• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ভালো নেই প্রবাসী শ্রমিকরা


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ১৬, ২০১৯, ০২:০৮ পিএম
ভালো নেই প্রবাসী শ্রমিকরা

ফাইল ছবি

ঢাকা : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে কুয়ালালামপুরের আকাশচুম্বী সব ভবন আর ঝকঝকে তকতকে রাস্তা শহরটিকে এশিয়ার অন্যতম সেরা বানিয়েছে। আর এই সেরা হওয়ার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিরাট অবদান। গত তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ থেকে লাখো শ্রমিক এসেছে মালয়েশিয়ায়।

এসব আকাশচুম্বী ভবন নির্মাণে, ঝকঝকে রাস্তা তৈরিতে কাজ করেছে তারাই। বদলে যাওয়া মালয়েশিয়াকে প্রতিদিন ঝাড়-পোছ দিয়ে চাকচিক্যময় করে রাখছে বাংলাদেশি শ্রমিকরাই। অথচ এদেশে ভালো নেই তারা।

প্রতিযোগিতার বাজারে কমে আসা কর্মসংস্থানের সুযোগ, দালালদের প্রতারণা এবং মালয়েশিয়া পুলিশের নির্দয় আচরণে হাসি নেই এসব শ্রমিকের মুখে।

প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশি রয়েছে মালয়েশিয়ায়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শ্রমিক। বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে রাস্তা, ফ্লাইওভার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্লিনার, কল-কারখানার শ্রমিক ও বিভিন্ন শপিং মলে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করছেন এসব শ্রমিক। এদেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে বিশাল অবদান রেখে চলেছেন ৩ লাখ বাংলাদেশি। কিন্তু নিজেদের ভাগ্যের চাকা প্রায় থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এদেশে।

জানা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিক লাখ লাখ টাকা দালালকে দিয়ে এসেছেন এই দেশে। প্রাথমিক অবস্থায় ভিনদেশের ভাষা, সংস্কৃতি না জানা অনভিজ্ঞ শ্রমিকের বেতন খুব বেশি ধরা হয় না। তা ছাড়া অমানুষিক খাটুনির ভাগটাও দিতে হয় আরেক শ্রেণির দালালদের, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সরবরাহ করে। এদেশে বসবাস করা এসব দালালও বাংলাদেশি।

সুতরাং লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে এদেশে আসা শ্রমিকের ওই টাকা তুলতেই প্রায় তিন বছর কেটে যায়। এর মধ্যে শেষ হয়ে যায় ভিসার মেয়াদ। মেয়াদ বাড়াতে নতুন করে পড়তে হয় দালালের খপ্পরে।

মালয়েশিয়ায় কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভিসার মেয়াদ বাড়ানো কিংবা অন্য যে কোনো সহযোগিতায় কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ধরনা দিতে হয়। এই হাইকমিশনই হলো দুর্নীতির আখড়া।

শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহার, দালালচক্রের মাধ্যমে ঘুষের লেনদেন এখানে ওপেন-সিক্রেট। অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত শ্রমিকদের যা খুশি বুঝিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই দালালচক্র। রক্ত-ঘামে উপার্জিত শ্রমিকের পয়সা মেরে খেতে তাদের বাধে না একটুও। এই দুর্নীতির সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে হাইকমিশনের কর্তাদের, এমনটাই দাবি শ্রমিকদের।

নির্মাণ শ্রমিক মোহাম্মদ হানিফ মোল্লা জানালেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের প্রধান শত্রু বাংলাদেশিরাই। নিরীহ শ্রমিকদের সঙ্গে স্বদেশী দালালরা যে আচরণটা করে তা শুধু অন্যায়ই নয়, রীতিমতো অমানবিক।

