• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
নাগরিকত্ব আইন

বিক্ষোভে উত্তাল ভারত


আন্তর্জাতিক ডেস্ক ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯, ০১:০৯ পিএম
বিক্ষোভে উত্তাল ভারত

ঢাকা : অমুসলিমদের নাগরিকত্ব প্রদানে পাস হওয়া আইন নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারত। সহিংসতায় এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে পাঁচজন। আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুর, পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়ে কারফিউ জারিসহ মোতায়েন করা হয়েছে সেনা। ভারত সফর বাতিল করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রীসহ বাংলাদেশের দুই মন্ত্রী।

এছাড়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অস্থিরতায় ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে

 ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা ও ফ্রান্স। খবর, এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা ও বিবিসি।

প্রয়োজন ছাড়া ওই সব এলাকায় না যেতে নাগরিকদের পরামর্শ দিয়েছে দেশ চারটি। ভারতে অবস্থানরত নাগরিকদের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা এবং গণমাধ্যমের খবর অনুসরণেরও পরামর্শ দিয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তাদের আসাম ভ্রমণে স্থগিতাদেশ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কানাডা এবং ফ্রান্সও নাগরিকদের অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছে।

অন্যদিকে ভারতের ছয় মুখ্যমন্ত্রী বিতর্কিত আইনটি না মানার ঘোষণা দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের পর দিল্লি, পঞ্জাব, ছত্তিসগড়, কেরালা ও মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা বিজেপি সরকারের বিতর্কিত এ নাগরিকত্ব প্রদানসংক্রান্ত আইন কোনোভাবে তাদের রাজ্যে প্রয়োগ করতে দেবেন না বলে হুমকি দিয়েছেন। এমনকি মহারাষ্ট্রে শিবসেনা সরকারের শরিক কংগ্রেসের এক মন্ত্রীও আইনটি রাজ্যে প্রয়োগ করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেন। তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া এবং কংগ্রেসশাসিত রাজ্যগুলো থেকে একযোগে প্রতিবাদের ডাক ওঠায় শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এটি একটি কেন্দ্রীয় আইন। তাই এটি সব রাজ্যেই প্রযোজ্য হবে। কোনো রাজ্য সরকারের তা আটকানোর অধিকার নেই।

এদিকে ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেস বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল নিয়ে উত্তাল ভারতে আরো উত্তাপ ছড়াতে দিল্লির রামলীলা ময়দানে ভারত বাঁচাও সমাবেশ করে। এ সমাবেশে উপস্থিত ছিলো হাজারো সমর্থক। সমাবেশে একই মঞ্চে হাজির হন কংগ্রেসের অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি সোনিয়া গান্ধী, সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী ও সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র।

সমাবেশে কংগ্রেস নেতারা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের সমালোচনা করেন। তারা দেশের অর্থনীতি ও নারী সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন। সোনিয়া গান্ধী বলেন, নাগরিকত্ব বিল ভারতের হূদয় ছিন্নভিন্ন করবে। অথচ তা নিয়ে মোদি-অমিত শাহের কিছু যায় আসে না। ভারতকে বাঁচাতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে আন্দোলনে নামার আহ্বান জানান। বলেন, অবস্থা এখন এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তারা চাইলেই একটি ধারা জারি করতে পারে, বাতিল করতে পারে এবং ইচ্ছে হলেই রাজ্যের প্রকৃতি পাল্টে ফেলে। যেখানে ইচ্ছে সেখানেই রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা জারি করছে। বিল পাস করছে বিতর্ক ছাড়াই।

রাহুল গান্ধী নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনা করে বলেন, এর মধ্য দিয়ে মোদি উত্তর-পূর্ব ভারতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। ধর্ষণ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে বিজেপি তাকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানের প্রতিক্রিয়ায়  বলেন, আমার নাম রাহুল সাবারকার নয়, রাহুল গান্ধী। সত্য বলার জন্য কখনো ক্ষমা চাইব না। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেছেন, দেশের চলমান অবিচারের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করবে না, তারা ভীতু। ভারত অহিংসা ও ভ্রাতৃত্বের দেশ। আপনারা যদি আতঙ্ক ও মিথ্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার না হন তাহলে সংবিধান ধ্বংস হয়ে যাবে।

