• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভোটের আকাশে কালো মেঘ


বিশেষ প্রতিনিধি ডিসেম্বর ২৭, ২০১৮, ০৪:১০ এএম
ভোটের আকাশে কালো মেঘ

ঢাকা : আর তিন দিন পরেই ভোট। প্রচারণা চলবে আগামীকাল মধ্যরাত পর্যন্ত। তবে বহু প্রত্যাশিত ও আলোচিত এই নির্বাচন নিয়ে শেষ সময়ে দেখা দিচ্ছে হতাশা, দানা বাঁধছে ষড়যন্ত্রের শঙ্কা। কালো মেঘের ছায়া যেন গ্রাস করতে চলেছে নির্বাচনী আকাশ। শুধু ভোটার নয়, সরকার ও বিরোধী পক্ষ, প্রার্থী ও প্রচারণায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ঐক্যফ্রন্ট কি নির্বাচনে থাকছে- এ প্রশ্নও উঠছে নানা মহলে।  

সুষ্ঠু নির্বাচনের উপযোগী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি হয়নি বলে অভিযোগ করেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই পক্ষই। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আসছে ‘ভোট বানচালের’। আবারো ভোট বর্জনের গুঞ্জন ভাসছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। নির্বাচন কমিশন প্রধান ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রধানের মধ্যে বিতণ্ডা হয়েছে।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ড. কামাল মাস্তানি করেছেন। আর ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। দলীয় সূত্রের দাবি, ফ্রন্ট নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক এপিএস মিয়া নূরুদ্দীন আহম্মেদ অপুর প্রতিষ্ঠান থেকে নগদ ৮ কোটি ও ১০ কোটি টাকার চেক উদ্ধার করেছে র‌্যাব। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানিয়েছেন, নির্বাচনের চার দিন আগে ‘ভয়াবহ ষড়যন্ত্র’ বানচাল করা হয়েছে। দুবাই থেকে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা এসেছে দাবি করে তিনি বলেন, এর অধিকাংশই হুন্ডির মাধ্যমে আনা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল, জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করা।

এর মধ্যে মঙ্গলবার (২৫ ডিসেম্বর) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ঢাকা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের ওপর হামলা হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে আগামী দুই দিন রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্বেগের বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গতকাল নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দলীয় নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত করছে ঐক্যফ্রন্ট।

অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। ভোটের ন্যূনতম পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারছে না তারা। এই নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে, অবাধ হবে, গ্রহণযোগ্য হবে- এ প্রশ্ন ইতোমধ্যে জাতির সামনে এসেছে। তবে ক্ষমতাসীনদেরকে ফাঁকা মাঠে গোলের সুযোগ দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেন। পরিস্থিতির আলোকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দুয়েক দিনের মধ্যে নেওয়া হবে। কেন্দ্র থেকে আওয়াজ না দেওয়া হলেও মাঠের গুঞ্জন- শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকছে না বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট।

অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই সাধারণ মানুষের আশঙ্কাকে (নির্বাচন বানচাল) উড়িয়ে দিচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো দোষারোপের প্রথা ভাঙতে পারেনি। স্বার্থ হাসিলে তাদেরকে বিমাতার ভূমিকায় নামতে দেখা যাচ্ছে। এতে বারবার গণতন্ত্র ও উন্নয়ন হোঁচট খেয়েছে।   

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই সারা দেশে হামলা, মামলা ও গ্রেফতার চলছে। কেউ গ্রেফতার হচ্ছে পুরনো মামলায় আবার কেউ নতুনে। জামিন বাতিল করে অনেককে জেলে নেওয়া হচ্ছে। এ তালিকায় প্রার্থীও রয়েছেন। গত দুই মাসে সাড়ে ৭ হাজার নেতাকর্মীকে কারান্তরীণ করার অভিযোগ এনেছে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। নানা কারণে ঐক্যফ্রন্টের ২২ প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। কোনোটি নির্বাচন কমিশন, কোনোটি আদালত বাতিল করেছেন। বিষয়টিকে সরকারের ‘কারসাজি’ বলে অভিযোগ করেছে ঐক্যফ্রন্ট।

