• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বেতন নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের দুঃসংবাদ


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ২৯, ২০১৯, ০৬:৫৭ পিএম
বেতন নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের দুঃসংবাদ

ঢাকা: পে-স্কেল কার্যকরের চার বছরের মধ্যেই সরকারি কর্মচারীরা নতুন করে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবি তুলেছিলেন। মহার্ঘ ভাতা ক্ষেত্রবিশেষে ইনক্রিমেন্ট দাবি করেছিলেন তারা। তবে সরকার কর্মচারীদের কোনো দাবিই আমলে নিতে নারাজ।

এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, গত ১০ বছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা যে হারে বেড়েছে, স্বাধীনতা-উত্তর আর কোনো সময়ই সেভাবে বাড়েনি। তাদের কাছ থেকে এজন্য সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এই সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বরাবরই সক্ষম হয়েছে। সর্বশেষ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির পর কোনো বছরই ওভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। এবার শুধু পেঁয়াজে একটু সমস্যা হয়েছিল। বাকি সব ঠিক আছে। ফলে নতুন করে বেতন-ভাতা বাড়ানোর পরিকল্পনা আপাতত নেই।

সর্বশেষ বেতন-ভাতা বাড়ানোর সময় স্থায়ী পে-কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল সরকার। বাজারের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিল রেখে সময়ে-সময়ে বেতন সমন্বয় করার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। প্রতিশ্রুত সেই স্থায়ী পে-কমিশন গঠন করা হয়নি।

স্থায়ী পে-কমিশন গঠন করা হবে কি না, জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, স্থায়ী পে-কমিশন করতে হলেও তো তাদের বেতন-ভাতা দিতে হবে। সরকার এ খাতে ব্যয় বাড়ানোর আপাতত কোনো চিন্তা-ভাবনা করছে না।

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ সচিবালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি। নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের এ সংগঠন বেতন বাড়ানোর দাবি জানালেও এর নেপথ্যে রয়েছেন সব শ্রেণির ক্যাডার কর্মকর্তা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিবেচনার জন্য এ আবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমিতিও বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সভায় বেতন বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিগগিরই বেতন বৃদ্ধির আবেদন জানাবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কয়েকজন সিনিয়র নেতা।

এসব সংগঠনের আগে ২০১৭ সালের ৯ মে সরকারি কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ বেতন-ভাতা নির্ধারণ ও পরিবর্ধনের বিষয় পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের (সমন্বয় ও সংস্কার) নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় ও অর্থ বিভাগের প্রতিনিধিরা সদস্য ছিলেন। উচ্চপর্যায়ের ওই কমিটি সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করার সুপারিশ করেছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ সচিবালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়াসহ নানা কারণে জীবনযাপন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারি কর্মচারীদের জন্য তিনটি বিশেষ ইনক্রিমেন্টের দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে নবম বেতন কমিশন গঠনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে।

সমিতির আবেদনে বলা হয়েছে, ‘বেতন স্কেল জারি হওয়ার প্রায় পাঁচ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। ইতিমধ্যে সরকার বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, কল্যাণ ফান্ড, যৌথবীমা, পরিবহন খরচসহ অন্যান্য বিল কয়েক গুণ বৃদ্ধি করেছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেসরকারি বাসাভাড়া, পরিবহন, ওষুধ-চিকিৎসা, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। কর্মচারীদের প্রতি বছর একটি বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট হিসেবে ৫০০-১০০০ টাকা বাড়লেও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায় কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা; যা বর্তমানে আরও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া বর্তমান বেতন স্কেলে টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড সুবিধা না থাকায় নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারীদের সংসার পরিচালনা করতে আরও বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

