• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিনম্র শ্রদ্ধা হে গিটারের জাদুকর


বিনোদন প্রতিবেদক অক্টোবর ১৮, ২০২০, ০৩:৩৮ পিএম
বিনম্র শ্রদ্ধা হে গিটারের জাদুকর

ঢাকা : বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীত ও গিটারের কিংবদন্তি তারকা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। যিনি তরুণ প্রজন্মের এলআরবি। দেশীয় ব্যান্ডসংগীতের তিনি মধ্যমণি। এলআরবির পথ চলার ২৭ বছরে শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান।

আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম হয় চট্টগ্রামে। তিনি ১৬ আগস্ট ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম রবিন। পরিবারের তেমন কেউ গানের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ঝোঁক। আধুনিক-লোকগীতি-ক্ল্যাসিক্যালের পাশাপাশি শুনতেন প্রচুর ওয়েস্টার্ন গান। নিজেও একসময় গাইতে চেষ্টা করেন। স্কুলে পড়াকালীন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আর তখন থেকেই ওয়েস্টার্ন মিউজিক ভালো লাগতে শুরু করে। শুরু করেন গিটার চর্চা। জিমি হেন্ডরিক্স, জো স্যাটরিনি, স্টিভ মুর হয়ে উঠেন তার অনুপ্রেরণার উৎস। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে একটা ব্যান্ডদল গঠন করেন। প্রথমে ব্যান্ডের নাম রাখা হয় ‘গোল্ডেন বয়েজ’, পরে নাম পাল্টিয়ে রাখা হয় ‘আগলি বয়েজ’। বিয়েবাড়ি, জন্মদিন আর ছোটখাট নানা অনুষ্ঠানে এই ব্যান্ডদল নিয়ে গান করতেন বাচ্চু।

স্কুল-কলেজের ছেলেমানুষি ভুলে বন্ধুরা যে যার মতো একেক দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু মিউজিক নিয়েই থাকলেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে ‘ফিলিংস’ নামের একটি ব্যান্ডে গান করতেন। ফিলিংসের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চু জড়িত ছিলেন কিছুদিন। ১৯৮০ সালে যোগ দেন ‘সোলস’ ব্যান্ডে। সোলসের লিডগিটার বাজানোর দায়িত্বে ছিলেন টানা ১০ বছর। ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল গড়ে তুললেন নতুন ব্যান্ড এলআরবি।

মজার ব্যাপার হলো, এলআরবি দিয়ে শুরুতে বোঝানো হয়েছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। কিন্তু কিছুদিন পর এক প্রবাসী বন্ধু জানান এই নামে অস্ট্রেলিয়ায় একটি ব্যান্ড আছে। তাই প্রয়োজন হয় দলের নাম পাল্টাবার। এলআরবি আদ্যাক্ষর ঠিক রেখে ব্যান্ডের নতুন নাম রাখা হয় ‘লাভ রানস বাইন্ড’। শুরুতেই এলআরবি চমক সৃষ্টি করে ডবলস ডেব্যু অ্যালবাম বের করার মধ্য দিয়ে। ‘এলআরবি- ১ ও ২’ নামের এই ডবলসের পর একে একে এপর্যন্ত ব্যান্ডের আরো ১০টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৮ সালে বের হয়েছিল সর্বশেষ অ্যালবাম ‘স্পর্শ’।

এলআরবিকে বেশি সরব দেখা গেছে দেশ-বিদেশের কনসার্টে। যে কোনো স্টেজ শোতে অংশ নেওয়ার আগে আইয়ুব বাচ্চু পুরো দল নিয়ে প্র্যাকটিস করতে কখনো ভুল করতেন না। সারাদিন সময় না পেলে মধ্যরাতে হলেও তিনি প্র্যাকটিস করতেন। ইউরোপ-আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশের কনসার্টে এলআরবি পারফর্ম করেছে। অংশ নিয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি কনসার্টে।

গানের পাশাপাশি গিটারেও তিনি ছিলেন অনন্য। ১৯৭৫ সালের কথা। সবে ক্লাস সেভেনে ওঠেছেন। পরীক্ষার ফল খুব ভালো হওয়ায় বাবাও তার ওপর বেজায় খুশি। তিনি একটি কালো রঙের গিটার উপহার দিলেন। শুরু হলো লেখাপড়ার পাশাপাশি জীবনের নতুন একটি অধ্যায়। তারপর দীর্ঘ সময় এই গিটার ও গানের সঙ্গেই তার বসবাস।

