• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভালোবাসা এবং ফুলের মূল্য


নিউজ ডেস্ক ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯, ১১:৫৫ পিএম
ভালোবাসা এবং ফুলের মূল্য

ঢাকা : ‘ফুল নিবেন ফুল’ বলে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক সিগন্যালে কোমলমতি শিশুরা সাহায্য চাওয়ার বদলে এক ধরনের আবদার, আবেদন রাখে পথচারীদের কাছে। কেউ তাতে সাড়া দিক বা না দিক, এই ফুল বিক্রি করেই তাদের জীবন চলে। এদেরকে আমরা পথশিশু বা ফুলকলি বলেই জানি।

তবে জানতে চেষ্টা করি না, ফুলের মতো এমন কচি মুখগুলোর জীবন এমন কেন! কেউ ফুল উৎপাদন করে, কেউবা গাঁথে ফুলের মালা, কেউ সাজায় ডালা আর এই পথকলিরা ফুল বেচেই দিন চালায়- এই বাস্তবতার নিয়মেই চলছে আমাদের যাপিত জীবন।

প্রেম, ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক এই ফুল নিয়ে কাব্যকথা অথবা বাণিজ্য প্রসারের গল্প জানব আজ। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘ফুলের মূল্য’ ছোটগল্পে প্রমাণ করেছেন ফুলের যে কত অমূল্য।

জোটে যদি মোটে একটি পয়সা

খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি

দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার

ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!

বাজারে বিকায় ফল তণ্ডুল

সে শুধু মিটায় দেহের ক্ষুধা,

হূদয়-প্রাণের ক্ষুধা নাশে ফুল

দুনিয়ার মাঝে সেই তো সুধা!

ফুলের গুরুত্ব বোঝাতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উক্তি হিসেবে ব্যবহূত হতে দেখা যায়। আবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর প্রেমের গান ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল, কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল’। এভাবে সাহিত্যে ফুলের মূল্যকে অর্থবহ বিষয় হিসেবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কারণ ফাল্গুনের সাথে ফুলের সম্পর্ক যেমন, তেমনি ভালোবাসার সাথেও। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের কাছে ফুল সৌন্দর্য, স্নিগ্ধতা-পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। পৃথিবীর সব ধর্মেও ফুল নিয়ে বিশদ আলোচনা রয়েছে।

বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে ফুল একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও মননশীলতার প্রতীক ফুল। উপহার, সংবর্ধনা, বিয়ে, গায়েহলুদ, পূজা-পার্বণ এমনকি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতায় ফুলের ব্যবহার এখন জনপ্রিয় এবং দৃষ্টিনান্দনিকতার উৎসও বটে। শুধু শৌখিনতায় নয়, আধুনিক সমাজে ফুলের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে ফুল এখন বিরাট অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সময়ের চাহিদার আলোকে দেশের অর্থনীতিতেও ফুলের অবদান ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে।

বিশেষত ভালোবাসা দিবস, পহেলা ফাল্গুন আর একুশে ফেব্রুয়ারি ফুলে চাহিদা  বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এই চাহিদার আলোকে দেশে ফুলের বাজার ১২শ’ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এবার শুধু পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে ব্যবসায়ীদের ফুল বিক্রির টার্গেট ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালীতে বিক্রির টার্গেট ৭০ কোটি টাকার।

ঘরের  সৌন্দর্য বর্ধনে ফুল কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। মন চাঙ্গা রাখে ফুলের পরশ। মা, স্ত্রী, কন্যা, প্রেমিকারা ফুল পেলে অধিক খুশি হয়। ফুল চাষ দেশে একসময় শৌখিনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই তা ক্রমশ বাণিজ্যিক চাষের দিকে এগুতে থাকে। জানা গেছে, বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু হয় ’৮০র দশকে।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকার ফুলকে রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকাভুক্ত করে। এরপর থেকে বাড়ছে ফুলের বাণিজ্য। নব্বইয়ের দশকের আগে দেশের ফুলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত ফুল দিয়েই চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। মাত্র দুই দশকের পথচলায় ফুল বাণিজ্য অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। শুধু রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়।

বিশ্বে ফুল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র : বিশ্বে ফুলের বাজার প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বে ফুল বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ‘ফ্লোরাহল্যান্ড’ নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এখানে আন্তর্জাতিক নিলামের মাধ্যমে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় ২ কোটি ১০ লাখ ফুল। বিশ্বজুড়ে বিক্রীত ফুলের প্রায় ৫২ শতাংশ রফতানি হয় এ বাজার থেকে।

ভালোবাসা দিবসের আগে সপ্তাহজুড়ে সেখানে হাট বসে কোটি  কোটি  গোলাপ, টিউলিপ ও অন্যান্য ফুলের। প্রায় ২ কোটি গাছ বিক্রি হয়। দেশটির ছোট শহর আলসমিরে এক বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি বাজার আছে। আছে একটি বিমানবন্দর। ওই বাজার ও বিমানবন্দর ব্যবহার করা হয় ফুল বাণিজ্যের জন্য। এখানে এক প্রজাতির ফুল প্রায় ৩০ শ্রেণিতে ভাগ করার পর তা নিলামে তোলা হয়। চমৎকৃত হওয়ার খবরটি হলো বিশ্বের চাহিদার ৪০ শতাংশ ফুলই নেদারল্যান্ডস রফতানি করে।

