• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বড় বিদ্রোহের কবলে পড়বে রাখাইন


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জানুয়ারি ১৭, ২০১৯, ০১:৫৯ পিএম
বড় বিদ্রোহের কবলে পড়বে রাখাইন

ঢাকা : চলতি মাসে আরাকান আর্মির হামলায় রাখাইনে ১৩ পুলিশ কর্মকর্তা নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনার পর থেকে রাজ্যটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের অভ্যন্তরে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই শঙ্কাকে আরো ভারী করছে মিয়ানমারের উত্তর সীমান্তের কাচিন বিদ্রোহীরা। সবমিলিয়ে দেশটির আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাখাইনের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অভিযান চালাতে সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে মিয়ানমার সরকার।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত মাসে রাজ্যটিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির লড়াইয়ে পাঁচ হাজারের মতো লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মূলত আরাকান আর্মির অধিকাংশ সদস্য এসেছেন নৃতাত্ত্বিক বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলো থেকে। সাম্প্রতিক এসব সহিংসতায় রাখাইনে নৃতাত্ত্বিক বিভাজন আরো মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে, যা রাজ্যটিতে দীর্ঘদিন ধরে বড় ধরনের অশান্তির জন্ম দিয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ দিকে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযানে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

সাহায্য সংস্থাগুলোর কর্মীরা বলছেন, জানুয়ারির শুরুর দিকে রাখাইনে সামরিক বিমান ও ট্রাক আসতে দেখা গেছে। রাজ্যটিতে সহিংসতার মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা জন্ম নিয়েছে। মিয়ানমারে শান্তি নিশ্চিত করতে নোবেলজয়ী সু চির আশায় গুড়েবালি ঢেলে দিচ্ছেন এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী। রাখাইনে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এক দশক আগে আরাকান আর্মি গঠিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে তারা শোষিত হচ্ছেন বলে দাবি করে আসছে সংগঠনটি।

শুরুর দিকে আরাকান আর্মির অনেক সদস্য রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এসব বৌদ্ধ জেড পাথরের খনিতে কাজ করে ভাগ্য নির্ধারণে উত্তর মিয়ানমারে গিয়েছিলেন। চীনের সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তে তাদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কাচিন মুক্তি বাহিনী (কেআইএ)। এ সংগঠনটিই অত্র অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হচ্ছে কাচিনরা।

২০১৬ সালের শেষ দিক থেকে শান রাজ্যে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিনদের পাশাপাশি লড়াইয়ে নেমেছিল আরাকান আর্মির যোদ্ধারা। ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের পশ্চিমাঞ্চলীয় পাহাড়ি অঞ্চলেও চলাচল রয়েছে আরাকান আর্মির। সেখানে তাদের তিন হাজার সদস্য রয়েছে বলে মনে করা হয়।

রাখাইনে ২০২০ সাল নাগাদ একটি বিদ্রোহ উসকে দিতে লড়াইয়ের পাশাপাশি প্রচারও চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। অনলাইনে ভিডিওতে দেখা গেছে, বিদ্রোহী তরুণ ও তরুণীরা কুচকাওয়াজ ও মুষ্টিযুদ্ধ চর্চা করছেন। তারা আধুনিক অ্যাসল্ট ও স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়ছেন। আরাকান আর্মির আধ্যাত্মিক নেতা টিওয়ান এমরাট নেয়াংকেও মাঝে মাঝে দেখানো হয়েছে ভিডিওতে। নিজেদের প্রচারে সামপ্রতিক বছরগুলোতে রাখাইনকে বিভক্ত করে দেওয়া বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের সহিংসতাকে এড়িয়ে গেছে আরাকান আর্মি। তবে প্রচারে অর্থনৈতিক শোষণ ও ঐতিহাসিক অবিচারের বিবরণ দিতে গিয়ে সেখানকার উর্বর ভূমির কথা সামনে নিয়ে এসেছেন তারা। সে ক্ষেত্রে আরাকান আর্মির অভিযোগের তীর মিয়ানমার রাষ্ট্র ও বার্মার নৃতাত্ত্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠদের দিকে।

২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলছে- মিয়ানমারের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি হচ্ছে রাখাইন। সেখানে কেবল ১৭ শতাংশ বাড়িতে নিরাপদ সুপেয় পানি প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাখাইনে তিন লাখ বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। যা দেশটির অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় একেবারে নিম্ন পর্যায়ের।

১৮ শতকে বার্মিজদের হামলার আগে ঐতিহাসিকভাবে আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। গত বছরের জানুয়ারিতে আরাকান রাজ্যের পতনের বার্ষিকীতে একটি বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি চালালে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। এর মধ্যে রাখাইনের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) প্রধানকে আরেক কর্মীর সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এখনও তাদের বিচারকাজ চলছে।

২০১৫ সালের নির্বাচনে এএনপি অধিকাংশ আসনে জয়ী হলেও পরের বছর ক্ষমতাগ্রহণের পর স্টেট কাউন্সিলর সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি রাজ্যটিতে নিজের একজন মুখ্যমন্ত্রীকে বসায়, যা রাখাইনের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অসন্তোষ জন্ম দেওয়ার আরেক কারণ।

গত কয়েক বছরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কয়েক দফায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে আরাকান আর্মির। গত কয়েক মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির সংঘর্ষের মাত্রা বেড়ে যায়।

আরাকান আর্মির প্রধান টিওয়ান এমরাট নেয়াং স্থানীয় গণমাধ্যম ইরাবতীকে বলেন, রাখাইন রাজ্যের অবশ্যই নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকতে হবে। একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী থাকার অর্থ হচ্ছে- রাখাইনের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব টিকে থাকবে। আরাকান আর্মিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করছে মিয়ানমার সরকার। তাদের দাবি, সংগঠনটি আগামী দিনগুলোতে রাজ্যটিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কাচিন বিদ্রোহীদের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া আরাকান আর্মি মিয়ানমারের জন্য সম্ভাব্য বড় ধরনের সামরিক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেটি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হবে।

অনুমান করা যায়— রাখাইনে ২০১৫ সালে শুরু হওয়া রাজনৈতিক ও সামরিক অনুপ্রবেশের প্রস্তুতিমূলক পর্যায়কে একটি পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে রাখাইন আর্মি। রাজ্যটির উত্তরাঞ্চলের সব শহরতলিতে প্রায় কোম্পানি ও প্লাটুন আকারে পরিচালিত হচ্ছে আরাকান আর্মি। যেটির ভবিষ্যত শৃঙ্খলিত পর্যায়ে থেকেই তারা তাদের বড় বিদ্রোহ শুরু করবেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!