• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
চকবাজার চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড

বিশেষ মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসল্লিরা


বিশেষ প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯, ১২:০২ এএম
বিশেষ মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসল্লিরা

ঢাকা : পুরান ঢাকার নিমতলীর পর এবার চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছে  গোটা বাংলাদেশকে। মুহূর্তের বিভীষিকায় ৬৭ জনের প্রাণহানির মধ্যে দিয়ে আবারও আলোচনায় এসেছে আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম আর কারখানা থাকার বিপদ। বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালের কারণেই চকবাজারের আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধি দল। এতে ৫টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানায় তারা।

শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকালে ১১ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দলও।

পুরান ঢাকার পাইকারি পণ্যের বাজার চকবাজারের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের কাছে গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাপ্রবাহের শুরু। বিকট বিস্ফোরণের পর প্রথমে রাস্তায় থাকা যানবাহনগুলোতে আগুন ধরে যায়, এরপর সেই আগুন গ্রাস করে আশপাশের পাঁচটি ভবন। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, কিন্তু ততক্ষণে চুড়িহাট্টা মোড় পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ভিড়ের মধ্যে থাকা একটি পিকআপ ভ্যানের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে আগুনের সূত্রপাত হয়। তবে ওই ভ্যানটি পরিবহনের জন্য সিলিন্ডার বহন করছিল, না কি গাড়ির নিজস্ব জ্বালানির জন্য রাখা সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছিল তা এখনও অস্পষ্ট।   

তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও বলেছেন, আশপাশের দোকান আর ভবনে থাকা রাসায়নিক আর প্লাস্টিক-পারফিউমের গুদাম চুড়িহাট্টার আগুনকে দিয়েছে ভয়াবহ মাত্রা।

আগুন নেভানোর অভিযানে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন মনে করছেন, ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকায় যে পরিমাণ দাহ্য সামগ্রীর মজুদ ছিল, তাতে ভয়ঙ্কর এ ঘটনার ক্ষেত্র হয়ত আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল।

আর নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব মনে করছেন, ২০১০ সালে রাসায়নিকের গুদামে ঠাসা নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষের প্রাণহানির পর তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ায় এবারের ঘটনা আগের মতই ভয়াবহ রূপ পেয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বৃহস্পতিবার ওই ধ্বংসস্তূপ থেকে ৬৭ জনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছেন। সেই সঙ্গে পাঠানো হয়েছে আরও কিছু দেহের অংশ। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মানবদেহের সারির পাশে স্বজনদের আহাজারিতে পুরোদিন ভারি হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবেশ।

মর্গে আসা ৬৭টি লাশের মধ্যে ৪৬ জনের পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে স্বজনদের কাছে। ১৩ জনকে দাফন করা হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে, অনেকের মরদেহ স্বজনরা গ্রামের বাড়ি নিয়ে গেছেন।

অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন নয় জন; শরীরের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় তাদের ছয়জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। তবে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি দল এখনও সেখানে অবস্থান করছেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন আত্মীয় স্বজনের বাসায়। যারা আছেন, বুধবারের আগুনের ভয়াবহতা আর আতঙ্ক তাদের পিছু ছাড়ছে না।

৪৬ লাশ হস্তান্তর : চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে ৪৬ জনের পরিচয় শনাক্তের পর তাদের মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বজনদের কাছে। চকবাজার থানার ওসি শামীমুর রশিদ তালুকদার জানান, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৪৬ জনের মরদেহ শনাক্ত করা গেছে, সবগুলোই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার সকালে মোট ৭০টি  বডি ব্যাগ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পাঠানোর কথা জানানো হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ ৬৭টি লাশ পাওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান।

সংখ্যার গড়মিলের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক তারেক হাসান ভ‚ইয়ার ভাষ্য, তাদের হিসাবে লাশ ৭০টি। তবে কয়েকটা ব্যাগে খণ্ড খণ্ড ডেডবডি ছিল। সম্পূর্ণ ডেডবডি হয়ত ৬৭টি হতে পারে। কয়েকটি লাশ এতটাই পুড়েছে যে চেনার উপায় নেই।