পৃথিবীতে যে প্রতিষ্ঠানগুলো ফুলের জাত উন্নয়ন থেকে চাষ ও বাজারজাতকরণেও শীর্ষে রয়েছে তাদেরই একটি নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল ভান জানটেন। যাদের ফুল চাষের এলাকা দেশের মাটি পেরিয়ে পৌঁছেছে সাউথ আফ্রিকা, উগান্ডা ও নিউজিল্যান্ডে। তাদের পথচলা শুরু হয় ১৮৬২ সালে। এখন বিশ্বব্যাপী প্ল্যান্ট এবং ফুলের আন্তর্জাতিক নার্সারি হিসেবে তারা প্রসিদ্ধ। মূলত টিউলিপের ফ্লাওয়ার বাল্ব রফতানি, তাদের মূল বাণিজ্য। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন- সাউথ আফ্রিকা, উগান্ডায়ও ফুল চাষ করে। বছরে লিলি বাল্ব উৎপাদন করছে ১১ কোটি। টিউলিপ বাল্ব ৫ কোটি, লিলিয়াম ও অন্যান্য ফুলের বাল্ব উৎপাদন করছে ২ কোটি। উত্তর আমেরিকায় ফুলের সবচেয়ে বড় নিলাম অনুষ্ঠিত হয় কানাডার ‘বারনাবির সাউথওয়েস্ট গার্ডেন সাপ্লিয়াসে’।

বছরে ভ্যালেন্টাইনস ডে ও মাদারস ডে-তেই কানাডায় কাটতি হয় ১৫ কোটি ফুলের। ১২  ফেব্রুয়ারি ভারতের বেঙ্গালুর ফুলের বাজারে বসে লাল গোলাপের মেলা। ১৪ ফেব্রুয়ারি চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ের দাওনান ফ্লাওয়ার মার্কেটে বিশাল ফুলের বাজার বসে। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ ফুল চীন ও বহির্বিশ্বে সরবরাহ করা হয়।

বিশ্বের আরো সব বড় ফুলের বাজারের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে দ্বিতীয় বৃহত্তম হংকংয়ের মংকক রোডে অবস্থিত। মূলত চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া এখান থেকে ফুল আমদানি করে থাকে। এখানে রাস্তার পাশে প্রায় ৫০টির অধিক ছোট বাজার রয়েছে। ফুলের বাজার হিসেবে বিখ্যাত যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত কলাম্বিয়া রোড। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এ বাজারটি ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্পেন, ইসরাইল, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ফুল আসে। ফুল বিক্রির চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ভারতের কলকাতায় মালিকঘাট। দুই শতাধিক আড়তদার প্রায় ১২৫ বছর ধরে এ বাজারে ফুল বিক্রি করছেন। বলা হয়ে থাকে বিশ্বের চাহিদার প্রায় অর্ধেক গাঁদাফুল এ বাজার থেকে সরবরাহ করা হয়। ফুল বিক্রির বাজার হিসেবে পঞ্চম স্থানে ইকুয়েডরের কুয়েনচাবাজার। প্রতিবছর প্রায় ৮২ কোটি মার্কিন ডলারের ফুল বিক্রি হয় এখানে।

দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া প্রতিবছর নানা দেশে ফুল বিক্রি করে আয় করে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বের মোট ফুলের ১৫ শতাংশ আসে কলম্বিয়া থেকে। সাধারণত গোলাপ রফতানি করলেও কলম্বিয়ার রফতানিকৃত ফুলের তালিকায় রয়েছে অ্যান্থোরিয়াম, অর্কিড এবং ‘বার্ড অব প্যারাডাইস’ ফুল। আবার বর্তমানে বিশ্বজুড়ে রফতানি করা ফুলের নয় ভাগ ইকুয়েডর জোগান দেয়। দেশটিতে প্রায় ৬০ প্রজাতির গোলাপ চাষ হয়। গোলাপ ছাড়া জিপসোফিলিয়া, লিমোনিয়াম, লিয়াট্রিস প্রভৃতি ফুল রফতানি করে।

বিশ্বের ফুলবাজারের ৭ শতাংশ ফুল আসে কেনিয়ার ফুলবাগান থেকে। তাদের বিপুল পরিমাণ ফুল রফতানি করে আয় হয় ৫০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইউরোপের কাটা ফুল বাণিজ্যের জগতে বেলজিয়াম সুপরিচিত নাম। বিশ্ববাজারের ৩ শতাংশ ফুলের জোগান আসে বেলজিয়াম থেকে। বেলজিয়ামে সাধারণত গ্রিনহাউজে ফুল চাষ করা হয়।

ইথিওপিয়ার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে ফুলশিল্প। ইথিওপিয়াই আফ্রিকার দ্বিতীয় প্রধান ফুল রফতানিকারক দেশ। মালয়েশিয়ার রফতানি করা ফুল বিশ্ববাজারের এক শতাংশ। ইতালি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম ফুল উৎপাদনকারী এবং রফতানিকারী দেশ। ইতালির রফতানিযোগ্য ফুলের বেশিরভাগই গোলাপ ও কার্নেশন।

পার্শ্ববর্তী দেশ অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ডেই মূলত ইতালির ফুল বাণিজ্য বিস্তৃত। জার্মানিও নানারকম কাটা ফুল রফতানি করে, তবে তা পুরো দেশে সরবরাহ করার পর। ফুল উৎপাদনের জন্য ইসরাইলের জলবায়ু ভীষণ উপযোগী। পিওনিজ, এনিমোন প্রভৃতি ফুল, ফুলগাছ এবং ফুলচাষের যন্ত্রপাতি বিক্রি করে ইসরাইল প্রতিবছর ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করে থাকে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!