ঢাকা : সম্প্রতি দেশজুড়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে কিশোর গ্যাং কালচার। রাস্তাঘাট, পাড়া, মহল্লা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং নামে উঠতি বয়সি তরুণরা। দাপটের সাথে চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, হুমকি, মারামারি, অপহরণ, ভাড়াটিয়া খুনি ও পথেঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্তসহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ড করে চলেছে তারা। ভয়ংকর কিশোর গ্যাং এখন রীতিমতো ভয়ংকর সন্ত্রাসীতেও পরিণত হয়েছে।
পকেটে নগদ টাকা, হাতে অস্ত্র ও মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে বুনো উল্লাসের সঙ্গে হত্যার মতো ঘটনা ঘটাতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। অতিসম্প্রতি এমনই একটি জঘন্য ঘটনা ঘটেছে বগুড়া জেলায়। নিজ ভাগনেকে লাঞ্ছিত হতে দেখে প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় রশিদুল ইসলাম নামের এক যুবক।
এ ছাড়া কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘর্ষে খুন হয় এক গার্মেন্ট শ্রমিক, সাভারে কিশোর গ্যাং সদস্য মিজানের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মাদক আস্তানায় নিয়ে গিয়ে নির্যাতন ও খুন করা হয় স্কুলছাত্রী নীলা রায়কে এবং কামরাঙ্গীচরে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে ১৫-১৬ জন কিশোর গ্যাং সদস্যের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় সজীব নামের ১৭ বছর বয়সি এক তরুণ ।
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইট স্টার গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আদনান হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং। অন্যদিকে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতেও বেরিয়ে আসে কিশোর গ্যাং কালচার এবং তাদের সংঘবদ্ধ অপরাধের ভয়ংকর চিত্র। পুলিশের ক্রাইম অ্যানালাইসিস বিভাগের তথ্যমতে, শুধু রাজধানী ঢাকাতেই কয়েক বছরে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ধান মিলেছে অন্তত ৫০টি এবং বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতেও তা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।
কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার মূল কারণ নেপথ্যে থাকা এলাকার নেতা কিংবা প্রভাবশালী বড়ভাইদের রাজনৈতিক ছত্রছায়া। ব্যক্তিগত স্বার্থে টাকার বিনিময়ে নেপথ্যে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কিশোর গ্যাংদের দিয়ে বিভিন্ন অসামাজিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ড করিয়ে থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এদের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করছে। ফলে একদিকে যেমন নেতা ও প্রভাবশালী বড়ভাইদের স্বার্থ হাসিল হচ্ছে, অপরদিকে কিশোর গ্যাং সদস্যদেরও নিজ নিজ এলাকায় আলাদা একটা প্রভাব বিস্তার হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোরদের মধ্যে হিরোইজম ভাব বেশি কাজ করে। যখন তারা দেখে যারা অপরাধ করছে, তারা সমাজে বেশ লাভবান তখন কিশোররা সেটিই অনুসরণ করে থাকে। তা ছাড়া আমাদের সমাজে নানা অসঙ্গতিও রয়েছে বটে। দেশীয় সংস্কৃতিকে দূরে ঠেলে বিদেশি সংস্কৃতিকে ধারণ করে কিশোররা নিজেদের জীবনে তার চর্চা করছে। অনলাইনভিত্তিক সস্তা জনপ্রিয় মাধ্যম টিকটক ও লাইকির মাধ্যমেও ‘অপু ভাই’য়ের মতো কিশোর গ্যাংও গড়ে উঠছে।
কিশোর গ্যাং দিন দিন একটি জাতীয় সমস্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং কালচার যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, এখনই মোক্ষম সময় এর লাগাম টেনে ধরার। যদিও ইতোমধ্যে প্রশাসন এ ব্যাপারে কিছুটা তৎপর হয়েছে কিন্তু সে তৎপরতা আরো জোরালো করতে হবে।
অত্যন্ত দুঃখজনক হচ্ছে, মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় কিশোর গ্যাংয়ের কিছু সদস্য গ্রেপ্তার হলেও কোনো বিচার না করে দু-চার দিনের মাথায় প্রভাবশালী নেতাদের সহায়তায় তারা ছাড়া পেয়ে যায়।
আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই তারা পূর্বের চেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে, বেড়ে যায় অপরাধপ্রবণতা। তাই কিশোর গ্যাং রোধে সর্বপ্রথম আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করার বিকল্প নেই। প্রতিটি এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে কিশোর গ্যাং সদস্যদের এবং একই সঙ্গে নেপথ্যে থাকা প্রভাবশালী নেতা কিংবা বড়ভাইদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আইন প্রয়োগে যেন বাধা-বিপত্তি না আসে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যথেষ্ট সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।
পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। আপনার সন্তানকে সুশিক্ষা দেওয়া আপনারই দায়িত্ব। তার দেখভাল আপনাকেই করতে হবে। পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষাই পারে উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েদের সুপথে পরিচালিত করতে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এখন প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষার বহুল পাঠ। শিশু-কিশোরদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা এবং তাদের সংশোধনের জন্য প্রতিটি জেলায় রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারও গড়ে তুলতে হবে।
কিশোরদের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিশু পরিচর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। তাদের সৃজনশীল ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। আমরা চাই, গ্যাং কালচারের এই ভয়ংকর অপরাধ থেকে সমাজকে বাঁচাতে, একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মও বাঁচুক।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :