• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিল নিয়ে ক্ষোভে ফুসছে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ


সোনালীনিউজ ডেস্ক জুন ২৫, ২০২০, ০১:১১ পিএম
বিল নিয়ে ক্ষোভে ফুসছে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ

বিদ্যুৎ ও পানির অস্বাভাবিক বিল নিয়ে ক্ষোভে ফুসছে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। আগে যেখানে মাসে ৫০০ টাকা বিল আসত, সেখানে আসছে দেড়-দুই হাজার টাকা। পানির বিল যেখানে আসত ৪০০ টাকা, সেখানে আসছে প্রায় চার হাজার। এমন অস্বাভাবিক বিলের কারণে দিশেহারা ও ক্ষুব্ধ ঢাকা ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগের গ্রাহকরা।

বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, অর্থবছরের শেষে এবং করোনাকালেও রাজস্ব আদায়ের সফলতা দেখাতে এমন বাঁকা পথ ধরেছে ঢাকা ওয়াসা ও বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃপক্ষ। অবশ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনার কারণে অনেক মিটার রিডার কয়েক মাস সরেজমিনে বিল করতে পারেননি। এখন মিটারের রিডিং দেখে বর্ধিত বিল সমন্বয় করা হচ্ছে। এ জন্য বিল বেশি আসছে। কেউ অভিযোগ দিলে কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, বিদ্যুৎ বিল নিয়ে নানা ভোগান্তির কথা তার কাছেও এসেছে। করোনার কারণে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিল করা সম্ভব হয়নি। তাই বিতরণ কোম্পানিগুলোর কিছু ভুল হয়েছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। প্রত্যেকের বিলই পরে সমন্বয় করা হবে।

ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাউসার আমির আলী জানিয়েছেন, তারা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আগামী মাস থেকে এই সমস্যা থাকবে না।

অভিযোগের পাহাড় : চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মধ্যম সোনাপাহাড় গ্রামের পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক ছাদেক হোসেনের মিটার নম্বর ১৪৮২৯৭০৬। গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত পাঁচ মাসে তার মাসিক বিদ্যুৎ বিল যথাক্রমে ২৩৯ টাকা, ৩৭২ টাকা, ৫২২ টাকা, ৯৪৩ টাকা এবং ১১৮৫ টাকা। অর্থাৎ জানুয়ারির চেয়ে মে মাসে বিল বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) আওতাধীন কাফরুলের গ্রাহক নাজমা বেগমের মিটার ব্যবহারকারী ভাড়াটিয়া ইয়াসিন আহমেদ জানান, মে মাসে তার বিদ্যুৎ বিল এসেছে চার হাজার ৫৩৮ টাকা। অথচ এপ্রিলে ৭৬৭ টাকা এবং মার্চে ৫৯৫ টাকা এসেছিল। এর আগে এসেছিল জানুয়ারিতে ৩৩৫ টাকা আর ফেব্রুয়ারিতে ৪১১ টাকা। এপ্রিল ও মার্চের বিল অনলাইনে পরিশোধ করায় এ বছরের মে মাসের বিলে তার কোনো বকেয়া বিলও সংযুক্ত হয়নি। তার পরও মে মাসে কয়েকগুণ বিল বেশি আসার কারণ জানেন না ইয়াসিন আহমেদ।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসির) ২২৫০৮৪৫৫ নম্বর হিসাবধারী গ্রাহক মিজানুরের মে মাসের বিল এসেছে ১৩ হাজার ৫৮ টাকা। যেখানে মার্চের বিল ছিল এক হাজার ৬২৮ টাকা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) গ্রাহক মোহাম্মদ ইউনুস (হিসাব নং ২৯৪২৮৮৯৪) মে মাসের বিদ্যুৎ বিল পেয়েছেন এক হাজার ৯২৯ টাকা। তার মার্চের বিল ছিল ৬২১ টাকা। এ রকম অসংখ্য ভুক্তভোগী গ্র্রাহকের অভিযোগ, স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করেও সমাধান মিলছে না।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলছেন, করোনাপরিস্থিতির কারণে মিটার না দেখে বিল করার পর মে মাসে তা সমন্বয় করতে গিয়ে এ রকম হয়েছে। গরমের কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে গেছে বলেও বিল বেশি আসছে। পারফরম্যান্স দেখানোর জন্য বিল করার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

