• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব


মো. এনায়েত কবির মার্চ ২৫, ২০২০, ০৫:০৪ পিএম
বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব

ঢাকা : আধুনিক বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতি একটি বহুল আলোচিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। আজকের বিশ্ব সভ্যতা যে স্তরে পৌঁছেছে তার পেছনে অর্থনীতি বা অর্থশাস্ত্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে এ অর্থনীতি সভ্যতার উত্থান-পতন, গতিধারা পরিবর্তনে সমানভাবে কার্যকর থেকেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষ নিজেকে এখন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। অর্থনীতির মুক্তবাজারমুখী পরিবর্তন আজ প্রভাব বিস্তার করেছে জীবনের সর্বস্তরে। তাই বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে এ যুগে বন্ধুত্বই কাম্য বিবেচিত হচ্ছে উন্নয়নের কৌশলরূপে। এ প্রেক্ষাপটেই বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতি বিস্তার লাভ করছে।    

মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাটি আমাদের দেশের মানুষের কাছে এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ঋৎবব ঊহঃবৎঢ়ৎরংব ঊপড়হড়সু’। এর সংজ্ঞা প্রদান করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলেন, সাধারণত কোনো বাধা-বিপত্তি বা প্রতিকূলতা ছাড়াই একটি দেশের ভেতরে ও বাইরে যে কোনো ধরনের পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের সুবিধা বা নিয়মকানুন অব্যাহত রাখাই হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের মতে, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির পেছনে অদৃশ্য কোনো এক হাত থাকে।’ অদৃশ্য হাত উৎপাদন, পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এ বাজারে অবাধ প্রতিযোগিতা ও পণ্যর উপস্থিতিতে পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো আমদানি-রপ্তানির মাঝে কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারবে না। যে কোনো দ্রব্য যখন-তখন আমদানি ও রপ্তানি করা যাবে। এর উদ্দেশ্য হলো ভোক্তারা যেন বাজারে সঠিক পণ্য সঠিক পরিমাণে পেয়ে থাকে। এর পেছনে আরেকটি উদ্দেশ্য হলো দেশীয় পণ্যের সঙ্গে উন্নত পণ্যের সংমিশ্রণ ও জনপ্রিয়তা বাড়ানো। সরকার কোনো বিশেষ পণ্যের দর বা মূল্য নির্ধারণ করে দেবে না। রপ্তানি বাণিজ্য হবে অবাধ ও নিয়ন্ত্রণমুক্ত। উৎপাদন ও বাণিজ্যের কাজে সরকারি কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। বিদেশি বিনিয়োগকে সব সময় উৎসাহ ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। মূলত বাজারই হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু। এক্ষেত্রে বাজার থাকে অসংখ্য এবং প্রতিযোগিতামূলক। চাহিদা ও জোগানের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এই প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য।  মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো প্রতিযোগিতা।

বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারায় মুক্তবাজার অর্থনীতির শুভ ও অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন মহল মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। যদিও আধুনিক বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে মুক্তবাজার অর্থনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লাভ করেছে ব্যাপ্তি। এমন সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনেও পড়েছে এর অবশ্যম্ভারী প্রভাব। সাধারণত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুক্তবাজার অর্থনীতি বৈশিষ্ট্যর মাপকাঠিতে যা হওয়া দরকার—  উৎপাদন ও বাণিজ্য কার্যক্রমে সরকারের কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ আরোপিত হবে না, বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ উৎসাহিত করা হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীদের অনুরূপ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে, আমদানি ও রপ্তানিতে কোনো বাধা-নিষেধ থাকবে না। যে কোনো পণ্য দ্রব্য যতটা খুশি আমদানি ও রপ্তানি করা যাবে, রপ্তানি বাণিজ্য যেমন অবাধ, হস্তক্ষেপহীন ও মুক্ত অবস্থায় থাকবে, তেমনি কোনো ধরনের সহযোগিতা ও আনুকূল্য সরকার প্রদান করবে না। কোনো কোনো পণ্যের ওপর সরকারী ভর্তুকি বিলুপ্ত করতে হবে, পণ্য দ্রব্যের ওপর কোনো ‘ঞধৎরভভ ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ’ প্রদান করা হবে না। এর ফলে ভোক্তারা প্রতিযোগিতামূলক দরে ভালো পণ্য ক্রয় করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি উন্নত দেশের পণ্যের উন্নত মানের অনুরূপ দেশে উন্নত মানের পণ্য সৃষ্টির প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, বাজার কৌশলের ওপর ভিত্তি করে পণ্যদ্রব্যর মূল্য নির্ধারিত হওয়ায় সরকার কর্তৃক মূল্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা লোপ পাবে। মোটকথা মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে উদারীকরণ, আন্তর্জাতিকীকরণ, নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যক্তিমালিকানা প্রত্যাবর্তন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কয়েকটি বিষয়ের পুরোপুরি বাস্তবায়ন বাদে দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকাশ সাধন সম্ভব নয়।

