• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
মৃত্যুপুরী হবে ঢাকা

ভূমিকম্পের অগ্নিঝুঁকি, শতবর্ষের চক্রে বাংলাদেশ


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ২, ২০১৯, ০৩:১৩ পিএম
ভূমিকম্পের অগ্নিঝুঁকি, শতবর্ষের চক্রে বাংলাদেশ

ঢাকা : গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ এই তিনটি ভূ-ভাগের গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলো ঘটেছে এই সংযোগস্থলের কাছাকাছি এলাকায়।

এ ছাড়া ভূমিকম্পের সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের যোগসূত্র নিবিড়, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। সেই শহর যদি গড়ে ওঠে অপরিকল্পিতভাবে, তাহলে ক্ষতির মাত্রা হবে কল্পনাতীত। ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে কখনো যদি সহনাতীত মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে তাহলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে-হারে মৃত্যু হবে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা-নাগাসাকির ক্ষয়ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে সোনালীনিউজ-এর পাঠকদের জন্য-

শতবর্ষের ভূমিকম্প সাইকেলে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। গত ২৫০ বছরে বাংলাদেশ ও নিকটবর্তী অঞ্চলের ভূমিকম্পের ঘটনা পর্যালোচনা, ভৌগোলিক অবস্থান সবকিছুর বিবেচনায় এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গবেষকরা বলছেন, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ এই তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এগুলোর মধ্যে সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের ভূ-অভ্যন্তরে যে শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, তা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের মধ্যে বা নিকটবর্তী অঞ্চলের এই ভূকম্পনের উৎপত্তিস্থল হলেও তা দেশের উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে রিখটার স্কেলে সাড়ে ৭ থেকে ৮ মাত্রায় অনুভূত হতে পারে। আর এমন মাত্রার ভূকম্পনের ইতিহাস ঘাঁটলে হতাহতের ভয়াবহ চিত্রই ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিকট ভবিষ্যতে এমন ভূমিকম্প হলে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই হতাহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারে কয়েক লাখ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের শীর্ষে থাকা ঢাকাতেই প্রাণহানির সংখ্যা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকি শহরের আণবিক বোমার হামলায় হতাহতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

নগর ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের এমন আশঙ্কার পেছনে রয়েছে বিগত সময়ের বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও সে কারণে হতাহতের অভিজ্ঞতা। গত ২৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ও এর আশপাশে ১০টি ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর মধ্যে ১৭৬২ সালে প্রায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে মিয়ানমারে। আর উৎপত্তিস্থল ছিল দেশটির আরাকান রাজ্যে। ১৮৬৯ সালে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূকম্পন আঘাত হানে ভারতের আসাম রাজ্যে। যার উৎপত্তিস্থল ছিল রাজ্যের কাছাড় জেলায়। ১৮৮৫ সালে বাংলাদেশ ও এর আশপাশে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে, যা বেঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে আসামে, যেটা গ্রেট আসাম ভূকম্পন নামে পরিচিত। এরপর ১৯১৮ সালে ৭ দশমিক ৬ মাত্রায় বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে, ১৯৩০ সালে ৭ দশমিক ১ মাত্রায় ধুবরিতে, ১৯৩৪ সালে ৮ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে ভারতের বিহার ও নেপালে, ১৯৫০ সালে ৮ দশমিক ৬ মাত্রায় আসামে, ২০১১ সালে ৬ দশমিক ৯ মাত্রায় তিব্বতের সিকিমে এবং ২০১৫ সালে নেপালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রায় ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে।

রাজধানীতে ঘটে যাওয়া তিনটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে এমন আশঙ্কার কথাই মনে করছেন তারা।

নিমতলী ট্র্যাজেডি : ২০১০ সালের ৩ জুনের পুরান ঢাকা ছোট কাটরার নিমতলী এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারায় ১২৪ জন। কেমিক্যালের গুদাম থেকে সৃষ্ট এই অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২৩টির মতো বসতবাড়ি, দোকানপাট ও কারখানা। ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তীব্রতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকারীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি আগুনের তাপের কারণে।

অগ্নিনির্বাপণের পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কেমিক্যালের অগ্নিকাণ্ডের কারণে তাপমাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, আশপাশে বেশ কয়েকটি ভবনের জানালার কাচ গলে দুমড়েমুচড়ে যায়। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার ভয়াবহতার পেছনে কারণ হিসেবে অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই দায়ী করা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থলে প্রবেশে প্রশস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের মতো অতিদাহ্য পদার্থের গোডাউন গড়ে ওঠা, বসতবাড়িতে হালকা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাকে দায়ী করা হয় ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে। নিমতলী ট্র্র্যাজেডির দুই বছর পরই অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ আরেক ঘটনা ঘটে ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যার পরপরই জ্বলে ওঠে সেখানে গড়ে ওঠা তুবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনের কারখানাটি। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে এই পোশাক কারখানাটিতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রাপাত ঘটে বলে তদন্তে উঠে আসে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান প্রায় ১১৩ জন পোশাক শ্রমিক।

