• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে কমে আসছে করোনার প্রকোপ


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জুলাই ৭, ২০২০, ০৪:৩৫ পিএম
বাংলাদেশে কমে আসছে করোনার প্রকোপ

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস ট্র্যাকারে সবশেষ পাঁচ দিনের কোভিড-১৯ আক্রান্তের পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলছে, আর এতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে আসতে শুরু করেছে। 

সোমবার (৬ জুলাই) তাদের ট্র্যাকার অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংক্রমণের ১৮তম সপ্তাহে এসে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার দুটিই নিম্নগামী হয়েছে। সংক্রমণের শীর্ষে থাকা বিশ্বের ২০টি দেশের প্রবণতা তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি। 

দেখা গেছে, বাংলাদেশের পাশাপাশি রাশিয়া, চিলি, যুক্তরাজ্য ও মিসরে করোনার প্রকোপ নিম্নমুখী। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, ইরান, কলম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরাক, পাকিস্তান, বলিভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, ইকুয়েডর এবং আর্জেন্টিনায় সংক্রমণের প্রকোপ ঊর্ধ্বমুখী।

জনস হপকিন্সের তথ্যচিত্র অনুযায়ী: বাংলাদেশে কোভিড-১৯’র প্রথম সংক্রমণ ১১৯ দিন আগে মার্চের ৮ তারিখে ধরা পড়ে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ১,৬২,৪১৭ জন করোনায় আক্রান্ত এবং ২,০৫২ জন মারা গেছেন। তাদের তথ্যচিত্র ট্র্যাক করে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে স্থানীয় সংক্রমণের ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭তম সপ্তাহজুড়ে আক্রান্ত ও মৃত্যু সমান্তরালভাবে চূড়ায় ওঠে। ১৮তম সপ্তাহে এসে এ দুটির রেখাচিত্র নিম্নমুখী হতে শুরু করে।

বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিচ্ছে করোনাভাইরাস

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে স্থানীয় সংক্রমণের ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৭তম সপ্তাহজুড়ে আক্রান্ত ও মৃত্যু সমান্তরালভাবে পিকে ওঠে। ১৮তম সপ্তাহে এসে এ দুটির রেখাচিত্র নিম্নমুখী। মাঝে এক দিন মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলেও সাপ্তাহিক হিসাবের গড়ে ঊর্ধ্বমুখী প্রভাব পড়েনি। বরং মৃত্যুহারে দিনে দিনে বাংলাদেশ নিচে নেমে এসেছে। এমনকি গতকাল ৫৫ জনের মৃত্যু হলেও তাতে মোট গড় মৃত্যুহার বাড়েনি, বরং আগের কয়েক দিনের মতোই ১.২৬ শতাংশ ছিল।

ওই তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৪-১৭তম সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২১ হাজার ৩৫৩, ২৪ হাজার ৩০৬, ২৫ হাজার ২০৩ ও ২২ হাজার ৪১৩। চার সপ্তাহে মোট ৯১ হাজার ৩৭৫। যা এ পর্যন্ত মোট সংক্রমণের ৫২.৪২ শতাংশ। অন্যদিকে মৃত্যু ছিল সপ্তাহপ্রতি যথাক্রমে ২৯৩, ২৮৬, ২৭০ ও সর্বোচ্চ ৩০২ জন। আর ১৮তম সপ্তাহে মোট শনাক্ত হয় ২০ হাজার ৬১১ জন। এই সপ্তাহে এসে মৃত্যু কমে আসে ২৫৯ জনে। আগের চার সপ্তাহে মোট মৃত্যু এক হাজার ১৫১ জন, যা এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যুর ৫৬.০৯ শতাংশ।

এসব তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে একমত হয়ে গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অণুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন শীল বলেন, ‘জুনে যে পিক ছিল সেটা আমি তখন থেকেই বলে আসছিলাম। আর এখন তো আমি মনে করছি ঢাকা পিক থেকে নেমে গেছে। অন্য কোনো জেলায় হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে ওঠানামা করবে। পিক থেকে একবার নামলে সেটা আর ওঠে না। অন্য দেশগুলোতে যেটা হচ্ছে সেটা বড় বড় দেশের বিচ্ছিন্ন নানা প্রদেশে আলাদাভাবে ওঠানামা করছে। যা দেখে আমরা মনে করি, ওই দেশে সংক্রমণ বোধ হয় আবার পিকে উঠেছে। কিন্তু কোনো দেশের কোনো একটি শহরে দ্বিতীয়বার আগের মতো সংক্রমণ উঁচুর দিকে ওঠার নজির কিন্তু খুব একটা নেই।’

ড. বিজন শীল আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে জোরালো সংক্রমণের সম্ভাবনা এখন কমে যাবে। যদিও কোরবানির ঈদের প্রভাবে পরে কিছুটা সংক্রমণ বাড়লেও তার গতি দুর্বল থাকবে। কারণ আমাদের দেশে এখন এক ধরনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বেষ্টনী তৈরি হয়েছে, তা সংক্রমণের গতিকে শক্তিশালী হতে দেবে না। আবার দ্বিতীয়বারে কারো আক্রান্ত হওয়ার কথাও ঠিক নয়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছাড়াও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যসূত্র বাংলাদেশের পরিস্থিতি উন্নতির দিকে বলেই ইঙ্গিত করছে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের ১৬০ দেশের মধ্যে জনসংখ্যার (প্রতি ১০ লাখে) তুলনায় বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুহার মাত্র ১.২২ এবং অবস্থান ৯২তম। দুই সপ্তাহ আগে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আরো খারাপ ছিল।