উনিশ শতকের শেষের দিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাটি পরিষ্কার হতে থাকে। সে হিসেবে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণাটি নতুন কোনো ধারণা নয়। নতুন করে ১৯৭০ সালের দিকে এর ওপর জোরারোপ করা হয় বেশি। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়া গ্রহণ করে উন্নত দেশসমূহের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। অনুন্নত দেশসমূহের প্রতি শর্তারোপ করা হয় যে বিশ্বব্যাংক কিংবা উন্নত দেশের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিতে হলে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিতে হবে। বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়া ১৯৮৭ সালে গ্রহণ করে এবং ১৯৯১ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া জোরালোভাবে বাস্তবায়িত হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিক বিদ্যমান অবস্থা বিভিন্ন দাতা দেশের ঋণ, সাহায্য ও আনুকূল্যর ওপর নির্ভরশীল। উন্নয়নশীল বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি দ্রুততর করছে, তখন বাংলাদেশ নানা জটিল অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধ ও নিয়ম-কানুনের মারপ্যাঁচে হাবুডুবু খাচ্ছে। সার্ক এবং এ ধরনের আঞ্চলিক জোট ও অর্থনৈতিক জোট যেমন ঝঅচঞঅ মাধ্যমে এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহ উত্তরণের চেষ্টা করলেও এ গতি প্রকৃতি মসৃণ নয়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো অগ্রসর দেশের জন্য মুক্তবাজার অর্থনীতির চর্চা ও প্রসার সুফল বয়ে আনবে বলে আশা করা যায়।

বিশ্ব অর্থব্যবস্থার সঙ্গে মুক্তবাজার অর্থনীতির সংযোগ সড়ক স্থাপন করা সম্ভব হলেও এই পদ্ধতির রয়েছে নানা জটিলতা ও অনিবার্য পরিণতি। সাধারণত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সব সময় প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি থাকে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পারলে শিল্পের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পতিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের কুটির শিল্প বিলুপ্ত প্রায়। বিশেষজ্ঞদের মতে দারিদ্র্যক্লিষ্ট দেশগুলোর বাজার দখল করে রাখার জন্য উন্নত দেশগুলোর জন্য মুক্তবাজার অর্থনীতি সহায়ক। এই সুযোগে উন্নত দেশগুলো অন্য দেশের বাজার দখল করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করে। যেহেতু তারা ছাড়া নতুন উৎপাদন সৃষ্টি হচ্ছে না, তাই তারা বাজার দখল করে, পরে ইচ্ছেমতো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে অপেক্ষাকৃত উন্নত ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান প্রভৃতি দেশ সহজেই বাংলাদেশের বাজার দখল করছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো প্রতিবেশীর মুক্তবাজারের সুযোগ পাচ্ছে না বা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। ফলে ক্রমে হুমকির মুখে পড়ছে বাংলাদেশের শিল্প। বিশেষ করে আমাদের পাশের দেশ ভারত আমাদের দেশের বাজার পুরোটাই দখল করে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশ ভারতের বাজার দখল করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ। কেননা আমাদের দেশের বাণিজ্য ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এর পেছনে অনেকংশে দায়ী বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন শিল্প কারখানা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছে, ফলে কর্মহীন হচ্ছে মানুষ। পণ্যের অবাধ যাতায়াত ও সীমান্ত ব্যবস্থার শৈথিল্য থাকার কারণে দেশীয় পণ্য মার খাচ্ছে। তাই বিদেশিদের জন্য দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ায় দেশীয় শ্রমিকদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এতৎসত্ত্বেও মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন এটাকে বন্ধ করে দেওয়া কিংবা পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। তাই বাংলাদেশের উচিত মুক্তবাজার অর্থনীতি বিকাশে কাজ করে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে মুক্তবাজার অর্থনীতির গতি ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। যেমন— সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিরতা ফিরিয়ে আনতে হবে, দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করতে হবে, পূর্ণভাবে সংস্কার কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে, বিদেশি বিনিয়োগ প্রকৃত অর্থে উৎসাহিত করতে হবে, লোকসানি সরকারি খাত বন্ধ করে দিতে হবে, অনুৎপাদনশীল ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধ করে দিতে হবে, বন্দর পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি সাধন করতে হবে, কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে, গণমাধ্যমে মুক্তবাজার অর্থনীতি বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হবে।   

মুক্তবাজার অর্থনীতির যেমন ইতিবাচক দিক আছে তেমনি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। তবে নেতিবাচকতা পরিহার করে চীনকে মাইলফলক হিসেবে দেখে এই বাজার ব্যবস্থাকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহকে আরো বেশি কৌশলী হতে হবে। তবেই বাড়তে পারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকার গতি।

লেখক : ব্যাংকার
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!