• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত দেখাল শেকৃবির শিক্ষার্থীরা


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯, ০৫:০১ পিএম
মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত দেখাল শেকৃবির শিক্ষার্থীরা

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে আগুন নিভাতে সাহায্য করে শেকৃবি’র কয়েকশ শিক্ষার্থী

ঢাকা: রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। ৩ ঘন্টাব্যাপী আগুন নিভানোর চেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এসময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে আগুন নিভাতে সাহায্য করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) কয়েকশ শিক্ষার্থী।

প্রত্যক্ষদর্শী শেকৃবির ২০১৭ বর্ষের  শিক্ষার্থী সাইনুর  রহমান বলেন, মিনি মার্কেটে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে ধোয়া দেখতে পাই। এসময় আমরা তিন বন্ধু এগিয়ে গিয়ে দেখি আগুন জ্বলছে। এসময় ক্যাম্পাসের সাজিদ ভাইসহ আরো কয়েকজন বড়  ভাইকে পাই তারাও আগুন দেখে আসছে। দ্রুত ২য় তলায় গিয়ে দেখি ধোয়ায় আচ্ছন্ন। ধোয়ার কারণে ভিতরে প্রবেশ করতে পারছিলাম না। তারপরও ভিতরে প্রবেশ করি।

পরবর্তী ঘটনার বর্ণনায় শেকৃবির ৭২ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাজিদ আহসান শিকদার বলেন, কৌতুলবশত এগিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু ভিতরে গিয়ে দেখি পরিস্থিতি আরো সাংঘাতিক। আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলছে তৃতীয় তলার শিশু বিভাগ। তখনও ফায়ার সার্ভিসের কোনো গাড়ি আসে নি। বাহির থেকে মই জোগার করে জীবনের ঝুকি নিয়ে তারকাটা পার হয়ে গ্রিল ভেঙে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত হয় কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। বন্ধু এহসানুল মুনতাকিম রাস্তায় দাড়িয়ে থাকা উৎসুক জনতার ভিড় সরিয়ে ফায়ার সার্ভিসের আসার পথ সুগম করে দেয়। সঙ্গে যোগ দেয় ছোট ভাই মামুন, তোফায়েল, সোহানুর। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের একটা গাড়ি আসে। কর্মীরা এসেই কাজে নেমে পড়ে।

এই সময় উপস্থিত  হয় আমার দেখা মানবিক পুলিশ অফিসার সাত্যকী দাদা। সঙ্গে কাউকে না পেয়ে একাই হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করতে উদ্যত হয়। তাঁর সঙ্গে শেকৃবির ৫-৬ জন ছেলে যোগ দেয়। ধোয়া অপেক্ষা করে তারা সরাসরি যোগ দেয় উদ্ধার কাজে। তৃতীয় তলায় শিশু বিভাগে গিয়ে দেখি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল এর নেতৃত্বে কয়েকজন উদ্ধার কাজ করছিল। ততক্ষণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হাসপাতাল গ্যাসে ভরপুর। শেষ আটকে পড়া কোনো রোগী আছে কি না জানতে অন্ধকার ও বিষাক্ত গ্যাসের দুনিয়ায় প্রবেশ করি সবাই।  শেকৃবি টিমে সাত্যকী দাদার নেতৃত্বে মামুন, সাফায়েত, তোফায়েল, মাসুদ, সাইনুর কাজ করে যাচ্ছে।

প্রচণ্ড গ্যাসে কেউ রুমাল বেঁধে, কেউ শার্ট খুলে বেঁধে আর কেউ পাঞ্জাবী মুখে চেপে মোবাইলের আলোয় এগিয়ে যাচ্ছে।  প্রতিটা ওয়ার্ডে হাক দেয়া হচ্ছে কেউ আছেন? কেউ কি আছেন? পুরোটা খুঁজে আর কোনো সারাশব্দ না পেয়ে পুরো টিম ছুটে যায় আই সি ইউ তে থাকা রোগীদের উদ্ধার করতে। পুরো হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ লাইন অকেজো হয়ে যাওয়ার সবাই অক্সিজেনের অভাবে হাসফাস করছিল। কক্ষে থাকা অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। টিমের দুই তিনজন পিছনের স্টোর রুমের কাচের দরজা ভেঙ্গে এক সেবিকার নির্দেশে ৭-৮ টা অক্সিজেনের সিলিন্ডার নিয়ে আসলে এক এক করে সকল রোগীদের অক্সিজেনের সাপোর্ট দেয়া হয়। ঠিক তখনই উপস্থিত থাকা ডাক্তার আর সেবিকাদের সহযোগীতায় সকল যান্ত্রিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর আই সি ইউ এর বেড সহই রোগী নিচে নামানোর কাজ শুরু হয়, যোগ দেয় আরেক ছোট ভাই মুইদ।

সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ এবার। একেকটা বেড প্রচন্ড ভারী হওয়ায় প্রায় ১৪-১৬ জন  মিলে একটা একটা করে বেড নামানো হয়। পুরো সময় ধরেই সাত্যকী দাদা সহায়তা করে যান। সকল রোগীদের বের করে আম্বুলেন্স এ করে পাঠিয়ে দিয়েই তবে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।

অপরদিকে সরাসরি রোগী দেখভাল ও তাদের পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে স্থানান্তরের মাধ্যমে টানা ২ ঘন্টা উদ্ধারকার্যে সহায়তা করে শেকৃবি রোভার্সের ইতি ও সুরাইয়া। শেষে সুরাইয়া তো নিজের জুতোটা খুলে এক রোগীকে দিয়ে খালি পায়ে হেটে ফিরে আসে।  

শেকৃবির ১৮ ব্যাচের সোহানুর বলেন, হাসপাতালের উত্তরপার্শ্বে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। এপাশ দিয়ে উপরে উঠার সুযোগ ছিল না। উপায় না দেখে ক্যাম্পাসে গিয়ে মই নিয়ে আসি। আসার সময় বন্ধুদের বলে আসি সবাইকে নিয়ে আসতে। তারপর নেমে পড়ি আগুন নিভানোর কাজে। ফায়ার সার্ভিসের পাইপগুলো উপরে পৌছে দিতে সাহায্য করি। ১৮ ব্যাচের মাসুদ টানা কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। পানিতে ভেজা কাপড়ে ভিতর থেকে বের হয়ে আসেন মাসুদ।

এসময় তিনি বলেন, ভেতরে কেমিক্যালের গন্ধে থাকা যায় না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাই বাইরে চলে আসছি। নিচের তলায় কার্টন, কাগজপত্র, ওষুধ  সব কিছু আগুনে পুড়ছে।

এদিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে শেকৃবি ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম মাসুদুর রহমান মিঠু এবং সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে হাজির হয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। তারাও নেমে পড়ে আগুন নিভানোর কাজে। টানা ৩ ঘন্টাব্যাপী আগুন নিভাতে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ১৬ টি ইউনিট,  স্থানীয় বাসিন্দা এবং শেকৃবির শতাধিক শিক্ষার্থী।

সাজিদ বলেন, আজকের এই দিনে (১৪ ফেব্রুয়ারি)  সেবার কাজে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এমন একটা টিমের সবাই আমার কাছের ছোটো ভাই ছোটো বোন ভেবে নিজেকে আজকের দিনে গর্বিত মনে হচ্ছে। সাবাস শেকৃবি উদ্ধারকারী টিম। সাবাস মানবতার সৈনিক।

সোনালীনিউজ/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!