• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভয়ঙ্কর সেলফি জ্বর


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ১০, ২০১৯, ০২:১২ পিএম
ভয়ঙ্কর সেলফি জ্বর

ঢাকা : সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক বা কমেন্ট পাওয়ার নেশাই তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে এই করুণ পরিণতির দিকে

কলিযুগ এখন ফেসফির। কারণে-অকারণে, পাত্রে-অপাত্রের সেলফির কেলফি মার্কা ছবিতে সয়লাব ফেসবুকসহ অন্যসব সামাজিক মাধ্যমগুলো। বিকৃত-ধীকৃত অঙ্গভঙ্গি ও ভাব-ভঙ্গিমায় এই আধুনিক অসুখটি বোধকরি চক্ষু লজ্জাটুকুও কেড়ে নিয়েছে। ঘরে-বাইরে, রাস্তায়-পার্কে, বিয়ে-শাদি, জন্মদিন-মৃত্যুদিন, হঠাৎ দেখা, প্রেম-প্রণয়ে সেলফির ভেলকি দেখে টাস্কি খাওয়ার উপক্রম।

আগে মানুষ বিনোদনকেন্দ্রে গিয়ে সৌন্দর্য অবলোকন করত, বসে কিংবা ঘুরে বেরিয়ে আনন্দময় সময় কাটাত। আর এখন সবখানে সেলফির ব্যস্ততা লক্ষণীয়। তার মানে সেলফি সত্যিই সবাইকে সেলফিস করে তুলছে। খারাপ খবরটি হলো- ডারমাটোলজিস্টরা জানাচ্ছেন, বারবার সেলফি তোলার ফলে স্মার্টফোনের আলো ও রেডিয়েশন সরাসরি পড়ছে মুখের ওপর। ফলে দেখা দিচ্ছে বলিরেখা, দেখাচ্ছে বয়স্ক। সেলফি ম্যানিয়ে নিয়ে পরিচালিত বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, অতিমাত্রায় সেলফি প্রবণতার ফলে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে মানুষ। সেলফি তোলা ও সেটি পোস্ট করতে এত মনোযোগ দিচ্ছে তারা যে আশেপাশের সবার সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানো দুরূহ হয়ে পড়ছে তাদের জন্য।

এ প্রসঙ্গে ব্রিটেনের লিনিয়া স্কিন ক্লিনিকের মেডিকেল ডিরেক্টর সিমন জোয়াকি বলেন, ‘মুখের কোন দিক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা দেখেই চিকিৎসকরা বলে দিতে পারেন আপনি কোন হাতে ফোন ধরে সেলফি তোলেন।’ সেলফিতে রুচি এবং বোধ ধ্বংসের নমুনা লক্ষণীয়। সেলফি দেখে মনে হচ্ছে কাছে থেকেও যেন সবে বহুদূরে। অনেকটা জোর করে ভালোবাসা প্রদর্শনের তুঘলকি কাণ্ড যেন সেলফি। মনে মনে হতাশার রেশ টেনে ভাবি আমরা কি সত্যিই সেলফিস হয়ে যাচ্ছি না। তবে সেলফিবাজদের জন্য দুঃসংবাদটি হলো- বেশি মাত্রায় নিজের ছবি তোলার এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার এই প্রবণতাকে গবেষকরা বলছেন এক ধরনের মানসিক সমস্যা ‘সেলফাইটিস’(Selfitis)। মার্কিন পত্রিকা ফোর্বসসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।  

চিকিৎসকদের মতে, সেলফি এখন আর অভ্যাস নয়, মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় পত্রিকা নিউজ এইটিন-এ প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সেলফি তুলতে ঝুঁকি নিতেও পিছপা হচ্ছেন না অনেকে। প্রতিবেদনে ভারতীয় চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সেলফিতে বাড়ছে উদ্বেগ। সেলফি তোলার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা, সেখানে বারবার কমেন্ট ও লাইক দেখা- সবকিছুই এখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসা না পেলে কমছে আত্মবিশ্বাস। অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা বাড়ছে, যা বাড়াচ্ছে অবসাদ।