এদিকে উৎসবমুখর নির্বাচনী প্রচারণায় অন্যান্য দলের পোস্টার, লিফলেট এবং নির্বাচনী ক্যাম্প থাকলেও মাঠে নেই ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ, সরকার প্রচারণায় বাধা দিচ্ছে। প্রার্থীসহ প্রচারণায় থাকা নেতাকর্মীদের ওপর গুলিসহ হামলা করা হচ্ছে। বিড়াল ছানার মতো ছোঁ মেরে ধরে নিচ্ছে নেতাকর্মীদের। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হচ্ছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষমতাসীন জোটের নির্বাচনী অফিসে আগুন দেওয়া হচ্ছে। পেট্রোলবোমা ছোড়া হচ্ছে।

গত ২৪ ডিসেম্বর সেনা মোতায়েনের পর স্বাভাবিকের বদলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে বলে বিএনপির দাবি। ওই দিন ঐক্যফ্রন্টের দুই প্রার্থীসহ সারা দেশে অর্ধশতাধিক হামলা, ভাঙচুর এবং শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। তবে গত সোমবার পর্যন্ত পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও সামনের দিনগুলোতে উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির (এরশাদ) আচরণে রহস্য রয়েই গেছে। দলটির প্রধান এইচএম এরশাদ কয়েক দিন ধরে চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন। হঠাৎ বুধবার (২৬ ডিসেম্বর) রাতে দেশে ফিরছেন। সামাজিক গণমাধ্যমে একটি চক্র অপপ্রচার চালাচ্ছে আস্থার প্রতীক সেনাবাহিনীকে নিয়েও। সব মিলিয়ে সাধারণ ভোটারসহ খোদ প্রার্থীদের মধ্যেই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা বিরাজ করছে। প্রার্থীদের কাছেই কর্মী-সমর্থকদের প্রশ্ন- আদৌ নির্বাচন হচ্ছে তো?

এ প্রসঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধে ভোট দিয়ে ভোটাররা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারলেই প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে।

গতকাল তিনি বলেন, আর চার দিন পরেই ভোট। দুই দিন প্রচারণা চলবে। এই সময়ের মধ্যে পক্ষ-প্রতিপক্ষ কারোরই অস্থির হয়ে লাভ নেই। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে কেউ পার পাবে না। কারণ নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে আশঙ্কাটাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। গণতন্ত্র বারবার কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়েছে, চলার পথে হোঁচট খেয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, রাজনীতিবিদসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রশ্নটা (নির্বাচন না হওয়া) ঘুরপাক খাচ্ছে তা অমূলক নয়। অতীতে তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। রাজনৈতিক দলের মধ্যে দোষারোপের প্রথা ভাঙেনি। নিজের স্বার্থ পূরণ না হলে সাধারণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে তাদের বাধে না। আমরা ওয়ান ইলেভেনসহ বিভিন্ন সময় দেখেছি। এবারো নির্বাচনী আকাশে কালো ছায়া দেখছেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে ধরনের পরিবেশ দরকার তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা সেনাবাহিনী মাঠে নামলে সহিংসতা কমবে, কিন্তু তার উল্টোটা হয়েছে। প্রার্থী, নেতাকর্মী হামলায় আহত হচ্ছেন আরো বেশি। গ্রেফতার চলছেই। এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাশকে মেঘাচ্ছন্নই করবে।

তিনি বলেন, তারপরও আমি আশাবাদী। হাতে সময় আরো চার দিন আছে। ইসি, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছা করলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পারবে বলে মনে করেন এম হাফিজ উদ্দিন খান। তবে তার মতে আগামী দুই দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্বেগের।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!