তিনি বলেন, আমি দশ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় আছি। দেখেছি কীভাবে আমাদের দেশি ভাইয়েরা শ্রমিকদের ঠকাচ্ছে। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের কাছ থেকে। আবার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। সেখানে প্রতিটি শ্রমিকের কাছ থেকে মাথাপিছু টাকা পাচ্ছে প্রতিমাসে। এভাবে গরিবের হক মেরে খাচ্ছে একশ্রেণির দালাল।

কুয়ালালামপুরের দ্য মার্ক হোটেলের রিসেপশনিস্ট মিকাইল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে নিজের দেশের মানুষই দুই নম্বরি করছে প্রতিনিয়ত। কিছু দালাল অবৈধভাবে শ্রমিক আনছে এদেশে। তাতে দেশের বৈধ শ্রমিকরা পড়ছেন বিপদে। নিয়ম করে ইমিগ্রেশন পুলিশ হানা দিচ্ছে বিভিন্ন বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করছে বাংলাদেশিদের। ফলে বৈধ শ্রমিকরা পড়ছেন বিড়ম্বনায়।

মালয়েশিয়ায় সম্প্রতি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়েছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। এদেশে অবৈধ অভিবাসী ধরতে ব্যাপক তোড়জোড় চলছে সরকারি এই বাহিনীটির। এই তোড়জোড়ের প্রধান টার্গেট বাংলাদেশি। প্রায় ৩ লাখ বৈধ বাংলাদেশি থাকলেও অনেক অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে এদেশে। ফলে ইমিগ্রেশন পুলিশ অবৈধদের ধরতে প্রতিনিয়ত হানা দিচ্ছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মস্থল ও বাসস্থানে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বৈধ শ্রমিকরা। তাদের কাজ নষ্ট হচ্ছে। পুলিশি ঝামেলায় পড়ার ভয়ে মালিকরা বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজেও নিতে চাচ্ছেন না। নিলেও শ্রমমূল্য কমে আসছে।

এই প্রতিবেদক কুয়ালালামপুরে থাকা অবস্থায় গত ১৪ জুলাই শহরটির বাংলাদেশি অধ্যুষিত কোতারাইয়াতে হানা দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। দুপুর আড়াইটার দিকে শুরু হওয়া অভিযানে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশিকে আটক করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে সাড়ে আটশ বৈধ বাংলাদেশিকে ছেড়ে দেওয়া হয় আটকের তিন ঘণ্টা পর। বাকিদের থানা পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়।

অভিযানের সময় মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন পুলিশের নির্দয় আচরণের শিকার হন অনেক বৈধ বাংলাদেশি শ্রমিক। শারীরিকভাবে হেনস্তা করাসহ তাদের সঙ্গে ন্যূনতম মানবিক আচরণও করেনি পুলিশ।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে— এটা নিয়মিত ঘটনা। রোববার ছুটির দিন হলেও ইমিগ্রেশন পুলিশ হানা দেয় বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। শ্রমিকদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার করেন তারা। অনেক সময় বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় থানা হাজতে। পরে ঘুষের মাধ্যমে ছাড়িয়ে আনতে হয়।

এদেশে কর্মরত শ্রমিকদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বিষয় নিয়ে হাইকমিশনে গেলে কোনো সাহায্যই তারা পান না। উল্টো হেনস্তা হওয়ার ভয়ে অনেকেই বাংলাদেশ হাইকমিশনে যান না; বরং মালয়েশিয়া পুলিশের সঙ্গে ঘুষের মাধ্যমে দফারফা করেন।

যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও চাকচিক্যময় জীবনযাপনে বাংলাদেশি শ্রমিকরা জীবন বাজি রেখে কাজ করে চলেছেন দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে, সেই দেশেই বাংলাদেশি শ্রমিকদের হেনস্তা হতে হচ্ছে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করেও তাদের মুক্তি নেই। মেটাতে হচ্ছে স্বদেশী দালালদের চাহিদা। শিকার হচ্ছেন মালয়েশিয়া পুলিশের নির্দয়, অমানবিক আচরণের।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!