• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষই বিপদ ডেকে আনছে


ফিচার ডেস্ক এপ্রিল ৮, ২০১৯, ১১:৫২ এএম
মানুষই বিপদ ডেকে আনছে

ঢাকা: মানবিক মূল্যবোধে সারা পৃথিবীতে ধস নেমেছে— এ কারণে কোনো দেশই সন্ত্রাসবাদের হুমকি থেকে মুক্ত নয়। সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং বৈশ্বিক অভিশাপও যা মানবসৃষ্ট। মহাবিশ্বের এই ক্ষুদ্র গ্রহ পৃথিবীতে যেসব কর্মকাণ্ড ঘটছে, মহাজগতের অন্য কোথাও তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবার উপরে মানুষ সত্য, যার হুঁশ-জ্ঞান আছে, প্রকৃত অর্থে সে-ই মানুষ। দুনিয়ায় এখন এ ধরনের মানুষের দুর্ভিক্ষ চলছে।

পৃথিবী নামক গ্রহটি এখন স্রষ্টার সৃষ্টি জীব মানুষের কারণে অসুস্থতার পথে হাঁটছে। দেশে এবং বিদেশে চোখ বুলালেই দেখা যায় মানুষের অবিচারে খুন আর খুন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে গত এক বছরে লক্ষাধিক মানুষ নির্বিচারে খুন হয়েছে এই গ্রহটিতে। এই সংখ্যা আরো বেশি বলে মন্তব্য করেছে সিএনএন, বিবিসি এবং আলজাজিরার মতো গণমাধ্যমগুলো। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুই মসজিদে গুলি চালিয়ে ৫০ মুসল্লিকে হত্যা করেছে উগ্র শ্বেতাঙ্গ খুনি ব্রেনটন ট্যারেন্ট। নিউজিল্যান্ড শান্ত ছবির মতো একটি সুন্দর দেশ। দেশটির ক্রাইস্টচার্চ শহর আরো সুন্দর দেখতে, বিশেষ করে ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের কাছে। এমন একটি শান্তশিষ্ট ছবির মতো শহর গত ১৫ মার্চ শুক্রবার রক্তাক্ত হলো। ৫০ নিরীহ মানুষের প্রাণহানির পর পুরো শহর যেন ব্যালো স্কার্ফ দিয়ে মোড়ানো। শোক প্রকাশের ভাষাও ম্লান হয়ে গেছে। নীরবতাই যেন হয়ে উঠেছে সেই শোকের সর্বজনীন ও একমাত্র ভাষা। শহরের হঠাৎ এই বিপর্যয়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছে মানুষ। এরকমই একটি অবস্থা লক্ষণীয় দেশটিতে। দুঃখজনক যে, পশুও নিরাপদ বনাঞ্চলে কিন্তু সভ্যতার দাবিদার মানুষ ততটা নিরাপদ নয় স্বদেশে, স্বভূমিতে। প্রাণী গবেষকরা এমন কথাই এখন স্পষ্টভাষায় উচ্চারণ করছেন। তারা বলছেন, বনে-জঙ্গলে খুনাখুনি নেই, বিদ্রোহ নেই, তাই বিদ্রোহ দমন করার জন্য বিভিন্ন বাহিনীকে সেখানে যেতে হয় না। কিন্তু মানুষ যে গ্রহটিতে বসবাস করে— বড় বড় পদ-পদবি নিয়ে সভ্যতার বুলি আওড়ায়, তারাই আবার মারণাস্ত্র তৈরির পর বিক্রি করে মানুষের নিরাপত্তার দোহাই তুলে। সামান্য কয়েক ডলারের অস্ত্র বিক্রি করছে সাধারণ মানুষের কাছে। যে মানুষটি মানুষকে খুন করে, তারও বাবা-মা, ভাই-বোন এবং স্ত্রী ও শিশুসন্তান আছে। একবারো সে ভেবে দেখে না খুন করার সময় এ বিষয়টি যে, তাদের যদি কেউ হত্যা করত তাহলে আমার কেমন লাগত। এতে বোঝা যায়, একশ্রেণির মানুষের বিবেক শয়তানের নিয়ন্ত্রণে আছে বলেই হিংসা-বিদ্বেষ থেকে খুনাখুনিতে তা বিস্তার লাভ করছে। তারই প্রমাণ ব্রেনটন ট্যারেন্ট, যিনি সাধারণ মানুষ থেকে ভয়ঙ্কর ঘাতকে পরিণত হয়েছিল।

