• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার মাস ও বাংলার ব্যবহার


গোপাল অধিকারী ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০, ০৩:১২ পিএম
ভাষার মাস ও বাংলার ব্যবহার

ঢাকা : বাংলা একটি ভাষার নাম। একটি চেতনার নাম। বাংলা সারা বিশ্বের অহংকার। কেননা পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিরাই প্রথম ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল। তাই আজ ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। তবে ভাষাকে নিয়ে ভাবার ইতিহাসটা আরো আগের। ১৯৪০ সালে পাকিস্তানের লাহোরে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে একটি প্রস্তাব করা হয়, যা ইতিহাসে ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত। ১৯৪৭ সালে শুধু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের। পাকিস্তানের আবার দুটি ভাগ ছিল— পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ আর পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই দুই পাকিস্তানের মধ্যে শুরু হয় দূরত্ব। ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানে সব উন্নতি সাধিত হয়। বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তান ক্রমান্বয়ে হতে থাকে অবহেলিত।

পূর্ব পাকিস্তানের সব দাবি-দাওয়া ভূলুণ্ঠিত করতে প্রথমেই তারা আঘাত হানে ভাষার ওপর। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেন। সেই সময়ে উপস্থিত ছাত্ররা ‘না না’ বলে প্রতিবাদ করে। এভাবেই চলতে থাকে পশ্চিমের সঙ্গে পুবের মাতৃভাষার যুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালে। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় আসেন। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কি হবে সেটা পূর্ব বাংলার জনগণই নির্ধারণ করবে। কিন্তু উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ’। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই দিবসের কর্মসূচিকে সফল করতে ৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল এবং ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ’৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বন্দি মুক্তি’ দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও  আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহম্মদ আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সকল ন্যায্য অধিকারের দাবিতে বাঙালিরা যখন ঐক্যবদ্ধ, তখন ২০ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিনের ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ বাংলা ৮ ফাল্গুন মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্র-জনতা মিছিল বের করে। সেদিন হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। মুখে ছিল স্লোগান— ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে দলে দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে চলতে থাকে পরিষদ ভবনের দিকে। শান্তিপূর্ণ মিছিলটি মেডিকেল কলেজের সামনে এলে পুলিশ সেদিনের সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। রাজপথে শহীদ হন জব্বার, শফিউর, রফিক, বরকতসহ নাম না জানা আরো অনেকে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেদিনের সেই ভাবনা, সেদিনের সেই চেতনা পরে সব আন্দোলনে জুগিয়েছে প্রেরণা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় সবই ভাষা আন্দোলনের ফসল। সেদিন যে বাঙালি জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়েছিল তা বাঙালির সব আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আন্দোলন ছাড়া যে বিজয় হয় না তা ভাষা আন্দোলন থেকে শিখতে পেরেছিল পূর্ব বাংলার মানুষ। পাকিস্তানিরা যে পূর্ব বাংলার উন্নতি বা সমৃদ্ধি চায় না তা বোঝা গিয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। তাই বলা হয় ভাষা আন্দোলনের মাঝে স্বাধীনতার বীজ লুকায়িত ছিল। বাঙালির অদম্য মনোবল দেখে, বাঙালির ভাষার জন্য আন্দোলন দেখে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজ আমরা যে শহীদ মিনারে একত্রিত হই, ফুল দিই সেটি উদ্বোধন হয়েছিল ভাষার মাস ২৪ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে। ভাবতেই কষ্ট হয়, আজ আমরা যে মা, মা বলে প্রাণ জুড়াই, শিশুর মুখে হাসি ফোটে; সে ভাষাকে পেতে কতই না কষ্ট করতে হয়েছে সেদিন রফিক-জব্বারদের। তারা না জাগলে আজ কোন ভাষায় মাকে ডাকতে হতো? আসলে কি এত মিষ্টি হতো মায়ের মুখের বুলি? আসলে কি মা উর্দুতে বলে শান্তি পেতাম? নিঃসন্দেহে বলা যায়, শান্তি মিলত না। কবির ভাষায় বলতে হয়— ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই/কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না।’

১৯৫২ সালের এই দিনে ভাষার জন্য রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। তবে একটি দুঃখের বিষয়, দুঃখের ইতিহাসের সঙ্গে বলতে হয়, বাংলার জন্য জীবন দিল রফিক-শফিকসহ আমাদের অনেক পূর্ব পুরুষ; অথচ আমরা কিন্তু সেই বাংলাকে কমই মনে রাখছি। আজ ১০০ জনকে বাংলা তারিখ ধরেন, ৯৫ জন পারবে বলে মনে হয় না। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি বলছি সেটা কোন ভাষা? ধরে নিলাম আন্তর্জাতিকতায় একুশে ফেব্রুয়ারি বলা হচ্ছে, তবে জাতীয় দিবসগুলো তো আমাদের নিজস্ব। কেন সেগুলোকে ইংরেজিতে প্রচলন করা হলো? আমরা কি বাংলাতে জনপ্রিয় করতে পারতাম না? বাংলাতে করলে কি মুখস্থ হতো না? ভেবে দেখা দরকার। ভেবে দেখা দরকার এই বাংলাকে কারা বিকৃত করছে। কারণ বাংলাকে বিকৃত করলে কষ্ট হবে ভাষাশহীদদের। সেইসঙ্গে বাংলা ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার চাই। চাই বাংলার ব্যাপক প্রচলন। আজকে দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বেড়ে যাচ্ছে। সেসব কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কি বাংলার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে পারবে? এসব প্রশ্ন আজ আমাদের কর্তাব্যক্তিদের কাছেই রাখতে চাই।

ভাষা আন্দোলন থেকে অধিকার আদায়ের শিক্ষা নেই। ভালোবাসার শিক্ষা নেই। দেশপ্রেমের শিক্ষা নেই। একত্রে পথ চলার শিক্ষা নেই। এখন সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারি উদ্যোগ এবং ব্যক্তি পর্যায়েও কাজ করা জরুরি বলে বোধ হচ্ছে। আজ এটাই সময়ের চূড়ান্ত দাবি।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!