আর ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের কাছে ফুল বডি এসেছে মোট ৬৭টি। তবে আলাদা ব্যাগে কিছু খণ্ডিত দেহাবশেষ আছে। সেগুলো এই মরদেহগুলোরই কি না তা আমরা পরীক্ষা করে দেখব। আপাতত সবগুলো ডেডবডির স্যাম্পল রেখে দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে জায়গা না হওয়ায় শনাক্ত না হওয়া কয়েকটি মরদেহ অন্যান্য মেডিকেলের হিমঘরে রাখা হচ্ছে। এসব মরদেহের ডিএনএ নমুনা রেখে দেওয়া হয়েছে। যারা এখনও স্বজনদের খুঁজছেন, তারা রবিবার থেকে ডিএনএ নমুনা সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের কাছে দেবেন। নমুনা হিসেবে রক্ত ও লালার স্যম্পল দিতে হবে। সংরক্ষণ করা কোনো মরদেহের সঙ্গে মিল পেলে লাশ হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হবে।’

হাসপাতালে স্থাপিত ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্যকেন্দ্র থেকে জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার ইমরুল হাসান জানান, মরদেহ সমাহিত করার জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে।

এ পর্যন্ত নিহত যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন- কামাল হোসেন (৪৫), পিতা: নূর মোহাম্মদ, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী; অসি উদ্দিন (২৩), পিতা: নাসির উদ্দিন, ধানমণ্ডি, ঢাকা; মোশাররফ হোসেন (৪৩), পিতা: মো. মাহফুজুর রহমান, নোয়াখালী; হাফেজ মো, কাউসার আহমেদ (২৬), পিতা: মো. খলিলুর রহমান, শ্রীপুর, হোমনা, কুমিল্লা; আলী হোসেন (৬৫), পিতা: মৃত বুলু মিয়া, নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী; মো. ইয়াসিন (৩৩), পিতা: মৃত আবদুল আজিজ, ১৭ কেবি রোড, চকবাজার, ঢাকা; শাহাদৎ হোসেন (৩০), পিতা: মৃত মোসলেম উদ্দিন, নারায়ণপুর, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিল্লা; আবু বকর সিদ্দিক (২০), মোহাম্মদপুর, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর; জুম্মন (৫২), ৩২/৩২ ওয়াসা রোড, চকবাজার ঢাকা; মজিবুর হওলাদার (৫০), সন্তোষপুর, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী; হেলাল উদ্দিন (৩২), নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী; আশরাফুল হক (২০), পিতা: মৃত জামশেদ মিয়া, ফরহাদাবাদ, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া; ইমতিয়াজ ইমরোজ রাসু (২২), পিতা: নজরুল ইসলাম, বেড়া, পাবনা; মো. সিদ্দিক উল্লাহ (৪৫), নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী; মাসুদ রানা (৩৫), পিতা: সাহেব উল্লাহ, নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী; অপু রায়হান (৩১), ৪৬/২, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, চকবাজার, ঢাকা; আরাফাত আলী (৩), পিতা: মৃত মোহাম্মদ আলী, ৪৬/২, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, চকবাজার, ঢাকা; মোহাম্মদ আলী (২২), ৪৬/২, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, চকবাজার, ঢাকা; মাহবুবুর রহমান রাজু (২৯), পিতা: সাহেব উল্লাহ, নাটেশ্বর, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী; এনামুল হক কাজী (২৮), পিতা: মোতালেব কাজী, রামপুর, মির্জাগঞ্জ, পটুয়াখালী; সিয়াম আরাফাত (১৯), পিতা: মো. ইসমাইল, ৪ নাজিমউদ্দিন রোড, বংশাল, ঢাকা; ওমর ফারুক (৩০), পিতা: আবদুল করিম, মুন্সিকান্দি, নড়িয়া, শরীয়তপুর এবং সোলায়মান (২৫), মধুপুর, টাঙ্গাইল।

চুড়িহাট্টার আগুনে দগ্ধ নয়জনকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে রাখা হয়েছে আইসিইউতে। ভর্তি থাকা সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।

তিনি বলেন, ‘১৮ জন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছে, যাদের মধ্যে নয়জন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছে, বাকি নয়জন ভর্তি আছে। আহতদের মধ্যে ছয়জনেরই শ্বাসনালীসহ শরীরের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পুড়ে গেছে। শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়াদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’

কেমিক্যালের কারণেই আগুন ভয়াবহ হয় : বিপুল পরিমাণ কেমিক্যালের কারণেই চকবাজারের আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল বলে জানিয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধি দল। এতে ৫টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানায় তারা।