বিক্ষোভ সবচেয়ে বেশি উত্তাল আসাম। নিহত পাঁচজনের সবাই ওই রাজ্যটির। শুক্রবার থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের আরেক রাজ্য মেঘালয়ও উত্তাল হয়ে ওঠে। শিলংয়েও কারফিউ জারি করা হয়েছে। বিতর্কিত ওই নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে উত্তাল ভারতের উত্তর-পূর্বের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে।

ওই রাজ্যগুলোর মানুষ আবার কবে নাগাদ ইন্টারনেট সংযোগ ফিরে পেতে পারেন, সে বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে, খবর ও তথ্য পেতে সহযোগিতা করে এমন মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার নজির অনেক দেশেই দেখা গেছে, তবে ভারত সবার চেয়ে এগিয়ে। এর আগে ভারত শাসিত কাশ্মীরে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল দেশটি। চার মাস পার হলেও এখনো ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে রয়েছেন দেশটির ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইন্টারনেট বাজার হিসেবে পরিচিত ভারতে বর্তমানে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬৫ কোটির বেশি। এভাবে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখার বিষয়ে অতীতে নিন্দা জানিয়েছিল জাতিসংঘ। বিষয়টিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিল সংস্থাটি।

শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে মেঘালয়ে ১২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নিলে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে রাজ্য ভবনের কাছে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়লে সংঘর্ষ বেধে যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ অন্যান্য মন্ত্রীর আশ্বাস-অনুরোধ সত্ত্বেও আসামে আগুন জ্বলছে। বিক্ষোভ সামাল দিতে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। জারি করা হয়েছে কারফিউ। কিন্তু সবকিছু অগ্রাহ্য করে রাজ্যটির হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমেছে। আগুন জ্বেলে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আইনের প্রতিবাদ জানাচ্ছে তারা।

আসামে ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখ এক এমপির বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে চারটি রেলস্টেশন ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের একটি কার্যালয়। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছেন পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। পাঁচজন নিহত হওয়ার ছাড়াও আহত হয়েছেন আরো অনেকে।

মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে পুলিশ প্রতিবাদকারীদের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। বিক্ষোভকারীরা বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকায় ভাঙচুর চালিয়েছেন বলেও খবরে জানানো হয়েছে। বিক্ষোভ চলছে ত্রিপুরা আর মণিপুরেও। আসামের পুলিশ প্রধান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত এক হাজার বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে।

বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। জেলায় জেলায় রেল-সড়ক অবরোধ করা হয়েছে। ভাঙচুর ও গাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু হলে জনগণকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার সে আহ্বান কোনো কাজে আসেনি। শনিবার সকাল থেকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যজুড়ে।

আইনের বিরোধিতায় কলকাতা, হাওড়া, মুর্শিদাবাদ, বহরমপুরসহ বিভিন্ন স্থানে রেললাইন ও জাতীয় সড়ক অবরোধ করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। হাওড়া থেকে দক্ষিণ ভারতগামী দূরপাল্লার ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফেরার পথেও আটকে আছে একাধিক দূরপাল্লার ট্রেন। স্থানীয় ট্রেন চলাচলও বন্ধ। রেললাইনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। পাথর ছুড়ে হামলা চালানো হচ্ছে আটকে থাকা ট্রেনগুলোতে।

শুক্রবার দিল্লিতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পার্লামেন্ট ভবন অভিমুখে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা শুক্রবার দুপুরে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে বাইরে বের হতে চাইলে পুলিশের তাতে বাধা দিয়ে ৫০ শিক্ষার্থীকে আটক করে।

প্রসঙ্গত, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনে গত সোমবার ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় একটি বিল (সিএবি) উত্থাপন করনে অমিত শাহ। ব্যাপক বিতর্কের পর সেদিন মধ্যরাতে বিলটি পাস হয়। এরপর গত বুধবার রাজ্যসভাতেও বিলটি পাসের পর রাষ্ট্রপতি বৃহস্পতিবার স্বাক্ষর করায় সেটি এখন আইন।

নতুন এ আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১৫ সালের আগে প্রতিবেশী পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে যেসব অমুসলিম (হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসি ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা) ভারতে গেছেন তাদেরকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!