পানির বিলও অস্বাভাবিক : রাজধানীর খিলক্ষেতের কুড়াতলীর শওকত উদ্দিন আহমেদের বাসায় প্রতি মাসে পানির বিল আসত চার-পাঁচশ' টাকা। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সেই বিল বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত মে মাসে তাকে প্রায় চার হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু শওকত উদ্দিন আগেও যে রকম পানি খরচ করতেন, গত কয়েক মাসে একই রকম পানি খরচ করেছেন। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বেশি পানি খরচ করলে ৫০০ টাকার বিল এক হাজার টাকা হতে পারে। কিন্তু চার হাজার টাকা বিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

শওকত উদ্দিনের বিগত কয়েক মাসের বিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসে ওয়াসা তাকে ৪৯২ টাকার বিল দিয়েছিল। জানুয়ারি মাসে দিয়েছিল ৫৪৫ টাকার বিল। এর পরই বাড়তে থাকে। তার পানির মিটারের কোড নম্বর ০৮০৩১৭, অ্যাকাউন্ট নম্বর ০৮০২৬৬৮৪৫২। তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, গত জানুয়ারি থেকে ওয়াসা পানির বিল বাড়িয়েছে। আবাসিক গ্রাহকের ক্ষেত্রে আগে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম ছিল ১১ টাকা ৫৭ পয়সা। বর্ধিত মূল্য হয়েছে ১৪ টাকা ৫৭ পয়সা। যে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু বর্ধিত হারে বিল করলেও ৫০০ টাকার পানির বিল ৩৮০০ টাকা হতে পারে না বলে তার বিশ্বাস। বিষয়টি তিনি ঢাকা ওয়াসাকে জানানোর পর গত বুধবার আসাদুজ্জামান নামের একজন মিটার রিডার এসে পানির মিটার খোলেন। পরে শওকত উদ্দিনকে জানান, বিল ঠিকই আছে। তবে শওকত উদ্দিনের বিশ্বাস, মিটারটি টেম্পারিং করা হয়েছে। কারণ বছরখানেক আগে তাকে ফোনে একজন বলেছিলেন, তিনি ওই এলাকার পানির বিল করেন, তাকে সন্তুষ্ট করলে বিল অনেক কম আসবে। তবে শওকত উদ্দিন তাতে সায় দেননি।

এ প্রসঙ্গে মিটার রিডার আসাদুজ্জামান বলেন, গত আট মাস হলো তিনি ওই এলাকার দায়িত্ব পেয়েছেন। এরপর তিনি দেখেন, তার আগে দায়িত্বরত সুজন মিটার না দেখেই অনেক কম বিল করায় অনেক ইউনিটের বিল বকেয়া পড়েছে। সেই বকেয়া সমন্বয় করার জন্য কিছু বাড়িয়ে বিল করা হচ্ছে। এখনও ৭০০ ইউনিট বকেয়া রয়েছে। ওই বকেয়া ইউনিট সমন্বয়ের পর রিডিং অনুযায়ী বিল করা হবে বলে জানান মো. আসাদুজ্জামান।

কেবল শওকত উদ্দিন নন, ঢাকা ওয়াসার অনেক গ্রাহককেই এ রকম তুঘলকি বিলের শিকার হতে হচ্ছে। আদাবরের মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকার ৩ নম্বর রোডের ১৮/বি নম্বর বাড়ির বাসিন্দা বাবুল জানান, আগে প্রতি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা পানির বিল আসত। কয়েক মাস আগে সেই বিল আসতে শুরু করল ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। ঢাকা ওয়াসাকে জানালেন। তারা বলল, আগে বিল পরিশোধ করুন, তারপর মিটার পাল্টে নেন। ওয়াসার লোকদের কথামতো বিল পরিশোধ করে মিটারও পাল্টে নিলেন। তারপর বিল চার-পাঁচ হাজার টাকায় নেমে এলো। কিন্তু দু'মাস পরই আবার তা বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার টাকা!

প্রসঙ্গত, একসময় ঢাকা ওয়াসায় ব্যাপক হারে পানি চুরি বা পানির সিস্টেম লস হতো। সেসব কমিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে ওয়াসা ২০০৯ থেকে রাজস্ব আদায় কার্যক্রম বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়। কাজ পায় ঢাকা ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী সমবায় সমিতি লিমিটেড। তাদের সঙ্গে প্রোগ্রাম ফর পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট (পিপিআই) প্রকল্পের আওতায় ওয়াসার সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী আদায়কৃত অর্থের ১০ শতাংশ পাবে পিপিআই। বাকি অর্থ পাবে ওয়াসা। এই পদ্ধতিতে হুহু করে রাজস্ব আয় বেড়ে যায়। কারণ যত বেশি টাকার বিল ইস্যু হবে, বিলের কমিশনও পিপিআইর বাড়বে। একপর্যায়ে তারা অতিরিক্ত বিলও করতে থাকে। ফলে গ্রাহকের ক্ষেত্রে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায় পিপিআই। বিষয়টি ধরা পড়ার পর পিপিআইর সঙ্গে ওয়াসা চুক্তি বাতিল করে। কিন্তু পিপিআইর জনবলকে আত্তীকরণ করে ওয়াসা একই পদ্ধতিতে বিল ইস্যু ও আদায়ের কাজ করছে। ফলে পিপিআইয়ে যুক্ত মিটার রিডারই এখন ওয়াসায় একই কাজ করছেন।

তবে ঢাকা ওয়াসার শ্রমিক-কর্মচারী সমবায় সমিতির সভাপতি ও পিপিআই প্রকল্পের চেয়ারম্যান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামানও করোনার অজুহাত দেখিয়ে বলছেন, করোনার কারণে অনেক মিটার রিডার ফিল্ডে না গিয়ে বিল করেছেন। এ জন্য তারা গড়ে একটা বিল দিয়েছিলেন। ফলে গ্রাহকদের অতিরিক্ত পানির খরচ বাদ পড়েছিল। এ ছাড়া ওয়াসার পানির বিলও তো বেড়েছে। এখন সেই বকেয়া রিডিংগুলোর বিল ধরলেই গ্রাহক মনে করছে তাদের ভূতুড়ে বিল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়। তবে কোনো গ্রাহক যদি মনে করেন তার বিল অস্বাভাবিক, তাহলে তিনি ওয়াসায় অভিযোগ দিতে পারেন। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পারফরম্যান্স দেখাতেই বাড়তি বিল : ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, ওয়াসা চাইছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। তাই মিটার রিডারদের বলা হচ্ছে, আগের চেয়ে আরও বেশি বিল আদায় করতে হবে। তা ছাড়া জুন মাসের মধ্যে বিল আদায়ের চাপও থাকে। এ কারণে বাড়িয়ে বিল করা হচ্ছে। করোনার এই সময়েও রাজস্ব আদায়ের পিছিয়ে নেই- এমন উদাহরণ তৈরির চেষ্টাও রয়েছে ওয়াসার।

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রতি বছর জুনের আগে দুই-তিন মাসে গ্রাহকদের কিছু বিল বাড়তি ধরা হয়। কারণ জুনে অর্থবছর শেষ হয়। এ সময় বিদ্যুতের সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণ, বিল আদায়সহ বিভিন্ন পারফরম্যান্স ভালো দেখানো হয়। বিল বেশি দেখালে সবকিছু মিলিয়ে দেওয়া যায়, পারফরম্যান্সও ঠিক থাকে। কিন্তু এবার করোনার কারণে মার্চ ও এপ্রিলে বাড়তি বিল ধরানো সম্ভব হয়নি। তাই মে মাসে গ্রাহকদের ওপর এত বেশি বিলের বোঝা চাপানো হয়েছে যে, বিষয়টি সবার চোখে ধরা পড়েছে। ডিপিডিসির খিলগাঁওয়ের একজন গ্রাহক স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে অভিযোগ করলে একজন কর্মকর্তা তাকে জানান, তাদের ২৫ শতাংশ বাড়তি বিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, তারা গ্রাহকের ভোগান্তির বিষয়ে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু কমিশন এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এখনও। সূত্র- সমকাল

সোনালীনিউজ/টিআই

Wordbridge School
Link copied!