অন্যদিকে শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুহারের সূচকে ওই ১৬০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন রয়েছে ১২৯ নম্বরে (১.২৬ শতাংশ)। যেখানে মৃত্যুহার ২৭ শতাংশ নিয়ে এক নম্বরে রয়েছে ইয়েমেন, ১৫.৮ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে বেলজিয়াম। আর ব্রিটেনের অবস্থান তৃতীয়, দেশটিতে মৃত্যুহার ১৫.৫ শতাংশ। শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুহারের এই তালিকায় ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পেছনে।

অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব আঞ্চলিক ১১ দেশের মধ্যে শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুহারের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পাঁচ নম্বরে। এখানে সর্বোচ্চ মৃত্যু ভারতে। তারপর রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। তবে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে তুলনামূলক ভালো। এ ছাড়া ভুটান ও পূর্ব তিমুরে কোনো মৃত্যু নেই। উত্তর কোরিয়ার তথ্য পায় না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

অবশ্য বিগত পাঁচ দিনের হিসাবে সর্বোচ্চ সংখ্যায় শনাক্তকৃত ২০টি দেশের মধ্যে ১৬তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারত রয়েছে চার নম্বরে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘জুনে আমরা ওপরে ছিলাম। চলতি সপ্তাহে কিছুটা নিচে আছি। কিন্তু এখনই পিক থেকে নেমে যাওয়া বলার মতো অবস্থায় আসেনি। এ জন্য পর পর আরো দুই সপ্তাহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। যদি নিচে নামার ধারা অব্যাহত থাকে তবেই আমরা নিশ্চিত হব যে পিক থেকে নেমে গেছি।’

ওই বিশেষজ্ঞ জোর দিয়ে আরো বলেন, কোরবানির ঈদ ঘিরে যে অবস্থার আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটা যদি প্রতিরোধ করা না যায় তবে নিম্নগামী অবস্থা ঘুরে যেতে পারে। আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে সংক্রমণ আগস্ট নাগাদ ওপরের দিকে উঠে যেতে পারে। সেই পরিণতি রোধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, বেশির ভাগ দেশেই স্থানীয় সংক্রমণ ১০-২০ সপ্তাহের মধ্যে পিকে ওঠে। এ পর্যায়টি টানা তিন থেকে চার সপ্তাহ থাকে। এ সময় আক্রান্ত ও মৃত্যু প্রায় সমান্তরালভাবে ওপরে ওঠে। এরপর কখনো একসঙ্গে নিচে নামতে থাকে, আবার কখনো সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুহার দ্রুত কমে যেতে থাকে। যেমন ভারতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেখানে এখন সংক্রমণের ২১তম সপ্তাহ চলছে। আর ১৪ সপ্তাহ থেকে টানা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছিল। এর মধ্যে ১৯তম সপ্তাহে এসে সেখানে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় এবং আক্রান্ত হয় বেশি।

এরপর ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামে। চলতি সপ্তাহে সেখানে সংক্রমণ বেশি থাকলেও মৃত্যু তুলনামূলক কমে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে চলছে এখন সংক্রমণের ২৫তম সপ্তাহ।

এর মধ্যে ১৪, ১৫, ১৬তম সপ্তাহে সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল। আক্রান্ত তখন প্রথম দফায় চূড়ায় ওঠে। পরে সেখান থেকে নেমে কিছুটা ধীরে এগিয়ে এখন আবার গত দুই সপ্তাহ ধরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

বিভিন্ন সূচক ও অন্যান্য দেশের পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি রেখে দেশের সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বাংলাদেশ গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে মৃত্যুর সূচকে ভালোর দিকে যাচ্ছে। কিন্তু এখন যে পিক থেকে নিচের দিকে সংক্রমণ নেমে যাচ্ছে, এই অবস্থা ধরে রাখার জন্য অবশ্যই সংক্রমণ প্রতিরোধে আরো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে যেকোনো সময় আবার ওপরের দিকে উঠে যেতে পারে।

এই বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো মহামারির সময় প্রতিটি দেশের প্রথম টার্গেট থাকে সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় রাখা। যখন ওই টার্গেট ব্যর্থ হয় অর্থাৎ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যুর গতি আটকে রাখা। যাতে মানুষ সংক্রমিত হলেও মৃত্যুহার কম থাকে এবং সুস্থতার হার বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ এই দ্বিতীয় টার্গেটে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সংক্রমণ যেন আর কোনোভাবেই ঊর্ধ্বমুখী না হয়। বরং কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার আরো নিচের দিকে নামিয়ে আনতে হবে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর বলেন, এ ধরনের মহামারির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভালো-মন্দ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য যে সূচকগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, গত দুই সপ্তাহ ধরে বেশির ভাগ সূচকেই বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে আছে। এর মধ্যে রিপ্রডাকশন হার ৩-এর কাছাকাছি থেকে নেমে এসেছে ১-এর কাছে। শনাক্তের তুলনায় মৃত্যুহার দ্রুত নিচে নেমে গেছে। মোট জনসংখ্যার তুলনায় মৃত্যুহার অনেক কম। ফলে সংক্রমণ বাড়লেও যদি মৃত্যুহার কম থাকে তাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতেই ইতিবাচক বলে ধরতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর

Link copied!