• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাঙছে পাকিস্তান, জন্ম নিচ্ছে আরেকটি বাংলাদেশ


আন্তর্জাতিক ডেস্ক জানুয়ারি ২৮, ২০১৯, ০৫:১১ পিএম
ভাঙছে পাকিস্তান, জন্ম নিচ্ছে আরেকটি বাংলাদেশ

ঢাকা : গত বছর পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের বন্দর নগরী করাচিতে বন্দুকযুদ্ধে নাকিবুল্লাহ মেহসুদ নামের এক তরুণ নিহত হন। এ ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে পুলিশ দাবি করে, পাকিস্তানি তালেবানের কট্টর সদস্য ছিলেন মেহসুদ। সন্ত্রাসীদের গোপন একটি আস্তানায় অভিযানের সময় মারা যান তিনি।

কিন্তু তার পরিবার, বন্ধু ও বেশকিছু মানবাধিকার সংস্থা পুলিশের এ দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তারা বলেছে, মেহসুদ ছিলেন নির্দোষ এক দোকানদার এবং উচ্চাভিলাষী মডেল। সরকার এ ঘটনায় তদন্ত শুরুর নির্দেশ দেয়। পুলিশের তদন্ত কমিটি এ ঘটনায় কোনো ধরনের বন্দুকযুদ্ধ অথবা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কোনো আলামত পায়নি।

ভুয়া বন্দুকযুদ্ধের গল্প সাজিয়ে মেহসুদকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় তদন্ত কমিটি। এ ধরনের অভিযোগ পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায়ই উঠে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং তাদের বিচার এখনো চলছে।

অতীতেও এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উপেক্ষা করার নজির রয়েছে পাকিস্তানের। শাস্তির মুখোমুখি হওয়া ছাড়াই অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। কিন্তু মেহসুদের ঘটনাটি অন্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করেছে; ওয়াজিরিস্তানের মাকিন শহরের একেবারে অপরিচিত একটি সংগঠন পশতুন তাহাফ্ফুজ ম্যুভমেন্ট (পশতুন সুরক্ষা আন্দোলন-পিটিএম) এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ শুরু করে। ফলে দেশটির সরকার এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়।

পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হচ্ছে পশতুন। এই গোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য আফগান সীমান্তের কাছে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পশতুনদের নানাবিধ সমস্যার সমাধানে ও নাগরিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী মনজুর পশতিন পিটিএম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পশতুনরা দুই দশক ধরে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।

টুইন টাওয়ারে ৯/১১’র হামলার পর মিত্রদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে। পরে আফগান জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে পড়ে এবং সীমান্তের কাছের পশতুন অধ্যুষিত এলাকায় আশ্রয় নেয়। ওই এলাকা থেকে সন্ত্রাসীদের উৎখাত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুরো মাত্রার সামরিক অভিযান চালায়।

তবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করার পরিবর্তে পাক সামরিক বাহিনী অভিযানে ওই এলাকার নির্দোষ মানুষকে শিকারে পরিণত করে। সেই সময় পাকিস্তানজুড়ে পশতুনদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে তুলে ধরা হয়; যদিও পশতুনরাই সেখানে সন্ত্রাসবাদের শিকার।

ন্যায়বিচারের দাবি : করাচিতে মেহসুদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ওয়াজিরিস্তান থেকে ইসলামাবাদ অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচির ডাক দেন পিটিএম প্রতিষ্ঠাতা ও মানবাধিকার কর্মী মনজুর পশতিন। ন্যায়বিচারের দাবিতে হাজার হাজার পশতুন এই পদযাত্রায় অংশ নেয়। শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের দাবিতে নয় বরং পাকিস্তানে পশতুনরা যে বছরের পর বছর ধরে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন; সেই বৈষম্যের অবসানের দাবিও জানান তারা।

এই পদযাত্রা দেশটিতে দ্রুতই জাতীয় অধিকার আন্দোলনে পরিণত হয়; জন্ম হয় পিটিএমের। দেশজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ। পশতুন অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে জঙ্গিদের উৎখাতে পাক সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মনজুর পশতিন এবং তার সমর্থকরা। জঙ্গিদের আসলেই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ উৎখাত করতে চায় কি-না সেই প্রশ্নও হাজির করেন পশতুনরা।

এ সময় একটি স্লোগানকে ব্যাপকমাত্রায় ব্যবহার করেন পশতুনরা। ‘ইয়েহ জো দেহশাতগার্দি হ্যায়, ইজ কি পিছাই উর্দি হ্যায় অর্থাৎ এই সন্ত্রাসবাদের পেছনে আছে ইউনিফর্ম (সেনাবাহিনী)।’ সন্ত্রাসী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে একধরনের সাংঘর্ষিক অবস্থান তৈরির অভিযোগ উঠে পশতুনদের বিরুদ্ধে।