গত মাসে বাংলাদেশ সচিবালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে তিনটি ইনক্রিমেন্টসহ নতুন পে-কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে এ চিঠি লেখে। এর ধারাবাহিকতায় ১ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব (প্রতিকল্প) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ইনক্রিমেন্ট ও নবম বেতন কমিশন গঠনের আবেদন বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অর্থ বিভাগের সচিবের কাছে পাঠান।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুজ্জামাল বলেন, মহার্ঘ ভাতা না চেয়ে আমরা ইনক্রিমেন্ট চেয়েছি। কারণ মহার্ঘ ভাতা বেতনের সঙ্গে মার্জ (মিলিয়ে দেয়া হয়) হয়ে যায়। ২০১৩ সালে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিয়েছিল সরকার। এই ভাতার আওতায় সর্বোচ্চ ৬ হাজার আর সর্বনিম্ন ১ হাজার ৩০০ টাকা বেড়েছিল। বেতন শতভাগ বাড়লেও তাতে ২০ শতাংশই ছিল মহার্ঘ ভাতা। তিন বছর পরে যখন বেতন শতভাগ বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হলো, তখন কার্যত বেতন বেড়েছে ৮০ শতাংশ। এর সঙ্গে যদি টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড যোগ করা হয় তাহলে বেতন বৃদ্ধির হার আরও কমে যায়। গত বেতন স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড কর্তন করা হয়েছিল। ১৯৭৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোট সাতটি পে-স্কেল দেওয়া হয়। সবগুলো পে-স্কেলেই টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয়। ২০১৫ সালে এসে সেই আর্থিক সুবিধাগুলো কর্তন করা হয়েছে। নন-ক্যাডার কর্মচারীদের পদোন্নতির সুযোগ খুবই সীমিত। অনেক পদে পদোন্নতির কোনো সুযোগই নেই। এসব বিবেচনা করে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড দেওয়া হতো। যেহেতু টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থাকছে না এবং মহার্ঘ ভাতা চাচ্ছি না, সে কারণেই তিনটি ইনক্রিমেন্ট চাওয়া হচ্ছে।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা সমিতি ছাড়াও তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমিতি বেতন বৃদ্ধির কথা বলেছে। তারা ৩০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দাবি করেছে। গত ১৫ নভেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে সমিতির ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে তারা এ দাবি জানায়।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ২০১৫ সালে জাতীয় বেতন স্কেল প্রদানের পর ইতিমধ্যে প্রায় ৩২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ও গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি কর্মচারীরা অর্থকষ্টে জীবন যাপন করছেন। তাই মূল বেতনের ৩০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা ও চিকিৎসা ভাতা ৩ হাজার টাকায় উন্নীত করার দাবি জানান তারা।

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের বিভিন্ন সভায় বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন বলেন, জিনিসপত্রের দাম অকল্পনীয় হারে বেড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষ কাঁচাবাজারে ঢুকতে পারে না। পেঁয়াজ, চিনি, চালসহ কোনটার দাম বাড়েনি? শহরাঞ্চলে সীমিত আয়ের মানুষের টিকে থাকার কোনো উপায় নেই। সরকার শতভাগ বেতন বাড়িয়েছে সত্য কথা। কিন্তু সেই বেতন বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর আগে। এরপর বছর বছর যদি বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করা হতো তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। সরকার তো পাঁচ বছর আর বেতনে হাত দেয়নি। যতই বেতন বাড়ান, তা যদি বছর বছর সমন্বয় করা হতো তাহলে সমস্যা ছিল না। সমন্বয় না করায় এখন মনে হচ্ছে এত বেতন বাড়ানোর পর আবার কেন বেতন বাড়ানোর কথা বলা হয়। শিগগিরই স্থায়ী পে-কমিশন করা দরকার। স্থায়ী পে-কমিশন হলে কেউ আর বেতন বৃদ্ধির কথা বলবে না।

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর পর সাংসদ, মন্ত্রী, স্পিকার, বিচারপতি, বিভিন্ন কমিশনে কর্মরতদেরসহ সব সরকারি সেক্টরে বেতন বাড়ানো হয়। সরকারি মালিকানাধীন বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বেতন বাড়ানোর জন্য আলাদা পে-কমিশন গঠন করা হয়। বেসরকারি খাতের মধ্যে পোশাকশ্রমিকদের বেতন কত হবে তা সরকার নির্ধারণ করে দেয়। ২০১৫ সালের পর তাদের নতুন পে-স্কেল দেয়া হয়।

সরকারের সব সেক্টরে বেতন বাড়ানোর প্রভাব পড়ে বেসরকারি চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষের ওপর। কারণ সরকার কর্মচারীদের বেতন বাড়ালেও বেসরকারি চাকরিজীবীর বেতন বাড়ানোর কোনো দায়িত্ব নেয় না। এ কারণে ২১ লাখ সামরিক-বেসামরিক কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ।

সর্বশেষ অষ্টম বেতন স্কেলের আওতায় বেতন বৃদ্ধির গেজেট ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর জারি হলেও বর্ধিত বেতন বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে। অষ্টম পে-স্কেলের আওতায় ২০টি গ্রেডের মধ্যে সর্বোচ্চ বেতন ছিল ৭৮ হাজার টাকা আর সবনিম্ন বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, এর আগের ৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির গড় হার ৬ শতাংশের ওপরে ছিল। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর থেকে ক্রমান্বয়ে কমেছে। ওই বছর গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। পরের বছর সেটি কমে দাড়ায় ৬ দশমিক ৪১ শতাংশে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই হার আরও কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৯২ শতাংশে। এর পরের বছর আরও কমে হয় ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে যায়। ওই অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গেল অর্থবছরে সরকারের বাজেটে ঘোষিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সীমার বাইরে যায়নি। বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুসারে, চলতি অর্থবছরের ৪ মাসে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে। পেঁয়াজের কারণে সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছিল। তবে সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশে দাঁড়ায়।

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!