে ইলিশের প্রজনন মৌসুম ধরা হয়। ইলিশের বাস সাগরে। কিন্তু ডিম ছাড়ার আগে নদীর মিঠাপানিতে আসে। ডিম ছাড়ার সময় হলে দিনে ৭০ থেকে ৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়ায় ইলিশ সাগর থেকে যতই নদীর মিষ্টি পানির দিকে আসে, ততই এর শরীর থেকে লবণ কমে যায়, স্বাদ বাড়ে। একটি মা-ইলিশ সর্বনিম্ন দেড় লাখ ও সর্বোচ্চ ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। পদ্মার ইলিশ স্বাদে সেরা।আবার ভারতের রূপনারায়ণ নদী, গঙ্গা, গোদাবরী নদীর ইলিশ তাদের সুস্বাদু ডিমের জন্য বিখ্যাত। ইলিশ সাগর থেকেও ধরা হয়,কিন্তু সাগরের ইলিশে লবণের পরিমাণ বেশি থাকায় নদীর ইলিশের মতো সুস্বাদু হয় না। পদ্মার ইলিশের খ্যাতি আছে দেশের বাইরেও। চাঁদপুরের ইলিশ বিশ্বসেরা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চাঁদপুরের ইলিশের চাহিদা আকাশচুম্বী। দেশ-বিদেশে চাঁদপুরের মেঘনার রুপালি ইলিশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ শতাংশই বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। ইলিশ উৎপাদনের সফলতা ধরে রাখার জন্য দেশের ১৫টি জেলায় ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২টি জেলে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। ভোলা জেলার মনপুরা, ঢলচর, নোয়াখালী জেলার হাতিয়া কালিরচর ও মৌলভীরচরকে ইলিশের বিশেষ প্রজনন এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৬৮০ টন ইলিশ রফতানির করে আয় হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩ হাজার ১০০ টন ইলিশ রফতানি করে আয় হয় ১২৫ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে সাড়ে আট হাজার টন ইলিশ রফতানির মাধ্যমে আয় হয় ৩৫২ কোটি টাকা।

পাঁচ লাখ জেলে সরাসরি ইলিশ আহরণের সঙ্গে জড়িত। আরও ২০ লাখ লোকের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০০৭ সাল থেকে জাটকা রক্ষায় সরকার পদক্ষেপ নেওয়ার পর ইলিশের উৎপাদন ও বিস্তৃতি বেড়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে আরেকটু নজর দিলে বাংলাদেশের নদীগুলো ইলিশে ভরে উঠবে।

গবেষণা  থেকে জানা যায়, ইলিশে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যা মানুষের দেহের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা ও ইন্সুলিনের মাত্রা কমায়, হৃদরোগ উপশম করে। ইলিশে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ। যার তেলে আছে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু থেকে কার্তিক মাসের শেষ পর্যন্ত সময়কে ইলিশ ধরার মৌসুম বলা হয়। তবে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসকে ইলিশের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘ইলিশ জাতীয় সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষায় সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রয়োজনে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। জাটকা নিধন রোধে সরকার কাঠোর অবস্থানে থাকবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, যেকোনো মূল্যে সরকার নদী থেকে জাটকা ধরা বন্ধ করবে। এ ক্ষেত্রে সরকার সবার সহযোগিতা চায়।’

প্রতিবছরই মানুষের কাছে কদর বাড়ছে ইলিশের। কিন্তু ইলিশ আছে এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশের ইলিশ উৎপাদন কমছে। একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে। মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরতীরের ভারত-মিয়ানমার, আরব সাগরতীরের বাহরাইন-কুয়েত, পশ্চিম মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায়, মেকং অববাহিকার ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া, চীন সাগরের পাশে চীন ও থাইল্যান্ডে ইলিশের বিচরণ কমছে। আর বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।

ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। ভারতে ১৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় বাকি ইলিশ ধরা পড়ে।

বাংলাদেশে নদী ও সাগরে কেনও ইলিশ বাড়ছে তা জানতে ইলিশ আছে এমন দেশগুলোর প্রবল আগ্রহ। বাংলাদেশ ২০০২ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ইলিশের ডিম পাড়া ও বিচরণের স্থানগুলো চিহ্নিত করেছে। সেখানে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ, বছরের আট মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করেছে। ডিম পাড়ার ১৫ দিন সব ধরনের ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে। ইলিশ ধরেন এমন ২ লাখ ২৪ হাজার জেলেকে পরিচয়পত্র দিয়ে তাদের বছরে তিন মাস সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এনেছে সরকার।

বাংলাদেশে ইলিশের আহরণ প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় তো বটেই, বিশ্বের প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের ইলিশ রক্ষার এই কৌশল খুবই কার্যকর বলে চিহ্নিত করেছে। এসব উদ্যোগের ফল হিসেবে গত এক যুগে বাংলাদেশে ইলিশ ধরার পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে বলে মনে করছে তারা।

মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, এসব উদ্যোগের ফল হিসেবে এ বছর উৎপাদন চার লাখ টন হবে। রাজশাহীর পদ্মায় ৫০ বছর পর ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার এই কৌশল অনুসরণ করছে ভারত ও মিয়ানমার। ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী দেশগুলোয়। এ জন্য বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারকে একই সময়ে মা ইলিশ ও জাটকা ইলিশ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। এতে শুধু বাংলাদেশ নয়, এই অঞ্চলের সব দেশে ইলিশের সংখ্যা বাড়বে।

বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল বুঝতে সুদূর কুয়েত ও বাহরাইনের মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের মতোই ওই দেশগুলো ইলিশের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিত করে ডিম ছাড়া ও জাটকা বড় হওয়ার সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখার উদ্যোগ নিয়েছে।

ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের পদ্মা ও মেঘনার মিষ্টি পানির প্রবাহ এখনো ভালো থাকায় এবং প্রয়োজনীয় খাবার থাকায় ইলিশের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ২০০৫ সাল থেকে ইলিশের অভয়ারণ্য করে ইলিশের ডিম ছাড়ার স্থান করে দিয়েছে এবং জাটকা বড় হতে দিচ্ছে।

ভারতের মৎস্য বিভাগের হিসাব মতে, ভারতে ২০১১ সালে সে দেশে ইলিশ ধরা পড়েছিল ৮০ হাজার টন। ২০১৪ সালে তা নেমে এসেছে ১৪ হাজার টনে। আর বাংলাদেশে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ও বঙ্গোপসাগরে ২০০৯-১০-এ ইলিশ ধরা পড়েছিল দুই লাখ টন। ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয় ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। এ বছর জেলেদের জালে চার লাখ টন ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর।

জানা গেছে, বর্ষায় এ দেশের নদীগুলো মা ইলিশে ভরে ওঠে ডিম ছাড়ার জন্য। মোহনা থেকে নদীর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার উজানে ও উপকূল থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত সমুদ্রে ইলিশ পাওয়া যায়।

দেশের মোট মাছের ১২ শতাংশের উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে। যার অর্থমূল্য আনুমানিক সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। উৎপাদিত ইলিশের যেটুকু রপ্তানি হয় তাতে ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। প্রায় পাঁচ লাখ লোক ইলিশ আহরণে সরাসরি নিয়োজিত এবং ২০-২৫ লাখ লোক পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!