• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিসিএস শিক্ষকতা ছেড়ে যে কারণে আমি বিদেশে ক্লিনার হলাম


রবিউল হাসান অক্টোবর ৮, ২০২০, ০১:৫২ পিএম
বিসিএস শিক্ষকতা ছেড়ে যে কারণে আমি বিদেশে ক্লিনার হলাম

ঢাকা: শিক্ষকতার প্রতি আমার প্রচণ্ড আগ্রহ আর ভালোবাসার কারণে ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে একজন প্রভাষক হিসেবে একটি সরকারি কলেজে যোগদান করেছিলাম। পাঁচ বছর পরে শিক্ষকতা ছেড়ে ক্লিনারের চাকরি নিয়ে পাশ্চাত্যের একটা দেশে চলে এসেছি। এখানে ক্লিনিয়ারদের ইন্জিনিয়ারের সমমর্যাদা দেয়া হয়।

আমি অর্থের মোহে এসেছি তা নয়, প্রতিকারহীন অমর্যাদাকর বৈষম্য আর বঞ্চনার গ্লানি থেকে মুক্তির জন্যে এসেছি। দেশে শিক্ষকদের বঞ্চনার কথা শোনার মতো কোনো অভিভাবক নেই – না কোন আমলা, না রাজনীতিবিদ। শিক্ষকদের বঞ্চনা আর বৈষম্যের ব্যাপারে দেশবাসীরও তেমন কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। সেই বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা সবাইকে জানাতেই আজকে আমার এই লেখা।

একবার অসুস্থতাজনিত কারণে একমাস ছুটি নিয়ে পরে ঐ ছুটিকালীন সময়কে আমার প্রাপ্য ছুটি দ্বারা সমন্বয় করে আমি ছুটিকালীন এক মাসের জন্য অর্ধেক বেতন পেলাম।অথচ আমারই এক বন্ধু একই রকম ঘটনায় পেলেন একমাসের পূর্ণ বেতন। আমি পেলাম না কারণ আমার অপরাধ আমি শিক্ষক ,আমি ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি।

অর্থাৎ আমার অর্জিত ছুটি অর্ধ-গড় বেতনে (প্রতি ১২ দিবসের জন্য একদিন প্রাপ্য) আর অন্যদের গড়/পূর্ণ বেতনে (প্রতি ১১ দিবসের জন্য একদিন) প্রাপ্য। অন্যরা এই উভয় ধরনের ছুটিই পেয়ে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমি সপ্তাহে ৬ দিন অফিস করেছি আর অন্যরা করেছে ৫ দিন (বছরে আমার থেকে ৫২ দিন কম)। তারপরও শিক্ষা বিভাগ ভ্যাকেশন বিভাগ! আমাকে গ্রীষ্মের ছুটি দিয়ে পুরো ছুটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এইচএসসি পরীক্ষা নিতে কলেজে যেতে হয়েছে (প্রতিবছরই একই ঘটনা)।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিকল্পিতভাবে এটা করে থাকেন। একবার বন্যার কারণে এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে গেলে পূর্ব-ঘোষিত গ্রীষ্মের ছুটিও পেছানো হয়েছিল পরীক্ষা আর ছুটি একসঙ্গে করার জন্য। ঈদের ছুটির সময়েও ঈদের ২/৩ দিন পূর্ব পর্যন্ত আমাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনার্স/মাস্টার্স পরীক্ষা নেয়ার জন্য কলেজে যেতে হয়েছে প্রতিবছর। ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার আগেই আবার পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে কলেজে যেতে হয়েছিল। তাহলে গড়ে বেশিদিন অফিস করেও আমাকে ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টের অপরাধে সুবিধা-বঞ্চিত করা হবে কেন? এর কোনো সুবিচার নেই।

(বিচার বিভাগ ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট হলেও তাঁরা সপ্তাহে ৫ দিন অফিস করেন এবং পুরো ডিসেম্বর মাস নিরবিচ্ছিন্ন ছুটি ভোগ করে থাকেন।) একজন শিক্ষককে নৈমিত্তিক ছুটি (সিএল) নিতে হলে লিখিতভাবে নিজ দায়িত্বে কর্তৃপক্ষকে আগে নিশ্চিত করে দিতে হয় তার অনুপস্থিতিতে ক্লাস কোন সহকর্মী নেবেন। অন্য কোনো অফিসে এ নিয়ম আছে কি না, জানি না। এই অবস্থা সত্ত্বেও শিক্ষকরা সারা বছর ছুটিতে থাকেন বলে দেশে গুজব ছড়ানো হয়।

