• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
ক্ষমতা থাকলেও আইন প্রয়োগে আগ্রহ নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

বাড়ছে অনিয়ম দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণ


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ১২, ২০১৮, ০৭:৫৭ পিএম
বাড়ছে অনিয়ম দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণ

ঢাকা : আইনে ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে প্রয়োগে আগ্রহ নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের। ফলে বার বার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে সংস্থার স্বায়ত্তশাসন নিয়ে। ফলে ব্যাংক খাতের সার্বিক সুশাসন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বাড়ছে অনিয়ম, দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রশ্নে চোখ বন্ধ করে রাখলে পুরো খাত কুক্ষিগত হয়ে পড়বে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনে যেটুকু ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে দেওয়া হয়েছে সেটুকু শক্তভাবে প্রয়োগ করলে এ খাতের এত নাজুক পরিস্থিতি হতো না।

১৯৯১ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন প্রণয়ন করে সরকার। এরপর কয়েক দফা আইনের সংশোধনী আনা হয়েছে। আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে কার্যরত সকল ব্যাংক-কোম্পানিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক, সময়ে সময়ে, নির্ধারিত পরিমাণে, হারে ও পন্থায় মূলধন সংরক্ষণ করিতে হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহিত পরামর্শক্রমে বিশেষায়িত ব্যাংসমূহকে এই ধারার বিধান হইতে অব্যাহতি দিতে পারিবে।’

আইনে আরো বলা আছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, কোন ব্যাংক-কোম্পানি উপ-ধারা (১) মোতাবেক আবশ্যক পরিমাণে, হারে ও পন্থায় মূলধন সংরক্ষণ করিতে ব্যর্থ হইয়াছে তাহা হইলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানিকে অনধিক এক বৎসরের মধ্যে উক্ত ঘাটতি পূরণের নির্দেশ দিতে পারিবে এবং এইরূপ নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ব্যর্থতা অব্যাহত থাকিলে উক্ত ব্যাংক-কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আইনে নির্দিষ্ট মেয়াদে বা অনুরূপ ঘাটতি পূরণের পূর্ব পর্যন্ত উক্ত ব্যাংক কর্তৃক নতুন আমানত গ্রহণ নিষিদ্ধ করা; নির্দিষ্ট মেয়াদে বা অনুরূপ ঘাটতি পূরণের পূর্ব পর্যন্ত উক্ত ব্যাংক কর্তৃক নতুন ঋণ ও অগ্রিম প্রদান নিষিদ্ধ করার কথা বলা আছে।’

এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য সর্বনিম্ন বিশ লক্ষ টাকা হইতে অনূর্ধ্ব এক কোটি টাকা জরিমানা আরোপ এবং যদি উক্ত লঙ্ঘন অব্যাহত থাকে, তাহা হইলে উক্ত লঙ্ঘনের প্রথম দিনের পর প্রত্যেক দিনের জন্য অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার পর মূলধন ঘাটতিতে থাকা কোন ব্যাংকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। দুই বছর আগে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলেও তাতে সায় দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

সূত্রগুলো বলছে, ফলে মূলধন ঘাটতিতে থাকলেও এটি নিয়ে ব্যাংকগুলো আর উদ্বিগ্ন নয়। বিষয়টি এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকগুলোর ধারণা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো শক্ত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে। যার সাতটি ব্যাংক হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১০ ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা খেয়ে ফেলেছে। মার্চ পর্যন্ত এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। পরের তিন মাসে অর্থাৎ জুন পর্যন্ত ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ কমাতে কৌশল হিসেবে পুনঃতফসিল করতে হচ্ছে প্রচুর ঋণ। কিন্তু তারপরও কমছে না ব্যাংক খাতের রক্তক্ষরণ। লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। ফলে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না অনেক ব্যাংক।

২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত গত পাঁচ অর্থবছরে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা দিয়েছে। তবে গত অর্থবছরে রূপালী ও বেসিক ব্যাংক যেহেতু সিআরআর রক্ষা করতে পারেনি তাই তাদের কোনো মূলধন জোগান দেওয়া হয়নি। গত অর্থবছরে জনগণের করের টাকা থেকে এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকা মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংকের জবাবদিহিতা ও দক্ষতা না বাড়িয়ে জনগণের করের টাকায় বার বার মূলধন জোগান নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ৬ ব্যাংকের পাঁচটিই মূলধন ঘাটতিতে। এই খাতের ব্যাংকের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড মূলধন ঘাটতিতে নেই। ব্যাংকটির ৬৬৭ কোটি টাকা মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে। তবে বাকি ৫টির মূলধন ঘাটতি ১৪ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি এক হাজার ৪১৯ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের এক হাজার ২৯৩ কোটি টাকা ঘাটতি। আর সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৬ হাজার ৬০১ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবার সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড মূলধন ঘাটতিতে এসেছে প্রথমবার। ব্যাংকটির ৪৫ কোটি টাকা মূলধন নেই। গত বছর ব্যাংকটিতে বড় পরিবর্তন আসে।

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড অবশ্য আগে থেকেই মূলধন ঘাটতিতে। তবে ঘাটতির পরিমাণ বাড়ছে। জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০১ কোটি টাকা। আর আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এক হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। হিসাব মতে, বেসরকারি তিন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৭১ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর দুটিই মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক মূলধন খেয়ে ফেলেছে ৮ হাজার ৯ কোটি টাকা। আর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন নেই ৬৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মূলধন নেই ৮ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা।

কার্যক্রম শুরুর মাত্র চার বছরের মাথায় সঙ্কটে পড়া ফারমার্স ব্যাংক ৩০২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়ে মার্চ শেষে। গত ডিসেম্বরে ঘাটতি ছিল ২৯০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের উদ্যোগে ব্যাংকটিতে বড় অঙ্কের মূলধন জোগান দেওয়া হয়েছে। ফলে ঘাটতি থেকে বেরিয়ে এখন ৬১৯ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত হয়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির কারণ ব্যাংক পরিচালনায় সুশাসন ও দক্ষতার ঘাটতি। কিন্তু এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্ত ভূমিকা নিতে পারে। সেটিও হয় না। বরং সরকার করের টাকা থাকা বার বার মূলধন জোগান দিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আইনে দেওয়া ক্ষমতা এক-দুটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে অন্য ব্যাংকগুলো সুশাসনের দিকে মনোযোগী হবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আইন প্রয়োগে অনাগ্রহ দেখানোর কোন কারণ নেই। আমরা অনিয়ম করায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যাংককে জরিমানা করেছি। এমডিদের অপসারণ করেছি। পরিচালকদের অপসারণ করেছি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে চিঠি দিয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!