• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুলবুলে সুন্দরবনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তিন বছর লাগবে


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ২০, ২০১৯, ০১:০৯ পিএম
বুলবুলে সুন্দরবনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তিন বছর লাগবে

ঢাকা : ঘূর্ণিঝড় বুলবুল শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনে বাধা পেয়েছিল। ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পায় দেশ। অবশ্য এতে বনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

সুন্দরবন নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবনের এই ক্ষতি পোষাতে কম করে তিন বছর সময় লাগবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবারই ঝড়ে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের ওপরে প্রভাব পড়ে। প্রাকৃতিকভাবে এই ক্ষতি পুষিয়েও নেয় সুন্দরবন। বন বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুলবুলের প্রভাবে সুন্দরবনের পূর্ব এবং পশ্চিমে ক্ষতিগ্রস্ত গাছের একটি হিসাব বের করা হয়েছে।

এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ। গেওয়া ও সুন্দরী গাছের সংখ্যাই বেশি। মূলত শিবসা ও আড় পাঙ্গাসিয়া নদীতীরবর্তী এলাকার গাছগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গাছের ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব নয়। নতুন করে রোপণও করা যায় না।

ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছগুলো প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে। গাছ কাটা না হলে এই ক্ষতিপূরণ হতে খুব বেশি হলে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে, এমনটা মনে করেন সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সুন্দরবনের প্রতি আরো যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি চুরি করে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে ক্ষতির এই মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

সুন্দরবনকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে দিলে, আর অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়লে, এই ক্ষতি পোষাতে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে। তবে বনের ওপর চাপ বাড়ালে সহজে ক্ষতি পোষানো যাবে না।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ‘সুন্দরবন প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। আর ঘূর্ণিঝড় বুলবুলও প্রাকৃতিকভাবেই হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ সুন্দরবন তার নিজের মতোই করে নেবে। শুধু এটুকু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে-যেন কেউ সেই উপড়ে পড়া গাছ সরাতে না যায়। উপড়ে পড়া গাছ থেকেই আবারো নতুন গাছের প্রাণ আসবে।

কিন্তু সেই গাছ সরাতে গেলে বনের যে ইকোসিস্টেম আছে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা বনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। ফলে কেউ সুন্দরবনের ভেতরে গিয়ে গাছের ইকোসিস্টেম যেন নষ্ট না করে, সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বুলবুলের কারণে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো গাছের ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিপূরণ হতে খুব বেশি হলে এক বছরের মতো সময় লাগতে পারে। তবে তার চেয়েও বড় গাছ পেতে হলে আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।’

বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘এবার ঝড়ে চার হাজার ৪৮৯টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পূর্ব সুন্দরবনে ৫৮৭টি, আর পশ্চিম সুন্দরবন বন বিভাগের অধীন পড়েছে তিন হাজার ৯০০টির মতো গাছ। ক্ষতিগ্রস্ত গাছের মধ্যে গেওয়া, গরান ও সুন্দরী গাছের সংখ্যা বেশি।

এ ছাড়া, আমাদের বাগানে (সংরক্ষিত) কিছু গাছ ছিল। সেগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গাছগুলোর বয়স খুব বেশি না। বড় গাছ কম। বেশিরভাগই ছোট গাছ। মাঝারি গাছও কিছু আছে। গাছের বয়স বলা কঠিন, তবে উচ্চতা হিসেবে এক থেকে দেড় ফুট উচ্চতার গাছই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘এই ক্ষতিপূরণের জন্য আলাদা করে গাছ রোপণের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, বাইরে থেকে গাছ রোপণ করা হলে সেটি সাধারণত রাখা যায় না। প্রাকৃতিকভাবেই সেখানে গাছ হয়। তাই যদি আনকাট অর্থাৎ গাছ না কাটা হয়, তাহলেই এই ক্ষতি প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ হয়ে যাবে। আমরা আশা করছি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।’

সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমাদের পূর্ব বন বিভাগের প্রায় ৫৮৭টি গাছ উপড়ে গেছে। এর মধ্যে রেইনট্রি ও ঝাউ গাছ আছে। আমাদের অফিস কম্পাউন্ডের কিছু গাছ পড়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল রেইনট্রি। এ ছাড়া শিশু, মেহগনি, আমগাছও ছিল। আর বনের ভেতরে উপড়ে পড়া গাছের মধ্যে কিছু সুন্দরী, কিছু গেওয়া ছিল।’

তিনি বলেন, ‘গাছের বয়স নির্ধারণ করা কঠিন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত কম্পাউন্ড এলাকায় নতুন করে গাছ রোপণ করা হবে।’

উপড়ে পড়া গাছগুলো কী করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুধু লোকাল এলাকায় যেগুলো পড়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করে বিক্রি করা হবে।’ কিন্তু বনের ভেতরে যেগুলো পড়েছে, সেগুলো প্রাকৃতিকভাবেই ঠিক হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

ক্ষতিপূরণের সময়ের বিষয়ে আরো বেশি আশাবাদী খুলনার সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বশিরুল আল মামুন। তার এলাকায় গাছ উপড়ে পড়ার সংখ্যা অনেক বেশি। তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা ঘূর্ণিঝড় সিডরের তুলনায় কিছুই নয়। আশা করি, এই ক্ষতিপূরণ হতে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে।’

বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরী বলেন, ভেঙে যাওয়া গাছ কেটে বন থেকে বের করে আনার ব্যাপারে অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে সিডর ও আইলার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, ভেঙে যাওয়া গাছ কেটে না ফেলে তা বনের মধ্যেই রেখে দেওয়া উচিত। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সুন্দরবনের গাছের আরো বেশি ক্ষয়ক্ষতি হলেও তা প্রাকৃতিকভাবে ঠিক হয়ে যাবে। এ জন্য আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত করে দিয়েছে বন বিভাগ।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক এবং গবেষক ড. মাহামুদ হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবন বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলের মানুষকে রক্ষা করে চলেছে। প্রাকৃতিক দেওয়া হিসেবে কাজ করছে সুন্দরবন। ১৫৮৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবন ৭৪টি বড় ধরনের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করেছে।

এ জন্য সুন্দরবনকে রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে উপকূল অঞ্চলে বনায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে সুন্দরবনে পর্যটকদের ক্যারিং ক্যাপাসিটির ওপর পূর্ণাঙ্গ গবেষণায় গুরুত্বারোপ করতে হবে।’

উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অখণ্ড বনভূমি। প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারজুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটারের অবস্থান বাংলাদেশে। বাকি অংশ পড়েছে ভারতের পশ্চিমবাংলার মধ্যে। সংগত কারণে ঝড়ের পরপরই ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার গাছের ক্ষতি নির্ধারণ করা কঠিন বিষয়। ফলে প্রকৃত ক্ষতি আরো বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সুন্দরবনে জালের মতো ছড়িয়ে আছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তনের দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১ ভাগেই রয়েছে নদীনালা, খাড়ি, বিল মিলিয়ে জলাভূমি অঞ্চল।

বনভূমিটি স্বনামে খ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। ঝড়ে শুধু বৃক্ষই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে প্রাণীরও। যদিও এর হিসাব করা খুব সহজ কাজ নয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!