• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ভোলার স্কুলবিহীন ঢালচর, আলোহীন প্রজন্ম


ভোলা প্রতিনিধি ডিসেম্বর ৫, ২০১৮, ০৫:১০ পিএম
ভোলার স্কুলবিহীন ঢালচর, আলোহীন প্রজন্ম

ভোলার মনপুরার প্রান্তিক জনপদ ঢালচরের এইসব শিশুরা আলোর মুখ দেখতে চায়। ছবি: সোনালীনিউজ

ভোলা : ১৩ বছরের কিশোর হাছানের স্বপ্ন বড় হয়ে র‌্যাবে চাকরি করবে। জলদস্যুদের থেকে চরবাসীকে রক্ষা করবে। ১২ বছরের বাবুর স্বপ্ন পুলিশের বড় অফিসার হওয়ার। শাস্তি দেবে অপরাধীদের। ১৩ বছরের কিশোরী রুমা বেগম স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে চরবাসীর সেবা করার।

দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরার প্রান্তিক জনপদ ঢালচরের এইসব কিশোর-কিশোরীদের স্বপ্ন আলোর মুখ দেখতে পারলো না। কারণ, ওদের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে লেখাপড়া করে শিক্ষিত হতে হবে। নদী বেষ্টিত ঢালচরে লেখাপড়া করার জন্য নেই স্কুল। হাইস্কুল তো দূরের কথা, লেখাপড়া সূচনার জন্য প্রাইমারী স্কুলও নেই। এর ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ঢালচরের ৬০০ শতাধিক শিশু।

সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, যে বয়সে হাছান, রহিম, রেশমা, সুরমা বেগমদের মতো শিশুরা পড়ালেখা করে স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা। ঠিক সেই বয়সে স্কুল না থাকার ফলে পড়ালেখা না করতে পেরে কেউ নদীতে মাছ ধরছে, কেউ মহিষ, গরুর রাখালের কাজে নিয়োজিত আছে। আর সুরমার মতো মেয়েদের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থেকে ঘরের কাজ করে সময় সময় পার করতে হচ্ছে।

সূত্র বলছে, মনপুরা উপজেলার বিচ্ছিন্ন ঢালচর ১৯৫৬ সাল সরকারের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করলেও মূলত এর বসবাস শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। পর্যায়ক্রমে চরে নদী ভাঙনের শিকার আশ্রয়হীন মানুষ বসতি গড়ে। চরের খাসজমিতে আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন সেখানকার মানুষ। তবে চরবাসীর অন্যান্য সংকটের পাশাপাশি শিক্ষা সংকট মারাত্মক আকার ধারণা করেছে।

বাসিন্দাদের পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এই চরে তিন হাজার মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে প্রায় ছয় শতাধিক শিশুও রয়েছে। কিন্তু এই শিশুদের শিশুদের শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর ফলে হাসান, বাবু, লাইজু, খাদিজা, পলি, রাছেল, রহিম, ইমাম, রাকিবদের মতো নাম না জানা শত শত শিশুদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে। ওই চরের বাসিন্দা খায়রুল জানান, ৩ ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে আমার ছোট্ট সংসার। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি আমি। স্বপ্ন দেখি সন্তানদের পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবো। সেই লক্ষে আমার বড় ছেলে মনির পাশের কলাতলী চরের একটি প্রাইমারী স্কুলে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা ও দারিদ্র্যতার কারণে তাকে আর বেশি পড়ালেখা করাতে পারিনি।

এখন ছোট ছেলে মেয়েদেরকে পড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও আমাদের ঢালচরে কোনো বিদ্যালয় নেই। এর ফলে বাড়ি ও মাছ ধরেই তাদের মূল্যবান সময় পার করছে। স্থানীয় জসিম উদ্দিন মাঝি বলেন, স্কুল-কলেজ না থাকায় এখানকার ছেলে মেয়েরা নদীতে মাছ ধরে। মহিষের বাথানে রাখালের কাজ করে।

যদি স্কুল থাকতো তাহলে পড়ালেখা করতো, নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া লাগতো না। স্থানীয় শিশু খাদিজা বেগমের মা শেফালী বেগম জানান, ঢালচরে কোন স্কুল মাদ্রাসা নেই। যার কারণে আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে পড়ালেখা করাতে পারি না। এখানে যদি স্কুল-মাদ্রাসা থাকতো তাহলে ছেলে মেয়েদেরকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে পারতাম।

একই এলাকার কুলছুম বেগম জানান, আমরা ঢালচরবাসী নাগরিক সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সরকার যদি আমাদের এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে দেয় তাহলে আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে পড়ালেখা করাতে পারতাম। তাদেরকে আর মাছ ধরতে নদীতে যেতে দিতাম না।

স্থানীয় বাসিন্দা খলিল জানান, সরকার যায়, কিন্তু আমাগো চরবাসীর খোঁজ-খবর নেয় না কেউ। শহরের এক জায়গার মধ্যে কয়েকটা স্কুল থাকে। কিন্তু আমাদের ঢালচরে কোন বিদ্যালয় নেই। স্কুল থাকলে আমাদের ছেলে মেয়েরা পড়ালেখা করতে পারতো।

ঢালচরে একটি মসজিদের ঈমাম আবুল রহিম জানান, এই চরে ৫ থেকে ৬ শতাধিক শিশু রয়েছে। তারা স্কুল-মাদ্রাসার অভাবে অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে যাদের ভবিষ্যৎ। যেখানে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে, সেখানে স্কুল না তৈরি করে কিভাবে জাতিকে শিক্ষিত করবে সরকার। আর এখানকার বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত চরের কয়েক হাজার অভিভাবকরা।

ঢালচরের মালিক কামাল উদ্দিন চৌধুরী জানান, এই চরের স্থানীয় পরিবারের শিশুদের শিক্ষার কথা চিন্তা করে স্কুলের জন্য আমি জায়গা দিয়েছি। একটি ঘরও নির্মাণ করা হয়েছিল।

কিন্তু প্রশাসন ও কিছু স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ঢালচরের নাম কেটে স্কুলটি অন্য চরে নিয়ে গেছে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি এই চরের শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সরকার এই খানে একটি স্কুল নির্মাণ করবে এটাই আমার প্রত্যাশা। চরাঞ্চলের শিক্ষার ব্যাপারে ভোলা প্রেস ক্লাবে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এটা এখন আর কোনো প্রবাদ নয়, এটা একটি দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ জন্য অবশ্যই সরকারকে শহর এবং শহরতলী স্কুলের শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি চরাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।

সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক যেখানে বাস করে সেই গ্রামঞ্চলে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সরকারের প্রদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য বিচ্ছিন্ন চরগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মান করার দাবি জানান তিনি।

এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সায়েদুজ্জামান জানান, প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসাবে গ্রামঞ্চলে ১ হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করবে। এরই অংশ হিসেবে যে গ্রামগুলোতে লোকবসতি বেশি, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। সেখানে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।

 সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!