• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
বিতর্কিত সরকার, গচ্ছা যায় জনতার

বার বার বিতর্কেও কাটছে না কর্তাদের বিদেশ বিলাসী ঘোর


এস এম সাব্বির খান সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০, ১০:২৪ এএম
বার বার বিতর্কেও কাটছে না কর্তাদের বিদেশ বিলাসী ঘোর

ঢাকা : প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারির প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জন জীবন, স্তব্ধ হয়ে পড়েছে সাবলীল জীবনযাত্রা। যার সবচেয়ে প্রকট প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে। চরম অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছে প্রতিটি রাষ্ট্র।

জাতিসংঘ থেকে শুরু করে উন্নত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সরকার তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা সম্পৃক্ত বিভিন্ন খাতের ব্যয়ভার কমিয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্যে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। একই পথে হাটছে অন্যান্য দেশগুলোও। চলমান এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মত মাঝারি ও স্বল্প আয়ের রাষ্ট্রগুলোর জন্য।

সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও কার্যক্রমের ব্যয় সংঙ্কুচিত করা ও অতিরিক্ত ব্যয় হ্রাসের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপের আহ্বান জানায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে অন্যতম একটি খাত হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও চলমান পরিস্থিতে বিদেশ সফর খাতে অর্থ ব্যয় হ্রাস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আর সেজন্যেই সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় ও  আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ সকল পর্যায়ের সম্মেলনগুলোই আয়োজিত হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে।

অথচ দেশের করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই সরকার প্রধানের নির্দেশনা আমলে নেয়া তো দূর, উল্টো যেন অবান্তর ও অযৌক্তিক বিদেশ সফরের নামে অর্থ অপচয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন পর্যায়ে কর্তব্যরত কর্তাব্যক্তিগণ। বিস্ময়করভাবে বারংবার প্রশিক্ষন গ্রহণের কথিত নামে তাদের এমন একের পর এক বিদেশ ভ্রমণের আরজি বিতর্ক সৃষ্টি করলেও কর্তাদের আবদারের যেন শেষ নেই।

তাছাড়া সফর কারণ হিসেবে যে সকল হাস্যকর ও উদ্ভট ইস্যু উপস্থাপন করা হচ্ছে সেগুলো বিবেচনা করলেই বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রস্বার্থে নয় বরং জনগণের টাকায় ‘হাওয়া বদলের’ সৌখিন বিদেশ ভ্রমনই একটি আমলাগোষ্ঠির আসল উদ্দেশ্য। তাদের এমন অবান্তর ভ্রমন বিলাসীতার আবদার সরকারের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের মাঝে সমালোচিত হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীদের প্রশ্রয় ঠিকই অব্যাহত রয়েছে।

ফসল উৎপাদন, গরুর প্রজনন, পাবদা মাছ চাষের মত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ইস্যুতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে কর্তব্যরত আমলাদের বিদেশ সফরের আরজি পেশের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘মিড ডে মিল’ চালুর প্রকল্পের জন্য খিচুড়ি রান্না শেখার প্রশিক্ষণ গ্রহণে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ভারত সফর এবং গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের ৩০ জন সরকারি কর্মকর্তার বহুতল ভবন কি করে নির্মিত হয় তা দেখার অভিজ্ঞতা গ্রহণের লক্ষ্যে বিদেশ সফরের পরিকল্পনাসহ মোট ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যয়ের প্রসঙ্গ।

প্রসঙ্গ দুটি সম্পর্কে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে আলোচনায় আলোচনায় উঠে আসে। তবে বিতর্কিত এ সকল বিদেশ যাত্রার কর্মসূচিসহ প্রকল্পসমূহের বিস্তারিত তথ্য খতিয়ে দেখতে এবং অযৌক্তিক ব্যয় অপসারণে তাৎক্ষনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান।
করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকটি বিতর্কিত বিদেশ সফর কর্মসূচীর ব্যাপারে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার প্রেক্ষিতে ভার্চ্যুয়াল কনফারেন্স আয়োজন এবং কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরসহ সকল প্রকল্পের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় রোধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

কিন্তু বিস্ময়করভাবে এত সব জেনেও আমলাদের বিরামহীন বিদেশ সফরের আরজি পেশ চলছেই!

সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রাচীন ইতিহাস বিষয়ক গবেষণা কাজে নিয়োজিত তরুণ বাংলাদেশি ইতিহাস গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বীক মাসুম খান বলেন, সহজ ভাষায় বললে, আধুনিক মানবসভ্যতার উত্থান ঘটে কৃষিকে কেন্দ্র করে। আর কৃষিকাজের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদী কূলের পলি উর্বর ভূমি এবং সেচের পানি সরবরাহের জন্য বিস্তৃত জলের উৎস। পলি উর্বর নদীমাতৃক বাংলাদেশসহ উপমহাদেশীয় অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি সে হিসেবে সবচেয়ে আদর্শ। যা নিঃসন্দেহে এ কথা প্রমাণ করে যে, কৃষিজ উৎকর্ষের মাধ্যমে মানব সভ্যতার উত্থান আমাদেরই হাতে।

সাম্প্রতিক গবেষনাও তাই বলছে। সারাবিশ্বকে যে জাতি কৃষিকাজ শিখিয়েছে, তাদের ফসল আর মাছ চাষ শিখতে অন্যদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করাটাই তো উদ্ভট! আমাদের অধিকাংশই এখনো চাষার ছেলে!

বিশেষজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন নেই, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ এই তত্ত্বই প্রমাণ- মাঠের ফসল আর জলের মাছ যে জাতির নিত্য আহার্যের প্রাচীন সংস্কৃতি, তাদের সে কাজ শিখতে কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশ যাত্রা অবান্তর। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে কর্তব্যরত ব্যক্তিবর্গের অধিকাংশই বিসিএস ক্যাডার অর্থাৎ জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তানেরা। তাদের কাছে এমন কিছু অপ্রত্যাশিত। গুটিকয়েক ব্যক্তির এমন কাজ সামগ্রিকভাবে সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু সংরক্ষণ ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির প্রতি মানবিক দায়িত্বপালনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গণের বিরল সম্মান ও অনন্য স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। এই অর্জনের ক্ষেত্রে করণীয় প্রসঙ্গে প্রশিক্ষন নিতে তিনি কয়বার বিদেশ সফরে গিয়েছেন? করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের মাঝেও তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন।

সর্বনিম্ন সময়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশন বাস্তবায়ন, একটি স্বল্পন্নোত রাষ্ট্রকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা, টেকসই অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে বিশ্বের ক্ষমতাধর বহু রাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে স্বল্পন্নোত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর অনুসরনীয় রোল মডেল আজ, বৈশ্বিক অর্থনীতির প্ল্যাটফর্মে 'সাউথ এশীয়ান টাইগার' খ্যাত আধুনিক বাংলাদেশ।

যে সরকার প্রধানের বিচক্ষণ নেতৃত্ব কোনো প্রকার বহিঃপ্রশিক্ষণ বা কোটি টাকার বিদেশ সফর ছাড়াই নজিরবিহীন এমন সব অর্জনে সফল সেই সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অন্যদেশে না গিয়ে বরং এমন সরকার প্রধানের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়া উচিত, তা সে যেই ক্ষেত্রেই হোক।

অন্যদিকে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের ভবন নির্মানের কাজ দেখার অভিজ্ঞতা অর্জনে কোটি টাকার  বিদেশে সফর প্রসঙ্গে সঙ্গে আলাপকালে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে- বাংলাদেশ সড়ক ও জনপদ বিভাগের সাবেক প্রকৌশলী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আশির দশকে সৌদি সরকারের জেদ্দা-মক্কা-মদীনা হাইওয়ে এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নে গ্রীস ও ব্রিটেনের মত উন্নত বিশ্বের প্রকৌশলীদের সঙ্গে সমান তালে কাজ করেছে তৎকালীন বাংলাদেশ সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রকৌশলী দল। সৌদির আছাককাফ ও সিরিয়ান কোম্পানী আল মোহান্দিস নিজার কুর্দি যৌথভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করে।

