• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভাগ্য নির্ধারণের মুখে সরকারি ব্যাংক


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ১৪, ২০১৯, ০৯:৩৭ এএম
ভাগ্য নির্ধারণের মুখে সরকারি ব্যাংক

ঢাকা : ভাগ্য নির্ধারণের মুখে পড়ছে সরকারি মালিকানার ব্যাংকগুলো। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদে নতুন করে হিসাব-নিকাশের মুখোমুখি হতে হবে সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে। সামনের দিনগুলোতে কঠোর জবাবদিহির নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়াতে হবে এসব ব্যাংককে।

অর্থনীতিবিদদের মত, ব্যাংক খাতে এখন শক্ত জবাবদিহি নেই। ফলে খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। মূলধন খেয়ে ফেলছে অনেক ব্যাংক। যেসব ব্যাংক একসময় ভালো ছিল সেগুলোরও আর্থিক অবনতি হচ্ছে।

নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি হিসাববিদ হিসেবেও ঝানু। ফলে সরকারি ব্যাংকগুলোর পর্ষদ আর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে আগের থেকে সতর্ক হতে হচ্ছে।

সূত্রগুলো বলছে, দেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৫৯। এর মধ্যে ৮টি হচ্ছে সরকারি। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা শুরু হলেও গত ৫ দশকে এই খাতের নেতৃত্ব চলে গেছে বেসরকারি খাতের দখলে। সুশাসনের ঘাটতি, জবাবদিহি ও গ্রাহকসেবার মানে পিছিয়ে পড়ছে সরকারি ব্যাংকগুলো।

তবে এখনো সারা দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সেবা দিচ্ছে সরকারি ব্যাংক। মুনাফার চিন্তায় যেসব এলাকায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো শাখা খুলতে অনাগ্রহ দেখায় সেসব জায়গায় সরকারি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সরকারের হয়ে বিভিন্ন ধরনের সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তহবিল সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো।

জানা গেছে, এর আগে সদ্য বিদায়ী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সরকারের টানা দুই মেয়াদে আর্থিক খাতের অভিভাবক হিসেবে কাজ করেছেন। দশ বছর পর নতুন অর্থমন্ত্রী পেয়ে এই খাত। আ হ ম মুস্তফা কামাল এরই মধ্যে কয়েক দফা সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে সতর্ক করেছেন, আর্থিক খাতের খোলস পাল্টে যাবে। যেভাবে চলছে সেভাবে আর চলতে দেওয়া হবে না।

তিনি এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছেন। সেখানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রসঙ্গ টেনে সুশাসন প্রশ্নে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন। তা ছাড়া অনিয়ম ও সুশাসন ঘাটতি থেকে এসব ব্যাংক বাঁচাতে বিনা প্রশ্নে আর তহবিল জোগান দেওয়া হবে। জনগণের করের টাকা পেতে চাইলে লিখিত প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা তুলে ধরতে হবে। চিঠিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর একটি ডায়াগনস্টিক প্রতিবেদন যত দ্রুত সম্ভব জানাতে হবে।

আ হ ম মুস্তফা কামাল এ ব্যাপারে বলেছেন, আর্থিক খাতের চিত্র পাল্টে যাবে। যেভাবে এত দিন চলেছে, সেটি আর থাকবে না। জবাবদিহির মুখোমুখি আসতে হবে। টাকা নিলে গ্রাহককে যেমন ফেরত দিতে হবে তেমনি পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে দায়বদ্ধ থাকতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনতেই হবে। যেভাবে এই ব্যাংকগুলো চলছে, তা অস্বাভাবিক। জনগণের করের টাকা থেকে বার বার তহবিল জোগান দেওয়া অনৈতিক। তবে কেবল লোক দেখানোর পদক্ষেপ থাকলে হবে না। কার্যকর ও বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর সব সমস্যা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। রাজনৈতিক বিবেচনায় পর্ষদ নিয়োগ। এটি পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বলছে, বর্তমান সরকারের টানা দুই মেয়াদে ব্যাংক খাতের ১০টি বড় জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট হয়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। তবে এসব জালিয়াতির ঘটনা সামনে এসেছে মূলত সরকারি ব্যাংকগুলোতে। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক গ্রুপ দিয়ে এ জালিয়াতি শুরু। জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে অন্য সরকারি ব্যাংকগুলোতে।

চলমান নৈরাজ্য বন্ধ করে ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বর্তমানে আমানত ও ঋণের সুদহার নিয়ে ব্যাংক খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার টানাটানি থেকে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মালিকরা নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েও এতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে।

দলটি বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান তদারক জোরালো করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কার্যকর ও শক্তিশালী করতে পদক্ষেপ হাতে নেবে তারা। ঋণসহ ব্যাংক জালিয়াতি কঠোর হস্তে দমন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঋণগ্রাহক ও দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা হবে এবং দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নের টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি নির্ণয় করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ব্যাংক খাতের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সরকারি ৬ বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির অর্ধেকের বেশি। ছয় সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৩ শতাংশ। বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা। এটা মোট ঋণের ২১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে ৯টি ব্যাংক। এর মধ্যে ছয়টি সরকারি মালিকানার। এগুলোর ঘাটতি রয়েছে ১৭ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের দক্ষতা না বাড়িয়ে জনগণের করের টাকায় বার বার মূলধন জোগান দেওয়ায় বিভিন্ন মহলে সমালোচনা রয়েছে। কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ব্যাংকের জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ৯৩২ কোটি। একইভাবে বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৮৬ কোটি টাকা। ৬৬২ কোটি টাকা মূলধন খেয়ে ফেলেছে অগ্রণী ব্যাংক। বরাবরের মতো মূলধন ঘাটতির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২০৫ কোটি টাকা।

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ৬৬৯ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি পড়লেও এবার পুরোপরি বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির কোনো মূলধন ঘাটতি নেই।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!