• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিলুপ্তির পথে জামায়াত!


বিশেষ প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৯, ১১:৪৬ এএম
বিলুপ্তির পথে জামায়াত!

ঢাকা : দেশের মহান স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর অবশেষে বিলুপ্তির পথে নানামুখী চাপে বেকায়দায় পড়া স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে দেশের উচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হলেও এখনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে দেশের স্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধী এ রাজনৈতিক দলটি। যদিও তাদের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে (আপিল আদালত) বিচারাধীন রয়েছে। তবে এরইমধ্যে হঠাৎ করে দলটির মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আর এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে অবশেষে বিলুপ্তিই হতে যাচ্ছে দলটি।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই লন্ডনে অবস্থানকারী জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি দলটির আমির মকবুল আহমাদ বরাবর লেখা এক দীর্ঘ চিঠিতে নিজের পদত্যাগের কারণ উল্লেখসহ জামায়াতকে বিলুপ্তি করারও উপদেশ দিয়েছেন তিনি।

এরপর থেকেই ‘জামায়াত’ ইস্যু দেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচিত হতে শুরু করে। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে জামায়াতের আমির গণমাধ্যমে বিবৃতিও দেন। এরপর দলটির মজলিশে শুরার সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জু (যিনি জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতিও ছিলেন) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দলের সংস্কার ইস্যুতে খোলামেলা সমালোচনা করেন। এর প্রেক্ষিতে শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদ তাকে (মঞ্জু) দল থেকে বহিষ্কার করেন।

স্বাধীনতা প্রশ্নে জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগের একদিনের মাথায় দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার এক জামায়াত নেতা পদত্যাগ করেছেন। তার নাম বখতিয়ার উদ্দীন। তিনি ছাত্রশিবির নীলফামারী শাখা জেলার সাবেক সভাপতি ও ভেড়ভেড়ী ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, ১৫  ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগপত্র বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তিনি জামায়াতে ইসলামী ও অঙ্গসংগঠনের সব সদস্য পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।

এরপর আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় দল থেকে খোদ জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদের পদত্যাগের বিষয়টি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে মকবুল আহমাদ জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব আর পালন করতে চাচ্ছেন না। তিনি এই বৃদ্ধ বয়সে দলের এসব বিতর্কের ভার আর সহ্য করতে পারছেন না। তাই জামায়াতের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক আর তিনি চালিয়ে যাবেন না। যদিও গত সোমবার সন্ধ্যায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ‘জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদ আমির পদে থাকতে চাচ্ছেন না, তিনি পদত্যাগ করতে চাচ্ছেন’ এ সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে দলটি।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম এক বিবৃতিতে বলেন, দু’একটি সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত রিপোর্টে ওপরে উল্লেখিত তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই।  তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদের আমির পদে না থাকা বা পদত্যাগ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করার প্রশ্নই আসে না। জামায়াতে ইসলামীর ভাব-মর্যাদা ক্ষুন্ন করার হীন-উদ্দেশ্যেই এ অসত্য তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সম্পর্কে এ ধরনের ভিত্তিহীন অসত্য তথ্য প্রকাশ করা সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী বলেও দাবি করেন অধ্যাপক তাসনীম আলম।

জামায়াত সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে দীর্ঘদিন থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসতে থাকে। তবে বেশ ক’বার ক্ষমতায় থাকা দল বিএনপির সঙ্গে সখ্যের কারণে এ দলটিকে রাজনৈতিক মাঠে তেমন কাবু করা যায়নি। পরবর্তীতে ওয়ান ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন উদ্যমে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের উদ্যোগ নেয়। যুদ্ধাপরাধের বিচারে একে একে জামায়াতের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত ও তাদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর এ দলটি নিষিদ্ধ করার দাবি দিন দিন আরও জোরালো হতে থাকে।

এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে। তবে নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে দলটি সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে দলটিকে এখনও নিষিদ্ধ করা যায়নি। তবে, দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা শিগগিরই স্বাধীনতাবিরোধী এ রাজনৈতিক দলটিকে আদালত নিষিদ্ধ করবেন।

এ দিকে জামায়াত নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে সব ঘটনা ঘটছে তার সবই সাজানো নাটক বলেও মনে করছেন অনেকে। জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্য বিএনপিকে সুস্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তারা যদি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করে তাহলে তাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক বিষয় নিয়ে এ সব দেশ আলোচনায় আগ্রহী নয়।

একাদশ জাতীয় নির্বাচন বাতিলের জন্য যখন বিএনপি আন্তর্জাতিক মহলে তদবির শুরু করে তখন তাদের বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি থেকে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত থেকে প্রার্থিতা দেয়া হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ‘আলোচিত’ সম্পর্ক এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে জামায়াত নাটকের মাধ্যমে বিএনপিকে একটা ‘স্পেস’ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে সমালোচকরা বলছেন।

সমালোচকদের দৃষ্টিতে, জামায়াতের ’৭১ সালের ইস্যু অনেক পুরনো। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ ছিলো। ১৯৭৫’র ১৫ আগস্টের পর জামায়াত আবার প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই ক্ষীণভাবে হলেও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল। ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধের জন্য দলটিকে বারবার ক্ষমা চাইতে বলা হচ্ছিল। তবে দলটি কোনদিনই দেশের জনগণের আহ্বানকে মর্যাদা দেয়নি। ক্ষমাও চায়নি। এতোদিন পর এই বিষয়টিকে আবারও সামনে আনা হয়েছে মূলত বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ‘অনৈতিক’ সম্পর্ককে আড়াল করার জন্য।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখন হয়তো ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দল হবে। সে দলে জামায়াতের তরুণ প্রজন্ম আসবে। সেটাকে একটি ধর্ম নিরপেক্ষতার ইমেজ দিয়ে রাজনীতিতে স্পেস দেয়া হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, দেশের স্বাধীনতার পক্ষশক্তির দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল দেশকে জামায়াতমুক্ত বাংলাদেশ। বিশেষ করে ২০২১ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মহাধুমধামে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছে। দেশের মানুষ এরআগেই জামায়াতমুক্ত দেশ দেখতে চায়। তবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল, ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগ ও আদালতের রায়ে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বাভাস টের পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করতে শুরু করেছে।

জামায়াত বিলুপ্ত হওয়ার পূর্বাভাস পেয়ে বিএনপির পক্ষ থেকেও কোনো কোনো নেতা একাত্তরের এ দলের ভ‚মিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা শুরু করেছেন।

সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, একাত্তরের ভ‚মিকার জন্য জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তিনি বলেন, জামায়াত নিজেদের লাভের জন্য বিএনপির সঙ্গে জোটে এসেছে, বিএনপির জামায়াতকে কোনো প্রয়োজন নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম খান ক’দিন আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াত প্রশ্নে বলেন, আমি নিজে মুক্তিযোদ্ধা। সরাসরি রণাঙ্গনে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি যে রাজনৈতিক দলের নেতা সে দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই আমাদের জামায়াত সমর্থনের কোনো প্রশ্নই আসে না। রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন কৌশল নিতে হয়। জামায়াতের সঙ্গে জোটও আমাদের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। কোনোভাবেই আদর্শিক নয়।

বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমেদ একাত্তরে জামায়াত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাই দলটিকে ’৭১-এর ভ‚মিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত আর বিএনপির উচিত দলটিকে জোট থেকে বাদ দেয়া।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময় জামায়াতকে বাদ দিয়ে বৃহত্তর জোট করার দাবি জানায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কিন্তু জামায়াতকে জোট থেকে বের না করায় বি চৌধুরী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হননি।   

এসব বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ার, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুল হালিমসহ বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কোনো নেতাই ফোন রিসিভ করেননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেন্দ্রীয় নেতা এ বিষয়ে বলেন, জামায়াত যেমন ছিল তেমনই আছে। দু’একজন নেতা এদিক-সেদিক গেলে তাতে জামায়াতের কিছু আসে যায় না।জামায়াত একটি আদর্শিক রাজনৈতিক দল। এটা কোনো একক নেতা কেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল নয়। তাই এ দল ভাঙন বা বিলুপ্তির কোনো সুযোগ নেই।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!