শুক্রবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সকালে ১১ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দলও।

চকবাজারে আগুনের ঘটনা তদন্তে শুক্রবার সকালে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন সমিতি। সেখানে কী ধরনের এবং কী পরিমাণ কেমিক্যাল ছিল, তা খতিয়ে দেখেন তারা।

এর আগে পরিদর্শন করে সিটি কর্পোরেশনের তদন্ত দল। তারা জানান, এ এলাকায় কেমিক্যালের ব্যবসার কোনো অনুমোদন ছিল না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, ‘এখানে ব্যবসা করার জন্য কোনো কেমিক্যালের লাইসেন্স দেয়া হয়নি, এমনকি লাইসেন্স নবায়নও করা হয়নি। তারপরও যারা এখানে কেমিক্যালের ব্যবসা করছেন বা কেমিক্যাল রেখেছেন সেটা তাদের নিজস্ব বিষয় সিটি কর্পোরেশনের না।’

নিরাপত্তায় নিজেদেরও সচেতন হতে হবে উল্লেখ করে তদন্ত দলে থাকা রাজউকের কর্মকর্তা নুরুজ্জামান হোসেন বলেন, ‘রাজউক মাঝে মাঝেই পদক্ষেপ নিয়েছে এবং রাজউক থেকে তাদের নোটিশও দেয়া হয়েছে। কিন্তু সব সময় যে নোটিশ দিয়েই বলতে হবে এমন না। আপনি যে ভবনে বসবাস করছেন সেখানে কেমিক্যালের সামগ্রী মজুদ রাখছেন এটাতো আপনারও সচেতনতারও বিষয়।’

এ সময়  ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স এর উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ পরিচালক লেফটেন্ট কর্নেল জুলফিকার জানান, ‘কেমিক্যালের কারণেই আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়।’ পুড়ে যাওয়া ভবনগুলো এখনো ঝুঁকিতে আছে বলেও জানান তিনি।

ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা সতর্ক করে জানান, পুড়ে যাওয়া ভবনগুলো এখন আর ব্যবহার করার অবস্থায় নেই। কারণ অগ্নিকাণ্ডের ফলে ভবনের মূল কাঠামো এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যাতে যে কোনও সময় ভবনগুলো ধসে পড়তে পারে।

পরে চকবাজারে ঘটনাস্থলে আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অগ্নি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জানান, ‘এ ঘটনায় কেউ দায়ী কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে এবং অগ্নিকাণ্ডের উৎস খুঁজে বের করা। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড না ঘটে সেজন্য সুপারিশ প্রদান করা।’

বেজমেন্টে কেমিক্যালের পাহাড় : পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় পুড়ে যাওয়া ওয়াহিদ ম্যানশনের বেজমেন্টে এখন শত শত কনটেইনার এবং প্যাকেট ও কন্টেইনারভর্তি কেমিক্যাল মজুত রয়েছে। ফলে বুধবার রাতে লাগা আগুন ভবনের বেজমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছালে বিস্ফোরণের ভয়াবহতা ও নির্মমতা মাত্রা হতো কল্পনাতীত।

শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ওয়াহিদ ম্যানশনে কোনো কেমিক্যালের গোডাউন ছিল না। কিন্তু গতকাল শুক্রবার ওয়াহিদ ম্যানশনের বেজমেন্টে গিয়ে দেখা মেলে শত শত ড্রাম, বিভিন্ন কন্টেইনার ও প্যাকেটে নানা ধরনের কেমিক্যাল। রং তৈরিতে ব্যবহৃত হতো এসব কেমিক্যাল, পাউডার এবং লিকুইড। কেমিক্যালে ভরপুর পুরো বেসমেন্ট।

ওয়াহিদ ম্যানশনের বেসমেন্টের শত শত বস্তা প্যাকেট ও কন্টেইনারে রয়েছে রঙের পাউডার। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এসব পাউডার উচ্চ দাহ্য ক্ষমতা সম্পন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। তাদের দাবি, এই ভবনটিতে শুধু অননুমোদিতভাবে রাসায়নিক মজুত করা হয়েছে তাই নয়, এমনকি মজুত করার ক্ষেত্রে মানা হয়নি কোনো নিয়মকানুনও। চুড়িহাট্টার চৌরাস্তার সামনে লাগা আগুন যদি বেজমেন্ট পর্যন্ত আসতো তাহলে আগুনের ভয়াবহতা ও নির্মমতা কোন পর্যায়ে যেতো তা কল্পনাতীত।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, ওয়াহিদ ম্যানশনের বেজমেন্টে থাকা রাসায়নিকের গুদাম পর্যন্ত আগুন পৌঁছালে বিস্ফোরণের মাত্রা হতো ব্যাপক। এতে আগুন নেভাতে সময় লাগতো অনেক বেশি। ফলে বেড়ে যেতো হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।

ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, এই বেজমেন্টে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই ডাইয়িং এবং প্রিন্টিং-এর কাজে ব্যবহƒত হতো।  সব কেমিক্যালই বিপদজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে বেজমেন্টে কার পার্কিং থাকার কথা, সেখানে গোডাউন করা হয়েছে, এমনকি গোডাউনে মালপত্র রাখার যেসব নিয়ম কানুন রয়েছে সেগুলোও মানা হয়নি। পুরোই নিয়ম বহির্ভূতভাবে বেজমেন্টে গোডাউনে রাসায়নিক রাখা হয়েছে।

লাশ শনাক্তে ডিএনএ নমুনা নিচ্ছে সিআইডি : চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে জীবন্ত দগ্ধ ৪৬ জনের লাশ হস্তান্তরের পর বাকি মরদেহ শনাক্তে নিহতদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছেন সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের কর্মীরা।

শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ এলাকায় নমুনা সংগ্রহ শুরু হয় বলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রুমানা আক্তার জানান।

সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের সহকারী অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন জানান, ‘শনাক্ত করা যায়নি এরকম ১৫টি লাশের দাবি নিয়ে ২০ জন তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। তাদের ডিএনএ  নমুনা আমরা সংগ্রহ করেছি। আমরা আজ বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব। এরপর কেউ এলে তারা মালিবাগে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে গিয়ে নমুনা দিতে পারবেন।’

স্বজন পরিচয়ে যারা আসছেন, তাদের রক্তের পাশাপাশি বাক্কাল সোয়াব (গালের অভ্যন্তরের টিস্যু) সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান নুসরাত।

আর যে ২১ জন লাশ শনাক্ত করা যায়নি, তাদের পেশি, দাঁত ও হাড়ের নমুনাও সংগ্রহ করছেন সিআইডির কর্মীরা।

বিশেষ পুলিশ সুপার রুমানা জানান, ‘যাদের চেনার উপায় নেই, তাদের পরিচয় শনাক্তের বিষয়টি এখন ডিএনএ স্যাম্পলের উপরই নির্ভর করছে। এ পরীক্ষার জন্য তিন থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।’

নিখোঁজদের স্বজনরা যতদিন পর্যন্ত আসবেন, ততদিন পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহের এই কাজ অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই মামলা : রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় দু’টি মামলা হয়েছে। বুধবার রাতের ওই ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে একটি এবং গতকাল শুক্রবার সকালে নিহত একজনের স্বজন আরেকটি মামলা করেন চকবাজার থানায়।

থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দেলোয়ার হোসেনের করা মামলায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। তিনি নিজেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

পরে শুক্রবার সকালে একই থানায় আরেকটি মামলা করেন আগুনে জীবন্ত দগ্ধ আরাফাত ইসলাম সিয়ামের (১৯)  আত্মীয় হাবীবুর রহমান রুবেল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান এ তথ্য জানান। তিনি জানান, চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক হাজি আবদুল ওয়াহেদের দুই ছেলে শহীদ ও হাসানসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।

সারাদেশের মসজিদে বিশেষ মোনাজাত : পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনায় দেশের সব মসজিদে মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শুক্রবার বাদ জুমা দেশের সব মসজিদে মসজিদে দেশ ও জাতির কল্যাণে এ দোয়া-মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

বাদ জুমা বঙ্গভবন জামে মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক, রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব, প্রেস সচিবসহ বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশ নেন।

বঙ্গভবন জামে মসজিদের মোয়াজ্জেম হাফেজ মাওলানা এনামুল হক এ দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন।

অন্যদিকে ঘটনাস্থল চকবাজারের পাশে অবস্থিত চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদেও বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি এবং আহতদের আশু সুস্থতা কামনায় হাজার হাজার মুসল্লি অংশ নেন।

বাদ জুমা মসজিদের খতিব মোনাজাত শুরু করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আগত মুসল্লিরা। এসময় সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী সেলিমসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!