বিচারবহির্ভূত সব হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের তদন্তের দাবি জানায় পিটিএম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভয়ভীতি প্রদর্শন করে স্থানীয়দের লোকচক্ষুর অন্তরালে যেতে বাধ্য করে; ভীতি প্রদর্শনপূর্বক এই অন্তর্ধান কৌশলের অবসান চায় তারা। এছাড়া পশতিন এবং তার সমর্থকরা পুরনো মান্ধাতা আমলের উপজাতীয় আইন সংস্কার করতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ শুরু করে।

পশতুনরা বলছেন, এই আইনের ফলে তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করছে সরকার। এর মধ্য অন্যতম সামষ্টিক দায়বদ্ধতা আইন। এ আইনের মাধ্যমে সমাজের, গোত্রের বা পরিবারের কোনো এক সদস্য অপরাধ করলে পুরো সম্প্রদায়, পরিবার এমনকি পুরো গ্রামকে শাস্তির মুখোমুখি করা হয়।

ক্রমবর্ধমান এই আন্দোলনের প্রকৃত অভিযোগগুলো মোকাবেলা করার পরিবর্তে পাকিস্তান সরকার পশতুনদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। পিটিএম সমর্থকদের বিক্ষোভ-প্রতিবাদের খবর প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তানি গণমাধ্যম। পুলিশ পিটিএমের অনেক নেতা এবং সদস্যকে গ্রেফতার করে। পাকিস্তানের কোনো প্রান্তেই সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি পিটিএম নেতাদের। এমনকি সম্প্রতি পিটিএমের অনেক সদস্যকে দেশত্যাগে বাধা দেয়া হয়।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র পিটিএমের বিরুদ্ধে পাকিস্তানবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিযোগ করেন। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পুরনো বুলি আওড়ান ওই সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বিদেশি শত্রু রাষ্ট্রের সহায়তায় পশতুনরা এই আন্দোলন করছে।

কিন্তু এই আন্দোলন থামিয়ে দিতে পাক সরকারের নেয়া পদক্ষেপ হিতে বিপরীত হিসেবে দেখা দেয়। সরকারি এমন প্রচারণার কারণে পিটিএম আরো ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয়, আগের তুলনায় সর্বোচ্চ জনসমাগমের রেকর্ডও গড়ে পিটিএম।

এই আন্দোলনকে সব সময় অহিংস বলে দাবি করে আসছেন পশতুনরা। তবে এখন শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, এ ধরনের কঠোর হস্তে দমনের চলমান নীতির কারণে সহিংস রূপ ধারণ করতে পারে পিটিএমের আন্দোলন। এমনকি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে; যা অতীতে দেখা গেছে।

অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা : ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানেও একই ধরনের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার আন্দোলনে রূপ নেয় এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।

১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী সেই সময়ের সর্ববৃহৎ জাতিগত গোষ্ঠী বাঙালিরা জেনারেল আইয়ুব খান নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের উপেক্ষা, বঞ্চনা, শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। বাঙালিদের বঞ্চনার অভিযোগ শোনা ও অবিচার মোকাবেলার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। ফলে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেন বাঙালিরা; ভেঙে যায় পাকিস্তান, জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের।

প্রায় ৫০ বছর পরে এখন মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ইতিহাস থেকে অনেক কিছুই শিক্ষা নেয়নি এবং একই ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছে তারা, যা ১৯৭০ সালের মতো পাকিস্তানের জন্য অনেক ব্যথা, রক্ত বন্যা ও অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

চলতি মাসেই পিটিএম তাদের প্রতিষ্ঠার এক বছর পালন করেছে। এখন পাকিস্তানের সামরিক এবং বেসামরিক নেতৃত্ব পশতুন জনগোষ্ঠীর বৈধ উদ্বেগ, তাদের দাবি-দাওয়া পাক সংবিধান অনুযায়ী ভালোভাবে মোকাবেলা করবে এবং এটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। শিগগিরই নিপীড়ন বন্ধ করে তাদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

যদি তা না করা হয়, তাহলে ইতোমধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়া একটি দেশের ভাঙনের জন্য অনুঘটক হতে পারে পিটিএম এবং পাকিস্তান আরো একটি জাতীয় বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় লেখা পুরস্কার জয়ী পাকিস্তানি সাংবাদিক তাহা সিদ্দিকীর কলাম। বর্তমানে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর

Link copied!