সেলফি উন্মাদনা ক্রমশ বাড়ছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো- বিপজ্জনক মুহূর্তের ছবি তুলে তৎক্ষণাৎ তা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা স্ন্যাপচ্যাটে পোস্ট করা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইক বা কমেন্ট সংগ্রহের লোভেই মানুষ নিজের জীবনের বড় ঝুঁকি নিচ্ছে। এক জরিপে প্রায় ৪৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ স্বীকার করে নেন যে তারা সেলফি তুলতে ভালোবাসেন। ১৮ থেকে ৩৪ বছর পর্যন্ত ব্যক্তিরা বলেছেন, সপ্তাহে অন্তত একটা সেলফি তোলা তাদের চাই-ই চাই! আর সেলফি তোলার ক্ষেত্রে  ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে আছে মেয়েরা। যা না বলে উপায় নেই ‘সেলফি’ তোলার ঢল নেমেছে  গোটা পৃথিবীতে। এই ঢলে শামিল হতে গিয়ে অসাবধানতায় অসংখ্য মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেলফি, ঘুমোতে যাওয়ার আগে সেলফি। আবার সেলফির ঝোঁকে ঝুঁকিপূর্ণ সেলফি তুলতেও হুঁশ থাকে না অনেকের।

যেমন বাড়ির ছাদে, চলন্ত গাড়িতে, নৌকায়,  চলন্ত রেল গাড়ির সামনে সেলফি তোলেন কেউ কেউ। ঝুঁকিপূর্ণ সেলফি তুলতে গিয়ে অনেকের মর্মান্তিক মৃত্যুও হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটি ও দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন যৌথভাবে পরিচালিত ‘মি, মাইসেলফ অ্যান্ড কিলফি : ক্যারেক্টারাইজিং অ্যান্ড প্রিভেনটিং সেলফি ডেথস’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সেলফি তুলতে গিয়ে সারা বিশ্বে নিহতের সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে আছে ভারত। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণায়  দেখা গেছে, ২০১৪ সালের মার্চ থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেলফি তুলতে গিয়ে সারা বিশ্বে যত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, এর মধ্যে ৬০ শতাংশই ঘটেছে ভারতে।

পৃথিবীতে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজিস্টরা বলছেন,  ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং স্নাপচ্যাটের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় হতে চাওয়া কিংবা বেশি বেশি লাইক বা কমেন্ট পাওয়ার নেশাই তরুণদের ঠেলে দিচ্ছে এই করুণ পরিণতির দিকে।

কথা হচ্ছে আপনার পছন্দ হোক বা না হোক দিন দিন সেলফি জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ। এই সেলফি নিয়ে বিশ্বে কাণ্ড-অকাণ্ডের হিসাব বড়ই প্রকাণ্ড হবে। শুনলে চমকে যাবেন- লন্ডনের তিন সন্তানের মা লুসিও গ্রাডি সেলফিতে যাতে তাকে আকর্ষণীয় দেখায় এ জন্য ৩ হাজার একশ পাউন্ড ব্যয় করে অপারেশন করিয়ে নিজের লাবণ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন।

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন অব এস্টেটিক প্লাস্টিক সার্জনদের তথ্যমতে, সেলফিপ্রীতির কারণে নারীদের মধ্যে কসমেটিক সার্জারি করানোর প্রবণতা বেড়েছে শতকরা ১৩ ভাগ। মুখ ও কাঁধে এমন অপারেশন বেড়েছে শতকরা ১৬ ভাগ। সেলফি নিয়ে আরো মজার তথ্য হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে সেলফি আপলোডের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ফেসবুক।

মোট সেলফির প্রায় ৪৮ শতাংশ আপলোড করা হয় ফেসবুকে। ফিলিপাইনের মাকাতি শহরের মানুষ সবচেয়ে বেশি সেলফি তোলে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নিউইয়র্কের ম্যানহাটন। সেলফি তোলা দেশের মধ্যে এগিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কখনো না কখনো সেলফি তোলে। বাংলাদেশেও সেলফি প্রবণতা উল্লেখ করার মতো।

ভয়ের ব্যাপারটি হলো, সেলফি এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে মুমূর্ষু খাদিজাকে ICU -তে দেখতে গিয়েও সেলফি তুলেছেন বিবেকবান মানুষেরা! মানুষের মূল্যবোধের জন্য মহাক্ষতিকর  দিকটা দিন দিন মহামারী রূপ ধারণ করছে। শুধু তাই নয়, দেখা গেছে লঞ্চডুবির ঘটনায় ভিডিও ও সেলফি নিয়ে ব্যস্ত একদল নির্দয় মানুষ। অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় জানমাল বাঁচানোর বদলে অনেককে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় সেলফি, ভিডিও অথবা লাইভে।

প্রশ্ন হলো, একটি জীবন বাঁচানোর চেষ্টার চেয়েও কি জীবনগুলোর অন্তিম মুহূর্তকে ক্যামেরায় ধারণ করা খুব জরুরি? সেলফি আমাদের এই মানবীয় বোধটুকুও কেড়ে নিয়েছে! শুধু কি মানবীয় মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ আর অনুভূতিগুলো নিয়েও তামাশায় মত্ত হতে দেখা যায় সেলফিবাজদের। যেমন কবরস্থান তৈরি, লাশবহন ও দাফন কার্যেও সেলফি! মানুষ হিসেবে, মুসলমান হিসেবে এই সীমালঙ্ঘনের ক্ষমা নেই মহান আল্লাহর কাছে।