তার কণ্ঠ দেয়া প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। এটির কথা লিখেছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি ‘সোলস’ ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। এই অ্যালবামটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি।

আইয়ুব বাচ্চুর সফলতার শুরু তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ (১৯৮৮) দিয়ে। এরপর ১৯৯১ সালে বাচ্চু ‘এলআরবি’ ব্যান্ড গঠন করেন। এই ব্যান্ডের সঙ্গে তার প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম ‘সুখ’ ও ‘তবুও’ বের হয়। ‘সুখ’ অ্যালবামের ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রূপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ পুরো দেশে আলোড়ন তৈরি করে। এর মধ্যে ‘চলো বদলে যাই’ গানটি বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় গান। গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই। ১৯৯৫ সালে তিনি বের করেন তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। সর্বকালের সেরা একক অ্যালবামের একটি বলে অভিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হূদয়’, ও ‘আমিও মানুষ’। একই বছর তার চতুর্থ ব্যান্ড অ্যালবাম ‘ঘুমন্ত শহরে’ প্রকাশিত হয়। সেটিও সাফল্য পায়। আইয়ুব বাচ্চুর সর্বশেষ তথা ১০ম অ্যালবাম ‘জীবনের গল্প’ প্রকাশ হয় ২০১৫ সালে।

আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া কিছু গান এখনো সমানভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘আমি বারো মাস তোমায় ভালোবাসি’, ‘সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘এক আকাশের তারা তুই’, ‘উড়াল দেবো আকাশে’ উল্লেখযোগ্য।

শুধু অডিও গানে নয়, প্লেব্যাকেও তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তার গাওয়া প্রথম প্লেব্যাক ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গান। এছাড়া ‘আম্মাজান’ সিনেমার শিরোনাম গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রখ্যাত এই শিল্পীর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

আইয়ুব বাচ্চুর গান নিয়ে সরকারের উদ্যোগ : দেশের কিংবদন্তি গিটারিস্ট ও ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার শোক আজও বয়ে বেড়ান তার ভক্ত-অনুরাগীরা। তবে তাদের জন্য দারুণ এক খবর রয়েছে। প্রিয় শিল্পীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন জানা গেল আইয়ুব বাচ্চুর গান সরকারিভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কপিরাইট রেজিস্টার জাফর রাজা চৌধুরী। এর মধ্যদিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর গান সংরক্ষণ করা হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে। বিষয়টিকে সংগীতের মানুষেরা সাধুবাদ জানিয়েছেন।

রেজিস্টার জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের উদ্যোগে আইয়ুব বাচ্চু স্মরণে একটি ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে। এখানে প্রাথমিকভাবে উনার ২৭২টি গান সংরক্ষিত আছে। পাশাপাশি আইয়ুব বাচ্চুর নামে ইউটিউব চ্যানেলও খোলা হয়েছে।

কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং তার গানকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জিইয়ে রাখতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রথম কপিরাইট অফিসের উদ্যোগে এমন আয়োজন করা হলো। আমরা আইয়ুব বাচ্চুর নানা স্মৃতি, গান রক্ষার উদ্যোগ নিয়েছি।’

জানা গেছে, ভবিষ্যতে আরো অন্যান্য কিংবদন্তি শিল্পীদের গান সংরক্ষণের পরিকল্পনাও করছে সরকার।

এবির স্মরণে তারকারা

গায়ক আসিফ : এবি সম্পর্কে আসিফ বললেন, ‘বাচ্চু ভাইকে নিয়ে কী বলবো? কী লিখবো? এতো স্মৃতি সারাজীবন বললেও শেষ হবে না। খানিকটা চুপ থাকার পর আবার শুরু করলেন। ১৯৯৫ সালে একটি ব্যান্ডদল গড়েছিলেন। তখন এলআরবি অর্থ ছিল লিটল রিভার ব্যান্ড। পরে নাম পরিবর্তন করা হয়। সেই লিটল রিভার নামটাই আমাকে খুব টানে। আমাদের ব্যান্ড-এর নাম রাখি ফিকেল বয়েজ ব্যান্ড। বাচ্চু ভাইয়ের এলআরবি আর আমাদের এফবিবি।

অবশেষে ১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমিতে আমাদের ব্যান্ডের অভিষেক হয়। তখন কনসার্টে এলআরবি, উইনিংসহ অন্যান্য ব্যান্ডের গান কাভার করতাম। এমনো হয়েছে আমি গান গাইছি অন্যদিকে বাচ্চু ভাই ড্রামস বাজাচ্ছেন। আমি বলতাম বাচ্চু ভাই আপনার গান গাইবো। তখন তিনি বলতেন, আমার লিস্টেরগুলো বাদ দিয়ে গা। বলছিলেন আসিফ আকবর।

১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হলে বাচ্চু ভাই আমার সঙ্গে বাজিয়েছিলেন। এরপর অনেকবার একসঙ্গে শো করেছি। তখন আমি আজকের আসিফ ছিলাম না।

২০০১ সালে আমার ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ অ্যালবাম প্রকাশের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশ-বিদেশে বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে শো করেছি। অনেক ভালো মনের মানুষ ছিলেন বাচ্চু ভাই। আমার সঙ্গে টম অ্যান্ড জেরির মতো সম্পর্ক ছিল। এই ভালো এই খারাপ। ইন্ডাস্ট্রিতে আমিই মনে হয় তাকে সবচেয়ে বেশি জ্বালিয়েছি। কোনো কিছু হলেই বাচ্চু ভাই এইটা করলেন কেন ওইটা করলেন কেন?

ভাই বলতেন, আসিফ গোস্বা (রাগ) করিস না ভাই। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবার পথে ভাই সব সময় আমার আম্মার সঙ্গে দেখা করতেন। আমাকে বলতেনও না। আম্মা পরে আমাকে জানাতেন, তোর ভাই এসেছিল। কোন ভাই জিজ্ঞেস করতেই তিনি বাচ্চু ভাইয়ের কথা বলতেন।

আসিফ আকবর বলেন, এই নীল মনিহার কিংবা আবার এলো যে সন্ধ্যায় গানগুলো আমরা যেভাবে বাঁচিয়ে রেখেছি। ঠিক তেমনিভাবে বাচ্চু ভাইয়ের গানও আমরা বাঁচিয়ে রাখবো। তার গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে তার গান গাইবার চেষ্টা করবো।’

কুমার বিশ্বজিৎ : কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘দেখতে দেখতে বাচ্চু চলে যাওয়ার দুই বছর হয়ে গেল। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে তার শূন্যতা রয়ে গেছে। আমার মনে হয় না এ শূন্যতা কখনো  পূরণ হবে। আধুনিক সংগীতাঙ্গনে তার অবদান ভোলার নয়। দেশের ব্যান্ড সংগীতকে জনপ্রিয় করেছেন বাচ্চু। তিনি বাজাতেন, গাইতেন, লিখতেন আবার সুরও করতেন। তার প্রায় প্রতিটি গানই জনপ্রিয়। তার গানগুলো মানুষ শোনেন আর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

আইয়ুব বাচ্চু শুধু একজন সংগীতশিল্পীই নন, তিনি একজন ভালো মনের খুব সাধারণ মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে যাদের উঠা-বসা ছিল তারাও আমার কথার সঙ্গে একমত প্রকাশ করবেন নিশ্চয়ই। তিনি খুব সহজেই একজনকে আপন করে নিতে পারতেন। গান দিয়ে যেমন শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন, ব্যবহারেও তেমনটি ছিলেন। সহজসুলভ আচরণ ছিল তার। ৪০ বছরের সম্পর্কে আমাদের অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। বয়সে একটু বড় হলেও মিউজিকের কারণে বাচ্চুর সঙ্গে হূদ্যতা হয়ে যায়।

চট্টগ্রামের হাটে, মাঠে, ঘাটে, বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে এমন কোনো জায়গা নেই যে আমরা অনুষ্ঠান করিনি। চট্টগ্রামের অলিগলিতে আমাদের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। রাত করে ঘরে ফিরতাম। মা রান্না করে আমাদের খাওয়াতেন। মা বলতেন, আমার দুই ছেলে। আমি ঢাকায় চলে আসি বাচ্চুর আগে।

১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে ও ঢাকায় চলে এলে আমরা তখন একসঙ্গে থাকতাম। এক খাটেই ঘুমিয়েছি। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে শেষবারের মতো আমাদের দেখা হয়।

তখন বলল, ‘দোস্ত, শেষ পর্যন্ত হয়তো আমাদের একজন আরেকজনকেই কাঁধে নিতে হবে। সেদিন বুঝিনি ও চলে যাবে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!