হাইওয়ে এক্সপ্রেসের একটি গুরুত্বপূর্ণ টানেল টার্নের অংশে বিদেশি প্রকৌশলীদের স্কেলিং কাজে অনাকাঙ্খিত ভুল রয়েছে বলে আমাদের ধারনা হয়। পরে সেটাই সত্য বলে জানা যায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা তখন আমাদের উদ্দেশ্যে কথার ছলে বলেছিলেন, বাঙ্গালি শেখের (শেখ মুজিবুর রহমান) ডিপ্লোমারা (ইঞ্জিনিয়ার) জাতের লোক। আর ২০২০ সালে আমরা কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশ সফরে যেতে চাইছি ভবন নির্মাণ দেখতে!

বিভিন্ন পর্যায়ের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীনতা সরকারকে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত প্রোপাগাণদা কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। আর দপ্তর থেকে পর্যায়ক্রমে কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ের কাজে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণের নীতিমালা করাও জরুরি।
 
শুধু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর বা গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতর থেকে এ রকম আরও অনেক প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এর কোনোটি অনুমোদন পেয়েছে, আবার কোনোটি বাতিল হয়েছে কিংবা সংশোধন করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা, রান্না শেখা, ধান ও আলু চাষ শেখা, লিফট দেখাসহ বিভিন্ন অজুহাতে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ মূলত সরকারি অর্থের অপচয় আর 'শখের ভ্রমন' প্রকল্প। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে চলমান এই বিদেশী বিদ্যার্জনের বিলাসী স্বপ্ন পূরণে যে অর্থায়নের প্রস্তাবনা সরকারের পরিকল্পনা অধিদপ্তরে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে তার পরিমাণ একনজরে দেখে নিলে বোঝা যায়।

এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের অভিমত, প্রকল্পগুলো যখন পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য যায় কিংবা ক্ষেত্রবিশেষ একনেকে যায় তখনই এগুলো ভালো করে যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত। ক্ষেত্রবিশেষ কোনো কোনো প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণ দরকার আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দরকার নেই। সে প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে। তবে এ প্রবণতা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত।

এর আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে তেলজাতীয় ফসলের চাষ শিখতে ও মৌ পালনে প্রশিক্ষণ নিতে ৪০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানো এবং ৩৬ কর্মকর্তাকে শিক্ষা সফরে পাঠানোর একটি প্রস্তাব যায় পরিকল্পনা কমিশনে। শেষ পর্যন্ত ওই প্রকল্পে বিদেশ সফরে কর্মকর্তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। গরুর প্রজনন দেখতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের একটি প্রস্তাব গত মাসে বাতিল করা হয় তীব্র সমালোচনার মুখে। গরুর প্রজননজ্ঞান অর্জনে এসব কর্মকর্তার চারটি দেশে যাওয়ার কথা ছিল।
যেখানে সরকারের প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় হতো। একইভাবে ফল উৎপাদন শিখতে বিদেশ সফরের জন্যও একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। ‘ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পে’ বিদেশ সফর এবং প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ১০ লাখ টাকা।

গত বছরের আগস্টে পুকুর খনন শিখতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ‘ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নাটোর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১৬ জন কর্মকর্তাকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর একটি প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেয়। ১৬ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ বাবদ বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা। ক‚প খনন শিখতে অন্য আরেকটি প্রকল্পের আওতায় আরও ১৬ কর্মকর্তাকে ইউরোপ বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দেশে পাঠানো হয়।

একইভাবে বাঁধ পুনরুদ্ধার, তীররক্ষা ও নদী-খাল খননের কৌশল শিখতে আমেরিকা-ইংল্যান্ড গিয়েছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের একটি দল। যাদের তিনজনই অবসরে গেছেন যথাক্রমে ২০ দিন, পাঁচ মাস ও এক বছরের মধ্যে। এর মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবও ছিলেন।