এমন কিছু সেলফি দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়- যেমন হাসপাতালে দেখতে যাওয়া রোগীর সাথে সেলফি! অপারেশন থিয়েটারে সেলফি! সেলফির এই প্রবণতা আমাদের কোথায় নিয়ে থামাবে কে জানে। এখন দেখা যাচ্ছে ইবাদত-বন্দেগিতেও সেলফির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। নামাজের মতো অঙ্গভঙ্গি করে কিংবা জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদে বসে সেলফি তুলছেন। ইশ! পবিত্র হজ পালন করতে গিয়েও আল্লাহর ঘরের সামনে সেলফি তুলছেন। এসবের ফলে আমাদের প্রতিটি আমলই হয় যেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সেলফি সবক্ষেত্রে খারাপর নয় যেমন- ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের ক্যান্সার সচেতনতার জন্য ‘নো মেকআপ সেলফি’ নামক এক অনলাইন ক্যাম্পেইন চালানো হয়। সে প্রচারে নামিদামি অনেক তারকা  মেকআপ ছাড়া তাদের সেলফি তুলে ইন্টারনেটে আপলোড করেন। ক্যাম্পেইনটি থেকে প্রায় সাড়ে ১২ মিলিয়ন ডলার ফান্ড পাওয়া যায় ক্যান্সার গবেষণার জন্য। তাই মানবতা বোধ ধ্বংসে নয়, মানব কল্যাণে হোক সেলফির সর্বোত্তম ব্যবহার।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সেলফির উত্থান ঘটে মূলত পর্নো সংস্কৃতিতে ব্যবহারের মাধ্যমে। তাদের দাবি, নিজেদের শরীর সুন্দরভাবে প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট করার জন্যই নারীরা সেলফি তুলত। নির্মম বাস্তবতা হলো, সেলফি ছাড়া আজকাল চলেই না। সেলফি শব্দটি ইংরেজি  সেলফিস অর্থ আত্মপ্রতিকৃতি থেকে এসেছে। অক্সফোর্ড অভিধানের মতে, সেলফি হলো একটি ছবি (আলোকচিত্র), যা নিজের তোলা নিজের প্রতিকৃতি। সেলফি নিয়ে অনেক মতান্তরও রয়েছে।

যদিও ১৮৩৯ সালে রবার্ট কর্নিলিয়াস নামের একজন মার্কিন আলোকচিত্রী প্রথম তার আত্মপ্রতিকৃতি ক্যামেরায় ধারণ করাকে দাবি করা হয়, এটিই বিশ্বের প্রথম সেলফি।

তবে বিভিন্ন তথ্য-তালাশে জানা গেছে, ২০০২ সালে একটি অনলাইন ফোরাম প্রথম ‘সেলফি’ শব্দটি ব্যবহার করে। যার সংজ্ঞায় বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে নিজের মানসিক অবস্থা জানাতে নিজের তোলা ছবি, নিজের সম্পাদনায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তুলে দিয়ে ভার্চুয়াল বন্ধুদের জানানো। তবে ফেসবুকের আগে মাইস্পেস বেশ জনপ্রিয় ছিল এবং সে কারণে সেলফি প্রথম জনপ্রিয়তা পায় সেখানেই।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুকে সেলফি শব্দটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারির অনলাইন ভার্সনে শব্দটি সংযোজিত হয়। আর ২০১২ সালের শেষদিকে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে শব্দটি বছরের আলোচিত সেরা ১০ শব্দের অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়। কারো কারো মতে, ‘সেলফি’ শব্দটি সবার আগে ব্যবহার করা হয় ২০০৪ সালে ফ্লিকারে।

যদিও ২০১০ সালের পরবর্তী সময়  থেকে মুখ বাঁকিয়ে, চোখ রাঙিয়ে কিংবা উদ্ভট অঙ্গভঙ্গিতে প্রতিবন্ধীর মতো সেলফি তোলাই ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। এগুলো ব্যবহার করে আপনি পাল্টে ফেলতে পারেন নাকের গড়ন, মুখের বলিরেখা,  চোখের রং, চোখের নিচের কালো দাগ এমনকি দাঁড় সোজা করতে পারেন। কিন্তু এ সব অ্যাপ ব্যবহার করেও সন্তুষ্ট নন অনেকে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!