• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বড় চ্যালেঞ্জের মুখে নির্বাচন কমিশন


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ৬, ২০২০, ০৪:৩০ পিএম
বড় চ্যালেঞ্জের মুখে নির্বাচন কমিশন

ঢাকা : আসন্ন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে তিন বছর পূর্ণ করেছে। এই কমিশনের অধীনে সামনে থাকা নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন।

কশিনের মেয়াদের বাকি সময়ের সম্ভাব্য নির্বাচনের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ৩০ জানুয়ারির এই নির্বাচন ঘিরে। সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বৈতরণি পার হতে হবে কমিশনকে।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রথম দুটি নির্বাচন-কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সফলতা ছিল। কিন্তু বেশিদিন সেটি থাকেনি। পরে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তিনটির বিষয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে।

বরিশাল সিটি করপোরেশন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভিন্ন বার্তা যায়। ২০১৫ সালে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ব্যাপক অনিয়মের তথ্য এসেছে সংবাদমাধ্যমগুলোতে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ৩০ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে, এমনটি আমি আশা করি না। তাদের অতীতের যে কর্মকাণ্ড, তাতে এই কমিশন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়।

সাবেক এই উপদেষ্টা স্পষ্ট করে বলেন, নির্বাচন কমিশনের যে সততা ও কর্মদক্ষতা থাকা উচিত সেটি নেই। ফলে নির্বাচন ভালো হবে-এটা আশা করা যাচ্ছে না।

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের প্রসঙ্গ টেনে সুজন সভাপতি বলেন, অনেক বিশেষজ্ঞই এটির ব্যবহার চাননি। এমনকি বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীও কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন ইভিএম ব্যবহার না করতে। তবে কেন এটি করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক প্রার্থী এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন।

আমিও মনে করি, এখনই শতভাগ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারের দরকার ছিল না।

গত ১২ ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাচন কমিশন নিয়ে একটি বিবৃতি পাঠায় সংবাদমাধ্যমে।

নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছে তা অভূতপূর্ব ও গোটা জাতির জন্য বিব্রতকর বলে টিআইবি মন্তব্য করেছে ওই বিবৃতিতে।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের হাতে এমন রাষ্ট্রের অমর্যাদা বন্ধ করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনারকে আশু অপসারণ ও নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই উল্লেখ করে মহামান্য রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে সংস্থাটি।

বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার, কমিশন সচিবালয় এবং অন্যান্য কমিশনারদের ন্যক্কারজনক কাদা ছোড়াছুড়ির যে খবর দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তা অভূতপূর্ব ও গোটা জাতির জন্য বিব্রতকর।

অন্তত একজন কমিশনার একজন নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের জন্য কমিশন সচিবালয়কে সুপারিশ করেছিলেন বলে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়। সেই সুপারিশ রক্ষা করা হয়নি বলে কমিশনাররা তোলপাড় করেছেন।

সাংবিধানিক পদে থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ যে সরাসরি নৈতিক স্খলন সেটা অনুধাবন করার মতো অবস্থাতেও নির্বাচন কমিশনাররা নেই। অন্যদিকে কমিশন সচিবালয়ের সঙ্গে কমিশনারদের অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বন্দ্বের সংবাদ এই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাকে পদদলিত করেছে।
সাংবিধানিক পদাধিকারীরা যখন নিজেদের সচিবালয়ের বিরুদ্ধেই অনিয়মের অভিযোগ করেন তখন সেটার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। দেশের সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি।’

এই নির্বাচন কশিমন গোটা জাতির মাথা হেঁট করে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ড. জামান।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, সেই সত্যটাও কমিশন সংশ্লিষ্টরা সম্ভবত ভুলে গেছেন। তাদের অধীনে ভবিষ্যৎ যেকোনো কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এহেন অবমাননাকর অধ্যায়ের শেষ হওয়া দরকার।

ব্যর্থতা এবং নৈতিক স্খলনের দায় নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্যান্য কমিশনাররা যে সরে যাবেন না সেটা এতদিনে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।

তারা তাদের শপথের অবমাননা করছেন, সংবিধান অবমাননা করছেন এবং নিয়োগকর্তা হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অসম্মানের ঝুঁকি সৃষ্টি করছেন।

আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রতি সশ্রদ্ধ আবেদন করছি, এই বিতর্কিত ব্যক্তিদের দ্রুত অপসারণের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। পাশাপাশি এ পর্যন্ত যত অনিয়ম হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তার তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’

তবে বিগত দিনের পরিস্থিতি যাই হোক, ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না সাধারণ ভোটাররা ও বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি।

এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থীই।

দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা দিয়ে বিএনপি প্রার্থীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। অপরদিকে উত্তরের তাবিথ আউয়াল নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন।   

ঢাকার দুই সিটির ভোট ইসির জন্য চ্যালেঞ্জিং বলে মত দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা।

ভোটারদের প্রসঙ্গ টেনে কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, ভোটাররা যেন তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। ভোটাররা যেন পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারেন। এই দুই সিটির ভোট ইসির জন্য চ্যালেঞ্জিং। নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। দল দেখে প্রার্থীদের প্রতি আচরণ করা যাবে না। এবার নিরপক্ষে ভোট হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মোটাদাগে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে নির্বাচন কমিশন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, ভোটের সময় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঠিক ভূমিকা, অভ্যন্তরীণ বিরোধ থেকে নিজেদের দূরে রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে এই দুই সিটির নির্বাচনে সাধারণ মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

একই সঙ্গে অংশগ্রহণকারীরা যাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পান সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে অন্য যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের সমান সুযোগ দিতে হবে।

নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

তিনি বলেছেন, কেন নির্বাচন নিরপেক্ষ, শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হয় না- এ প্রশ্নের উত্তর আত্মজিজ্ঞাসার কারণেই আমাকে খুঁজতে হয়েছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন আইনত স্বাধীন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দি।

নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যদি গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের পদযাত্রা অবারিত করতে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হতে হবে।’

ঢাকায় সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে ইভিএমে ভোট গ্রহণের বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নেমেছে নির্বাচন কমিশন। এর আগে অনেক নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হলেও অর্ধ কোটিরও বেশি ভোটারের ভোট গ্রহণের পরিকল্পনা ছিল না। এবার সেই ঝুঁকি নেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ছয়টি আসনে সম্পূর্ণ ইভিএমে ভোট হয়।

এ আসনগুলোতে ২১ লাখ ভোটার ছিলেন। ওই নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার প্রত্যাশিত ছিল না। ঢাকার দুই সিটিতে ভোটারই আছেন ৫৪ লাখের বেশি।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই করপোরেশনে বিএনপির প্রার্থীরা জানিয়ে দিয়েছেন, তারা মাঠ ছাড়বেন না। ফলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এবং ভোটের হারও প্রত্যাশিত হবে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।

তাই এই নির্বাচন পুরো ইভিএমে সম্পন্ন করাকে ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা।

ইতোমধ্যে ইভিএমে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে নির্ধারিত কেন্দ্রে ইভিএম মেশিন পাঠানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আশাবাদী হলেও প্রার্থীদের অনেকে ইভিএম নিয়ে সন্দিহান। প্রধান বিরোধী পক্ষ বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ইভিএমে মানুষ সঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। যদিও সরকারি দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইভিএম নিয়ে কোনো আপত্তি তুলছেন না।

নির্বাচন উপলক্ষে এরই মধ্যে ৩০ হাজার ইভিএম প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল মো. কামাল উদ্দিন। এরই মধ্যে  নির্বাচন ভবন থেকে রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে এসব ইভিএম পাঠানো শুরু হয়েছে। পরীক্ষামূলক ভোটের জন্য ব্যবহার ছাড়াও ভোটের দিন এসব ইভিএম ব্যবহার করা হবে।

ইসি সূত্রে জানা যায়, ঢাকার দুই সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৫৪ লাখ ৩ হাজার ১০৯ জন। ভোট কেন্দ্র রয়েছে ২ হাজার ৪৬৯টি ও ভোটকক্ষ ১৩ হাজার ৫১৪টি।

নতুন ইউনিয়নসহ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় মোট ভোটার সংখ্যা ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১ জন ও দক্ষিণ সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৮ জন। ৩০ হাজার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মধ্যে ডিএনসিসিতে ১৫ হাজার ও ডিএসসিসিতে ১৫ হাজার দিয়ে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে এসব মেশিন পর্যায়ক্রমে দুই সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দেবে ইসি। প্রতিটি কেন্দ্রে দুজন করে অভিজ্ঞ সেনাসদস্য রাখা হবে, ইভিএমে যদি কোনো কারিগরি সমস্যা দেখা দেয় তাহলে তারা সেগুলো অপারেটিংয়ে সাহায্য করবেন।

এছাড়া ইভিএম অপারেটিংয়ের জন্য নির্বাচন কমিশনের ১ হাজার ১৫০ জন অভিজ্ঞ জনবল কাজ করবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!