মৌমাছির চাষ বাড়িয়ে মধু উৎপাদন বাড়াতে ইউরোপ গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে চান কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৩০ কর্মকর্তা। আরও ১০০ কর্মকর্তা ইউরোপ যেতে চান শিক্ষা সফরে। সফরকালে শুধু মধু চাষ দেখাই নয়, তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর জ্ঞান অর্জন করবেন তারা। জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে এই ১৩০ কর্মকর্তার ইউরোপ ভ্রমণে ব্যয় হবে সাড়ে ৬ কোটি টাকা।

অপর এক প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রের তথ্য মতে জানা যায়, সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৪৯৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন বাড়ানোর এই প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বিভিন্ন খাতে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে জানিয়ে তা কমাতে বলেছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। যেনতেন কাজে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাবের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন তারা।

প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ৪৪৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) ২০ কোটি ৪৪ লাখ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ১৫ কোটি ২১ লাখ ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বিভিন্ন খাতে ব্যয় করবে।

প্রস্তাবের ওপর সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে চলতি বছরের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন নাগাদ। এই অর্থ দিয়ে দেশের ৬৪ জেলার ৪৭৬টি উপজেলায় ক্রপিং প্যাটার্নভিত্তিক ৯০ হাজার ১৪০টি প্রদর্শনী স্থাপন, ২৬ হাজার ৭২০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ, ৬ হাজার ৫৭০ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ, ২১ হাজার ৬০০টি কৃষক মাঠ দিবস প্রশিক্ষণ, ১০০ কর্মকর্তার শিক্ষা সফর, ৩০ কর্মকর্তার মধু চাষবিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ, ৫টি জাতীয় ও ৭০ আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ, বিএডিসির বীজ গুদাম মেরামত, ৭৮টি গাড়ি বা যানবাহন ক্রয়, বিভিন্ন তেলবীজ বিতরণ ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা হবে।

অবসরের আগে বিদেশে প্রশিক্ষণে আপত্তি জানিয়েছে সংসদীয় কমিটি। কমিটির অভিমত, বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে কর্মক্ষেত্রে তা প্রয়োগের আগেই অনেক সরকারি কর্মকর্তা অবসরে চলে যান। এজন্য অবসরে যাওয়ার অন্তত চার বছর আগে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানোর শর্ত যুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। বিদেশি প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগানোর জন্য মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে একজন সদস্য বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়টি উত্থাপন করে বলেন, মাটি কাটা, পুকুর খনন দেখার মতো বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতেও বিদেশ যাচ্ছেন কর্মকর্তারা। আবার এমন কর্মকর্তাও সরকারি টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণে যাচ্ছেন, যারা কিছুদিন পরই অবসরে যাবেন।

ফলে এ প্রশিক্ষণ দেশের কোনো কাজে লাগে না। আমরা সংসদীয় কমিটির এ সুপারিশকে স্বাগত জানাই এবং আশা করতে চাই- সরকারি অর্থের অপচয় বন্ধে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে তামাশা বন্ধ হবে। দেশবাসীর ট্যাক্সের টাকার অপচয় রোধে বিদেশে যারা প্রশিক্ষণ নেবেন তাদের অভিজ্ঞতা যাতে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়েও নজর রাখা উচিত।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক প্রবীন নেতৃবৃন্দের ভাষ্য মতে, আমলতন্ত্রের বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ড একদিকে যেমন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রতি সাধারণের অনাস্থা সৃষ্টি করে তেমনি সরকারকেও করে বিতর্কিত।

এর ফলে সরকার-প্রশাসন সম্পর্কে অদৃশ্য দূরত্ব সৃষ্টি হয় যার ফায়দা লুটে তৃতীয় পক্ষ। এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রস্বার্থ  সঙ্গে  সরকার ব্যবস্থা পরিচালনায় নিয়োজিতদের দুটি স্বকীয় কিন্তু পৃথক পরিচিতি থাকে। পরিচালনাকারীদের দুইটি সত্ত্বা আলু চাষ দেখতে ইউরোপে যাচ্ছেন ৪০ কর্মকর্তা।

পুকুর খনন শিক্ষা গ্রহণে বিদেশ সফর,’ ‘নলকূপ খনন প্রশিক্ষণে একাধিক কর্মকর্তার বিদেশ সফর, একটি ক্যামেরা কিনতে তিনজনের বিদেশ ভ্রমণ, লিফট ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফর, নিরাপদ পানি সংরক্ষণ প্রক্রিয়া প্রশিক্ষণে উগান্ডা গমন’ ইত্যাদি অনেক সফরের কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। এবার শুনতে হল ‘এসির বাতাস খেতে কর্মকর্তার মালয়েশিয়া গমন!

