• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখ কেন্দ্র করে বেঁচে আছে মৃৎশিল্প


নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ২৬, ২০২০, ০৩:৪৩ পিএম
বৈশাখ কেন্দ্র করে বেঁচে আছে মৃৎশিল্প

ঢাকা : একসময়কার রমরমা মৃৎশিল্প এখন অনেকটাই সংকুচিত। পুরনো ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বৈশাখী মেলায় এখনও এর কদর আছে, তবে বিদেশে রফতানিকে কেন্দ্র করে নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস রোধে এবছর দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন ও মেলা না হওয়ায় মৃৎশিল্প বেশ ধাক্কাই খেয়েছে।

একই কারণে পাঁচ-ছয় মাস ধরে রফতানি বাণিজ্যও স্থবির। ফলে সবদিকের ব্যবসা হারিয়ে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত লাখ লাখ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় কষ্ট।

তবে বর্তমান ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতিতে তাদের তৈরি পণ্যের চাহিদা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকায় কিছুটা আশান্বিতও তারা। কিন্তু আগের মতো বাণিজ্যের জন্য তাদের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ফের বিদেশি অর্ডার ফেরা এবং আগামী বৈশাখের অপেক্ষায়।

মৃৎশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা বছর মৃৎশিল্পীদের তৈরি পণ্যের ব্যবসা টুকটাক হয়। মূল ব্যবসা হয় পহেলা বৈশাখের দিন এবং সারা দেশের বৈশাখী মেলাগুলোতে। কিন্তু করোনার কারণে এই বছর বাঙালির চিরাচরিত ঢঙে উদযাপন হয়নি পহেলা বৈশাখ। অনুষ্ঠিত হয়নি বৈশাখী মেলাগুলো। একইসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে বিদেশে রফতানি মালের অর্ডারও।

শুধু তাই নয়, রমজানে ইফতার বাজারকেন্দ্রিক হালিম ও দধির কাজের ব্যবহৃত মাটির পাত্রের যে ব্যবসা হতো, সেটিও এবার হয়নি। ফলে এবছর সবদিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সব মহলের মানুষের জীবনে দুর্দিন নেমে আসে।

কুমিল্লার বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি তাপস পাল বলেন, করোনার কারণে এপ্রিল-মে দুই মাস আমাদের সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। জুন থেকে আমরা স্বল্প পরিসরে কাজ করছি। আমাদের ৫০ জন কর্মী আছেন। তারমধ্যে এখন পর্যায়ক্রমে ২৫ জন করে কাজ করছেন। তাদের বেতন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। বিক্রি না থাকার কারণে একসঙ্গে সবাইকে কাজ করাতে পারছি না। তারাও এই অবস্থা মেনে নিয়েছেন। শিল্পীদের অবস্থাও খারাপ। যারা সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা বেতন পেতেন, এখন তাদের আমরা ৪-৫ হাজার টাকা দিতে পারছি।

১৯৬১ সালে কুমিল্লার সাতটি গ্রামের কুমার ও পালদের নিয়ে এই সমিতি গড়ে ওঠে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাত গ্রামে সাত শতাধিক পরিবার আছে। এখানে বেশিরভাগ কুমার স¤প্রদায়ের লোক, যারা জন্মগতভাবে মৃৎশিল্পী। এখন প্রতিষ্ঠানের কাজ করে প্রায় ৫০ জন। এর বাইরে এই সাত গ্রামের অন্যরা নিজেদের বাড়িতে হাঁড়ি-পাতিলাসহ অন্যান্য পণ্য তৈরির কাজ করেন।

বৈশাখকে কেন্দ্র করে সারা বছর মৃৎশিল্পীরা পরিশ্রম করে জানিয়ে তাপস পাল বলেন, বৈশাখের সময় বিভিন্ন জায়গায় মেলা হয়। বৈশাখী মেলার পাশাপাশি বাণিজ্য মেলাও হয়। চট্টগামের লালদিঘির মাঠে প্রতিবছর তিন-চার দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা হতো, এটাকে ধরা হয় মৃৎশিল্পের বড় মেলা। এই মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের কাছে অর্ডার আসতো। এই বছর মেলাও হয়নি, অর্ডার নেই। আমাদের আয়ও নেই। এখন আগামী বৈশাখে দিকে চেয়ে থাকতে হবে।