কলেজে বৃহস্পতিবারে পূর্ণদিবস ক্লাস নিতে হয়। আমার চাকরি পাঁচ বছর হলেও আমি সিলেকেশন গ্রেডের বর্ধিত বেতনের সুবিধা পাইনি, যা চার বছর পূর্তিতে পাওয়ার কথা। অথচ অন্যান্য সার্ভিসে আমার বন্ধুরা এক বছর আগেই তা পেয়ে গেছেন। পাঁচ বছর পূর্তিতে কেউ কেউ পদোন্নতিও পেয়েছেন। আমি কত বছরে পদোন্নতি পেতাম তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। বাংলাদেশে ২৭১টি কলেজে আমার বিষয়টি পড়ানো হয় অথচ ২৭১টি কলেজের জন্য পূর্ণ-অধ্যাপকের পদ আছে মাত্র ১১টি। অর্থাৎ ২৬০টি কলেজে কোনো পূর্ণ-অধ্যাপকের পদ নেই আমার বিষয়ে। যদি কেউ অধ্যাপক হওয়ার চরম সৌভাগ্য অর্জন করেন তাহলে তিনি জাতীয় বেতনস্কেলের ৪র্থ গ্রেডে বেতন পাবেন।

১,২ এবং ৩ নম্বর গ্রেড তার জন্য হালাল করা হয়নি। কিন্তু আমার সাবজেক্টে সারাদেশে প্রায় ১০০০ শিক্ষক থাকলেও অধ্যাপক তো হতে পারবেন বৃদ্ধ বয়সে গিয়ে সর্বোচ্চ ১১ জন। বাকিরা সর্বোচ্চ সহযোগী অধ্যাপক হতে পারবেন, যাঁদের জন্য জাতীয় বেতনস্কেলের ৫ম গ্রেড পর্যন্ত হালাল করা হয়েছে। উল্লেখ্য, অধিকাংশ সরকারি কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক হতে পারেন না। তাঁদেরকে জাতীয় বেতনস্কেলের সর্বোচ্চ ৫ম গ্রেড পর্যন্ত গিয়েই অবসরে চলে যেতে হয়।

অন্যান্য কাডারের কর্মকর্তারা, বিশেষত প্রশাসন কাডারের কর্মকর্তারা ১, ২ এবং ৩ নম্বর গ্রেডের বেতন পেয়ে থাকেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজের সম্মানী বণ্টনের জন্য একটি পরিপত্র জারি করেছেন যেখানে অফিসের ৩য়/৪র্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারী পরীক্ষাসংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব পালন না করেই যেন একজন পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজের দায়িত্ব পালনকারী (১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা) শিক্ষকের থেকে বেশি সম্মানী পান, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

অথচ নিশ্চিত করা হয়েছে ৪র্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারী যেন ৩য় শ্রেণীর একজন কর্মচারীর থেকে বেশি সম্মানী না পান। শুধুমাত্র শিক্ষকদের অসম্মান এবং অপদস্থ করার জন্য এরকম প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে বলে আমি মনে করি। এই সম্মানীর অর্থ খুবই নগণ্য। এখানে অর্থ কোনো বিষয় নয়, বিষয়টি সম্মান ও মর্যাদার।

বাংলাদেশে প্রায় সব সার্ভিসে বিধি মোতাবেক অতিরিক্ত কাজের জন্য সম্মানী প্রদানের বিষয়টা প্রচলিত থাকলেও শুধুমাত্র শিক্ষকদের সম্মানীর ওপর ১৫% ভ্যাট দিতে হয়। অন্য কোনো সার্ভিসে অতিরিক্ত কাজের জন্য প্রাপ্য সম্মানীর ওপর কোনো ভ্যাট দিতে হয় না। যেমন অনেক জেলা প্রশাসক মাসে লক্ষাধিক টাকা সম্মানী পেলেও কোনো ভ্যাট দিতে হয় না। অথচ একজন শিক্ষক ১০০ টাকা সম্মানী পেলেও আগে তাকে ১৫% ভ্যাট দিতে হয়।

অন্যান্য সার্ভিসের ১ম শ্রেণীর অধিকাংশ কর্মকর্তা অফিসে যাতায়াতের জন্য সরকারি গাড়ি/ পরিবহন সুবিধা পেয়ে থাকেন বা পরিবহনভাতা ভোগ করেন। কিন্তু বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ (শিক্ষক) কোনো প্রকারের সরকারি পরিবহন সুবিধা বা ভাতা পান না। অথচ তাঁদের কর্মস্থলও বাসস্থান থেকে বেশ দূরে হতে পারে।

আমার সমস্ত প্রয়োজনীয় যোগ্যতা পূরণ হলেও আমার পদোন্নতি হবে না,কারণ এখানে চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম পদ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক সাধারণত পুরো চাকরিজীবনে মাত্র দু’বার পদোন্নতি পেয়ে অবসরে যান। অথচ প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা ৬/৭ বার পদোন্নতির সুযোগ পাবেন।

অন্যান্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের জন্য মাঠ-ঘাট, ক্ষেত-খামার বাগান সম্বলিত পৃথক বাড়ি (যেমন, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, প্রকৌশলী, জেলা জজদের বাসস্থান) বরাদ্দ দেয়া হলেও শিক্ষকদের জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই।

লেখক-রবিউল হাসান

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!