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করতে ৮ কর্মকর্তার ইউরোপ-আমেরিকা সফরের কথা উল্লেখ করা যায়। ২০, ২২, ২৫ তলার আবাসিক ভবন নির্মাণের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সফরের খবর জানা যায়। এ শিক্ষা সফরের কাফেলায় শামিল ছিলেন মন্ত্রণালয়ের চার কর্মকর্তা ও সিডিএ’র চার প্রকৌশলী।

এ চারজন প্রকৌশলীর মধ্যে ৩ জনই ছিলেন অর্থ চুরির দায়ে দুদকের মামলার আসামি। আশ্চর্যের বিষয়, মন্ত্রণালয়ের যে চারজন কর্মকর্তা সফরকারী দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তারা কেউই ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। এটি সবারই জানা, দেশের বড় বড় প্রকল্পে সরকারের কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা থাকে; কিন্তু দেখা গেছে, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো ভূমিকা নেই, এমন কর্মকর্তারাও কোনো যুক্তি ছাড়াই বিদেশ সফরে শামিল হয়ে যান।

চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে সিডিএ স্কয়ার নামে ২০, ২২ ও ২৫ তলার তিনটি আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। বহুতল এই ভবন নির্মাণের জন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইতালি যাচ্ছেন আট কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই ‘শিক্ষাসফরের’ জন্য প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭ লাখ টাকা। ‘ভাগ্যবান’ এই আট কর্মকর্তার মধ্যে চার কর্মকর্তা দুই মন্ত্রণালয়ের। বাকি চারজন সিডিএর প্রকৌশলী। এই চারজনের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা চলছে। মন্ত্রণালয়ের চার কর্মকর্তাসহ এই তিনজন প্রকল্পটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টও নন।

অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিসের সব শেষ তথ্য মতে, বিশ্বে নিরাপদ ও কম অপরাধপ্রবণ দেশ হিসেবে ১৫০টি দেশের মধ্যে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডার অবস্থান ৬ নম্বরে। অথচ সেই নিরাপদ ও কম অপরাধপ্রবণ দেশে কারাগারে বন্দিরা কিভাবে জীবনযাপন করেন এবং সেখানকার কারাগারগুলোর ব্যবস্থাপনা কেমন তা দেখতে ১৩ জন সরকারি কর্মকর্তা দেশটি সফরে যাবেন। উদ্দেশ্য সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে এ দেশে কাজে লাগানো। শুধু কানাডাই নয়; কম অপরাধপ্রবণ দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান যেখানে বিশ্বে ১৩ নম্বরে, সেই দেশটিতেও যাবেন সরকারি কর্মকর্তারা। ‘দেশের সকল কারাগারে স্বজন লিংক স্থাপন’ শিরোনামের একটি প্রকল্পের (এ প্রকল্পের আওতায় বন্দিরা মোবাইল বুথ ব্যবহার করে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবেন) আওতায় কর্মকর্তারা ওই দেশ দুটিতে সফরে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।

আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার ভাষ্য মতে, ২০১৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছিলেন সামান্য কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী।

মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, প্রকল্পের অজুহাতে সরকারি কর্মকর্তারা যেন ‘অহেতুক’ বিদেশ সফর না করেন, সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বারংবার সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিতর্কিত বিদেশ সফরের ইস্যুতে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে একটি গোষ্ঠি। এখনই সময় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এই অপ্রত্যাশিত সমস্যার স্থাইয়ী সমাধান নিশ্চিত করা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!