এই সমিতির জেনারেল ম্যানেজার শাংকর পাল বলেন, প্রতি বছর আমাদের এখান থেকে ৪০-৫০ লাখ টাকার মাল বিদেশে রফতানির অর্ডার পেতাম। এই বছর এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত কোনও বিদেশি অর্ডার আসেনি। এখন ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই। ঢাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের তৈরি পণ্য বিভিন্ন দেশে যেতো। জানুয়ারিতে কিছু অর্ডার পেয়েছি। সেগুলো এখন তৈরি করছি। কারণ গত কয়েক মাস তো সবকিছুই বন্ধ ছিল।

বরিশালের উজিরপুরের মৃৎশিল্পের কারিগর সুকুমার পাল বলেন, আমি নিজেই মাল বানাই এবং বিক্রি করি। কিন্তু মৃৎশিল্পীরা তো এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। প্লাস্টিক বের হওয়ার কারণে কোনও মালের চাহিদা নেই। করোনার প্রথম তিন মাসে ঘর থেকে কোনও মাল নেয়নি পাইকাররা। এখন টুকটাক চলে, কিন্তু কোনও পাইকার আসছে না। রমজান মাসে দধির পাতিলা, হালিমের পাতিলা বেশি বিক্রি হতো। এবছর সেটি হয়নি।

অনেকটা অসহায় কণ্ঠে সুকুমার পাল বলেন, এখন এটা ছেড়ে যেতেও পারছি না। কারণ বৌ-মা, মেয়ে-ছেলে নিয়ে সবাই মিলেই কাজ করি। তারপরও দেখা যায় বছর শেষে আমাদের কোনও পুঁজিই থাকে না। এখন আমরা অন্যকাজে গেলে মানুষ হাস্যরস করবে, তাই যেতেও পারছি না। কিছু ছালান (পুঁজি) থাকলে অন্য ব্যবসা করা যায়। সেই ছালানটাও নেই।

রাজধানীর কলাবাগান ধানমন্ডি রোডের সড়কের ফুটপাতে মৃৎশিল্পের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন মো. নয়ন এবং মনির হোসেন। দুজনই রঙ তুলি দিয়ে মাটির তৈরি এসব পণ্যের গায়ে আলপনা আঁকছেন।

নয়ন বলেন, আমরা দোকানের কর্মচারী। করোনার কারণে গত এপ্রিল থেকে দোকান বন্ধ ছিল। আগস্ট থেকে আবার আমাদের কাজ শুরু হয়েছে। আগে দিনে এখানে ৫-৭ হাজার টাকা করে বিক্রি হতো। এখন ২ হাজার টাকা বিক্রি করতেও কষ্ট হয়। বিক্রি না থাকায় সারাদিনে মালিক একবার দোকানে আসেন। আসলে মৃৎশিল্পের পণ্যের ব্যবসা মূলত মেলাকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। এখানে সারা বছর যা বিক্রি হয়, দুই-তিন দিনের মেলায় তার কয়েকগুণ বেশি বিক্রি হয়। চট্রগ্রামের তিন দিনের বৈশাখী মেলা আমাদের ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা বিক্রি হতো।

এছাড়া খুলনা, সোনরাগাঁ, রংপুর, ফেনী, মাগুরাসহ দেশের প্রতিটি জেলায় যেসব বাণিজ্য মেলা হয়, সেগুলোয় স্টল দিয়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হতো। এবছর তো সব শেষ হয়ে গেছে। এখন আগামী বছরের জন্য অপেক্ষা।

জানা গেছে, দেশের মৃৎশিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত পাল ও কুমার বংশের লোকেরা। বংশ পরম্পরায় তারা এই পেশায় এসেছে। এই শিল্পের কারিগররা অধিকাংশ নিম্ন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। বছরের ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ এই চার মাস তারা মৃৎশিল্পের কাজ করতে পারে পুরোদমে। বাকি সময় খুব একটা কাজ হয় না। এই চার মাসের তৈরি পণ্যের আয় দিয়ে তাদের সারা বছরের জীবন-জীবিকা চলে।

অন্যদিকে শিল্পীদের অনেকে এখনও সনাতনি পদ্ধতিতে কাজ করেন। তবে বড় অংশ আধুনিক পদ্ধতিতে মেশিনে পণ্য তৈরি করেন। দেশে ও বিদেশে আধুনিক মৃৎশিল্পের চাহিদা বেশি।

বরিশালের সুকুমার পাল বলেন, 'আমরা মেলার বা বিদেশের মাল বানাই না, লোকাল মাল বানাই। হাঁড়ি, পাতিল, কলস, ভুটা টালি ও দধির পাতিলা এসব জিনিস বানাই। ঢাকাসহ অন্য জায়গায় যেসব মাল বিক্রি হয়, সেইগুলোর ভিন্ন কারিগর আছে। তারা মোটামুটি খাই-লয়ে ভালো আছে, কিন্তু সেগুলো বানানো তো আমরা শিখি নাই।'

কুমিল্লার বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি তাপস পাল বলেন, মাটির তৈরি পণ্য প্রথমে শুকাতে হয়। এরপর আগুনে পোড়ানো হয়। এই কারণে বর্ষার সময় মৃৎশিল্পীরা কাজ করতে পারে না। আবার মাটিরও একটা বিষয় আছে।

কুমিল্লার বিজয়পুরের শান্তি পাল বলেন, হাতে সব মাল তৈরি করা যায় না। আবার হাতের তৈরি মাল দেখতে সুন্দর হয় না। মেশিনে তৈরি মাল দেখতে সুন্দর হয়, এইগুলোতে নকশাও বেশি ফুটে ওঠে। এজন্য যেমন আধুনিক যন্ত্রপাতি দরকার হয়, তেমনি প্রশিক্ষণও থাকা লাগে।

বর্তমানে কুমিল্লার বিজয়পুরের মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে বলেও জানিয়ে তাপস পাল বলেন, এটা সরকারের এটা প্রজেক্ট ছিল, সেটার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।

সংকটের কারণ গ্যাসের স্বল্পতা এবং প্লাস্টিকের সহজলভ্যতা : মৃৎশিল্পীরা বলছেন, ৭০-৮০ দশকের গ্রামবাংলার প্রতিটি পরিবারে থাকতো মাটির কসল, হাঁড়ি, পাতিল, প্লেট, গ্লাস ও ঢাকনা। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, সিরামিক এবং পিতলের তৈরি পণ্য। এসব পণ্যের সহজলভ্যতা এবং টেকসই হওয়ার কারণে মানুষের কাছে মৎশিল্পের চাহিদা কমে গেছে।

এই শিল্পের জন্য এটা তো একটা সংকট, তারচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে গ্যাস। কারণ আগুনে পোড়ানা ছাড়া মৃৎশিল্প বিক্রির উপযোগী হয় না। কিন্তু কাঠ বা কয়লার আগুনে পোড়ালে জিনিসের গুণগত মান যেমন ঠিক থাকে না, তেমনি ব্যয়ও বেড়ে যায়। বিদেশেও রফতানি করতেও সমস্যা হয়। অন্যদিকে গ্যাসের আগুনে পোড়ালে গুণগত মানও ভালো থাকে, দেখতেও সুন্দর হয়। ফলে সহজে বিদেশে ক্রেতাদের আকর্ষিত করা যায়।

মৃৎশিল্পের কারিগর সাধন পাল বলেন, এখন মানুষ নিত্য ব্যবহারের জন্য মাটির হাঁড়ি-পাতিল কেনে না। শখের বসে কেউ কেউ নেয়। কিন্তু আগে সব ঘরে মাটির তৈরি জিনিস থাকতো। এখন বড়লোকেরা পহেলা বৈশাখ এলে আমাদের মাটির প্লেটে পান্তা-ইলিশ খায়। আর সারা বছর কোনও খবর থাকে না। মৃৎশিল্পের বড় সংকট প্লাসিক ও পিতল।

তিনি আরও বলেন, গ্যাসে একসঙ্গে অনেক পণ্য পোড়ানো যায়। যেটা কাঠের আগুনে সম্ভব নয়। আবার কাঠের আগুনে পোড়ানো জিনিস সুন্দর না হওয়ায় ভালো দাম পাওয়া যায় না।

কুমিল্লার বিজয়পুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির সভাপতি তাপস পাল বলেন, 'শুরুতে আমরা কাঠ, পরবর্তীতে কয়লা, এরপর কারেন্টে পোড়ানোর কাজ করতাম। কিন্তু সর্বোচ্চ ভালো হয় গ্যাসের পাইপে পোড়ালো। ১৯৯১ সালে গ্যাস সংযোগের পরে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক উন্নতি হয়। গ্যাসের ফায়ারিংয়ে পণ্যের গুণগত মান ভালো হওয়ার সহজে বিদেশে রফতানি করতে পারছি। কিন্তু এখন সেই গ্যাসই আমাদের মূল সমস্যা। ২০১৭ সাল থেকে গ্যাস একরকম বন্ধই হয়ে গেছে।

২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত গ্যাস না পুড়িয়ে প্রতিমাসে বিল দিয়েছি ৬২ হাজার টাকা করে। এখন তো গ্যাস নেই। মৃৎশিল্পের শৈল্পিক যে বিষয়টা সেটা গ্যাসের বাইরে কাজ করলে মানসম্পন্ন হয় না।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!