আর ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহতার দিক থেকে অন্যতম একটি। ওই দিন কোনো ধরনের ভূকম্পন ছাড়াই ধসে পড়ে সাভারের ৮ তলা ভবন রানা প্লাজা। বিভিন্ন সূত্রের হিসাব অনুযায়ী এই ভবন ধসের ঘটনায় প্রাণ হারায় এক হাজার ১২৭ জন। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবীদের পুরো উদ্ধারকাজ শেষ করতে সময় লাগে ২০ দিন। আর পুরো জঞ্জাল সরাতে সময় লাগে কয়েক মাস। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার পেছনে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেই অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই। যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে ভবন নির্মাণ এবং নির্মাণে ত্রুটি থাকার কারণেই ঘটে এমন দুর্ঘটনা।

ঢাকার এমন ভয়াবহ তিন দুর্ঘটনাই জানান দেয়, আকস্মিক ভূমিকম্পে কী চিত্র হতে পারে দেশের রাজধানী শহরের। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্প পূর্বাভাস দিয়ে না ঘটনার কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের সংখ্যা বেশি ঘটে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়, গ্যাস, বিদ্যুতের মতো সেবা বন্ধ রাখা হয় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে। কিন্তু ভূমিকম্পে সে সুযোগ না থাকায়, আকস্মিক ভূমিকম্পে ঘটতে পারে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, ফেটে যেতে পারে বাসাবাড়ি ও শিল্প-কারখানার গ্যাসের সংযোগ লাইন। ফলে ভবনধসের পাশাপাশি ভূমিকম্পে রাজধানীতে একাধিক স্থানে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের মতে, রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় ঢাকা কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলো অপরিকল্পিত বিতরণ লাইন স্থাপন ও সংযোগ প্রদানের কারণে অবশ্যম্ভাবী এক ভয়ানক দুর্ঘটনার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজধানীবাসী।

তিনি বলেন, প্রথমত বিল্ডিং কোড মেনে কোনো ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে না। ভবনে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের যে সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে সেগুলোও ত্রুটিপূর্ণ। ফলে ভূমিকম্প সহনশীল নয় এমন ভবন যখন ধসে পড়বে তখন ওই ভবনের গ্যাসের লাইন ফেটে যাবে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ঘটবে। এতে ভবনধসের সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডেরও ঘটনা ঘটবে।

বাংলাদেশে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ইসরাত জাহান বলেন, সাড়ে ৬ থেকে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের রাজধানীর ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। এসব ভবনের আশপাশের ভবনগুলো অক্ষত বা সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেগুলোর বাসিন্দারাও আটকা পড়বে।

তিনি বলেন, নিমতলী আগুন, তাজরীন ফ্যাশনস আর রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা আমাদের উদ্ধারকাজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জেনেছি। রানা প্লাজার মতো একটি ভবন ধসেই মানুষ মারা গেছে প্রায় দেড় হাজার। উদ্ধারে সময় লেগেছে ২০ দিন। কয়েক মাসেও ধ্বংসস্তূপ সরানো সম্ভব হয়নি। সেখানে একসঙ্গে ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়লে ভয়াবহতাটা কেমন হবে, তা আন্দাজ করা যায়। হতাহতের দিক থেকে হিরোশিমা-নাগাসাকিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, নিকট ভবিষ্যতে আমরা যে ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছি, সে বিষয়ে সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কোনো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। যেখানে আমরা একটা ভয়াবহ ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে, সেখানে আমাদের প্রস্তুতিটা কী। রাজউকের কাছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা আছে। এসব ভবনের ব্যাপারে তাদের পদক্ষেপ কী। সংস্থাগুলোর তদারকির অভাবে প্রতিদিনই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা বড় হচ্ছে। রানা প্লাজা ধসের আগে ওই ভবনটা ঝুঁকিপূর্ণ কি না, সে ব্যাপারে কেউ কি কোনো কাজ করেছে? রাজধানী এমন হাজার হাজার রানা প্লাজা রয়েছে।

সম্ভাব্য ভূমিকম্প, প্রস্তুতি ও তালিকাভুক্ত সাড়ে ৫ হাজার ভবনের ব্যাপারে পদক্ষেপ সম্পর্কে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) আবুল কালাম আজাদ বলেন, রুটিন ওয়ার্কের ভিত্তিতে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ধারাবাহিকভাবে অপসারণ করছি।

এ ছাড়া নতুন নির্মাণ করা ভবনগুলোও যথাযথভাবে তদারক করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করা রাজউকের একার পক্ষে সম্ভব নয়। পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তিগত সাপোর্টও আমাদের নেই। এ ক্ষেত্রে অন্য সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!