• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে ঢাকা, ৭ মাত্রায় হবে পরিত্যক্ত


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৩, ২০১৯, ০২:২৯ পিএম
ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে ঢাকা, ৭ মাত্রায় হবে পরিত্যক্ত

ঢাকা : গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মিজ- এই তিনটি ভূ-ভাগের গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ভয়াবহ ভূমিকম্পগুলো ঘটেছে এই সংযোগস্থলের কাছাকাছি এলাকায়। এছাড়া ভূমিকম্পের সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের যোগসূত্র নিবিড়, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। সেই শহর যদি গড়ে ওঠে অপরিকল্পিতভাবে, তাহলে ক্ষতির মাত্রা হবে কল্পনাতীত।

বিগত নয় বছরে ভূমিকম্প ছাড়াই ঢাকা ও এর আশপাশে ঘটেছে ভয়ানক তিনটি অগ্নিকাণ্ড- তাজরিন ফ্যাশনস, নিমতলী এবং সবশেষ চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে কখনো যদি সহনাতীত মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তাহলেও তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা-নাগাসাকির ক্ষয়ক্ষতি ছাড়িয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে-

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ রয়েছে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। গবেষকরা বলছেন, ভূ-অভ্যন্তরে তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এই তিনটি গতিশীল আর এগুলোর মধ্যে সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের ভূ-অভ্যন্তরে যে শক্তি সঞ্চিত হয়েছে তা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।

গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের নিচে বেশ কয়েকটি ভূতাত্ত্বিক ফাটলরেখা থাকায় এবং সেগুলো ভূ-কম্পনের জন্য যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করায় যেকোনো মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে সাড়ে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ অন্যান্য জেলার ওপর। এমন ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকা হতে পারে পরিত্যক্ত নগরীর একটি। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই এমন ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে রাজধানীবাসীকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভূকম্পন সৃষ্টি হলে তা রাজধানীতে আঘাত হানতে পারে সাড়ে ৭ থেকে ৮ রিখটার স্কেলে। এতে এক নিমিষেই ধসে পড়বে রাজধানীর ৮৮ শতাংশ ভবন। আর ৩৫ শতাংশ ভবন পুরোপুরি ধ্বংস না হলেও ব্যবহারের উপযোগী থাকবে না সেগুলো।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১০০ বছর পরপর ভূগর্ভস্থ প্লেটগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশ যে তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করছে, সেগুলো ইতোমধ্যে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছে। শত বছর পরপর প্লেটের এমন পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গলের ওপর ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে ১৯১৮ সালে। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পে ওই অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি পরিবর্তন আসে ভৌগোলিক অবস্থারও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালের মতে, বাংলাদেশ রয়েছে ভয়াবহ একটি ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে। এর মূল কারণ সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান। শুধু বাংলাদেশ এবং এর আশপাশে, উত্তর সীমান্ত বরাবর রয়েছে বিশাল এক ডাউকিচ্যুতি- যা শিলং মালভূমির কারণে গঠিত হয়েছে। এই শিলং মালভূমির পাহাড়গুলোই যেকোনো মুহূর্তে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের জন্য। এছাড়া ভৌগোলিকভাবে এর অবস্থান তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলের ওপর। যেকোনো সময়ে এসব প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনে ঘটে যেতে পারে মহাদুর্যোগ।

মাকসুদ কামাল বলেন, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের আশপাশে বড় ধরনের ভূমকম্পন অনুভূত হয়েছে। সবশেষ ২০১৭ সালের ৬ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে হওয়ার পরও রাজধানী ঢাকায় এর প্রভাব পড়ে। আর এমন ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও উত্তরে শিলং মালভূমির পাদদেশের অঞ্চলগুলো এবং পূর্বদিকে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অঞ্চলের ভৌগোলিক প্রকৃতিই পাল্টে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ভূমিকম্পের কারণে রাজধানী ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। বহু প্রাণহানির পাশাপাশি আটকা পড়েই প্রাণ যাবে বহু মানুষের।

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ইসরাত জাহান বলেন, যে হারে ঢাকায় আবাসন গড়ে উঠছে, তার বেশিরভাগেই মানা হচ্ছে না বিল্ডিং কোড বা অন্যান্য নিয়মনীতি। আর ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার ৩৫ শতাংশ নরম মাটি হওয়ায় ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ।

এছাড়া ওয়াসা তার সরবরাহ করা পানির পুরোটাই তুলছে ভূগর্ভ থেকে। এতে ভূগর্ভস্থ মাটি, পলির প্রকৃতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ফলে ঢাকা বিশ্বের অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

তিনি বলেন, ২০০৯ সালের এক গবেষণায় দেখেছি ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ঢাকা শহরের অন্তত ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। সারা দেশে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় তিন লাখে। শুধু ধসে পড়া ভবনে চাপা পড়েই নয়, অক্ষত ভবনগুলোতে উদ্ধারকাজ করতে না পারার কারণে প্রাণহানির সংখ্যা হবে আরো ব্যাপক। রাজধানীতে বেশ কয়েকটি দুর্যোগে আমাদের উদ্ধার কার্যক্রমের যে সক্ষমতা দেখেছি, সেই আলোকেই এমনটা আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে উৎপন্ন হওয়া যেকোনো ভূমিকম্পে পুরো রাজধানীকে পরিত্যক্তও ঘোষণা করতে হতে পারে। আর উদ্ধারকাজ বা ধ্বংস হওয়া ইমারত সরাতে লেগে যেতে পারে বছরের পর বছর। নিমতলীর কেমিক্যাল গোডাউন, তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনা থেকে আমরা আমাদের উদ্ধার কার্যক্রমের সক্ষমতা সম্পর্কে জেনেছি। ঢাকার এমন বহু জায়গা আছে সেখানে উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছাতেও পারবে না।

নগর পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোসলেহ উদ্দিন হাসানের মতে, ঢাকার ওপর ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ভয়াবহতা হিরোশিমা-নাগাসাকির থেকেও ভয়ঙ্কর হতে পারে। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত ইমারত নির্মাণ প্রধান কারণ হলেও ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির জন্য অন্যান্য সেবাদান সংস্থার কার্যক্রমও দায়ী থাকবে। বিশেষ করে আবাসিক ভবনগুলোর গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেবে।

তিনি বলেন, ভূমিকম্প পূর্বাভাস দিয়ে আসে না। হঠাৎ সংঘটিত ভূকম্পনে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলো সংযোগ বন্ধ করার সুযোগ ও সময় কোনোটিই পাবে না। এতে গ্যাসের সাপ্লাই লাইনে ফাটল ধরবে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে অধিকাংশ সংযোগ, পাশাপাশি বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় শর্টসার্কিটের মতো ঘটনা ঘটবে। ফলে ভবন ধসে যাওয়ার পাশাপাশি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডও ঘটবে রাজধানীতে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!