শুধু বিদেশে নয়, এবার একটু চোখ ফেরাই বাংলাদেশের দিকে। ১৮ মার্চ ২০১৯ রাঙামাটির রাখাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে নিহত ৭। গুলিবিদ্ধ ২৫। পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় এসে দেশবাসীকে দেখতে হলো মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা। অনেকটা একদলীয় ও ভোটারবিহীন নিরুত্তাপ এ নির্বাচনে ১৮ মার্চ পার্বত্য জেলা রাঙামাটির রাখাইছড়ি উপজেলায় ভোটগ্রহণ শেষে ফেরার পথে অস্ত্রধারীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন পোলিং অফিসার ও আনসার ভিডিপির নারী সদস্যসহ ৭ জন। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়েছেন প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিশসহ নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকারী আরো ২৫ জন। নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছেন, বিছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো এ আক্রমণ চালিয়েছে। সেখানে পাহাড়ি সংগঠনগুলো ভোট বর্জন করেছে। এর কিছুদিন আগে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৭১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন রাজধানীর চকবাজার এলাকায়। ২০১৯ সালের শুরুতে যে তিনটি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হলো, তার সবগুলোই মানবসৃষ্ট। মৃত্যু এখানেই থেমে থাকেনি, অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে (সূত্র আমাদের সময়, ১৯,০৩.১৯)। এদিকে ২০ মার্চ ২০১৯ বিশ্ব সুখী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ সুখী-অসুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করে। বিশ্বজুড়ে সুখী দেশের তালিকায় ১০ ধাপ পিছিয়ে ১২৫তম অবস্থানে বাংলাদেশ। এ তালিকায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। বিশ্বের ১৬৫টি দেশের জনগণের আয়, স্বাধীনতা, বিশ্বাস, গড় আয়ুর সম্ভাব্যতা, সামাজিক সহায়তা ও উদারতা- এই ছয়টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সুখী দেশের তালিকা প্রণয়ন করেছে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক বিভাগ। এসব দেশের ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ শেষে এবারের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের এ জরিপে বাংলাদেশ ১১৫তম সুখী দেশ থাকলেও এ বছর তালিকায় স্থান হয়েছে ১২৫তম। অন্যদিকে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা ভারতের অবস্থান ১৩০তম এবং শ্রীলঙ্কার অবস্থান ১৪০তম। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান সবচেয়ে ভালো। তারা ৬৭তম অবস্থানে আছে। এ ছাড়া ভুটান ৯৫তম, নেপাল ১০০তম। এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বেশিরভাগই ইউরোপীয় দেশ। তালিকাটিতে সবচেয়ে অসুখী বা সুখী দেশের একদম তলানিতে অবস্থান (১৫৬তম) করছে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ সুদান। ২০১৩ সাল থেকে জাতিসংঘ ২০ মার্চকে বিশ্ব সুখী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। একই সঙ্গে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টও করে আসছে। এ বছরের তালিকায় ৯৫তম অবস্থান দখল করেছে বিশ্ব সুখী দিবস পালনের প্রস্তাবকারী দেশ ভুটান (সূত্র : জাতীয় দৈনিক, ২২ মার্চ ২০১৯)। দেশের চলমান অবস্থা নিয়ে কিছু লিখতে হয়।

আমাদের দেশের শাসক মহল বহুদিন পর স্বীকার করেছে, সড়ক ব্যবস্থাপনায় আমরা সত্যিকার অর্থে ব্যর্থ হয়েছি। প্রতিদিন যে হারে মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিএমপি কমিশনার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনগণের সহযোগিতা কামনা করেছেন। এটা যে সর্বজনীন ব্যবস্থা ছাড়া নিরসন সম্ভব নয় তা বুঝতে পারার জন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। পরিবহনে যে নৈরাজ্য চলছে তা বড় আকারে উপলব্ধি আসে ২৯ জুলাই ২০১৮ বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের পর থেকে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ করে আসছে শিক্ষার্থীরা। কিছুদিন আগে সুপ্রভাত পরিবহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর (২০) মৃত্যুর প্রতিবাদ এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে বৃহস্পতিবার ২১ মার্চও আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীরা।

উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করে ২৮ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করে। সড়কে নামলেই দুর্ঘটনার ভয়! ২৪ ঘণ্টায় ১৮ মৃত্যু (কালের কণ্ঠ, ২৩.০৩.১৯)। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গত ৪৮ বছরে সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে সড়ক ও জলপথে। বিশ্বে অন্য কোনো দেশে সড়কপথে এত মানুষ প্রাণ হারায়নি। দেশের নগরবিদদের এসব বিষয় চিন্তা করা দরকার। কীভাবে যানবাহনে মানুষের প্রাণহানির লাগাম টেনে ধরা যায়, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রেখে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে। অন্যথায় মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে। আমাদের দেশে সুশাসনের এবং সুবিচারের অভাব প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের চিন্তা-ভাবনা করা সময়ের দাবি। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষ। ২৩ মার্চ ২০১৯ বণিক বার্তা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার লিড নিউজ ছিল- শুধু সাভার অংশেই বংশী নদী দখল করেছে ৬৫ প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। সাভার ভূমি অফিস পরিচালিত জরিপে উঠে এসেছে নদী দখলদারদের নাম। আমরা দেশকে ভালোবাসি- এ কথাটির যথার্থ প্রমাণ মিলবে যখন আমরা জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যারা কাজ করবে, তাদের সহযোগিতা করলে এবং বিরুদ্ধে যারা কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুললে। তাহলেই দেশটা সুন্দর হবে এবং ভালো থাকব আমরাও।

 লেখক : সমাজ বিশ্লেষক

সোনালইনউজ/ঢাকা/এসআই

Wordbridge School
Link copied!