• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মালেক ৩৮ বছরেই শতকোটি টাকার মালিক


নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০, ০২:৪১ পিএম
মালেক ৩৮ বছরেই শতকোটি টাকার মালিক

ঢাকা : নিয়োগ, পদোন্নতি আর বদলি তদবির করেই মালেক গত ৩৮ বছরে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। যেহেতু তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গাড়িচালক ছিলেন সেহেতু বিভিন্নভাবে তাদের ম্যানেজ করেই কোটি টাকা কামিয়েছেন। যখন কোনো নিয়োগ এসেছে কিংবা পদোন্নতির বিষয় এসেছে তখনই সক্রিয় ছিলেন মালেক। আর বদলির বিষয়টি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। যদি কেউ বদলি হতে চেয়েছেন মালেকের কাছে গেলেই মালেক তাকে বদলির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর এভাবে উত্থান হয়েছে মালেকের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মচারীর সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

গ্রেফতারের আগেও মালেকের সম্পদের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধান চলা অবস্থায় র্যাবের হাতে গ্রেফতার হলে মালেকের সম্পদের বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়োগ-বাণিজ্য করেই সবচেয়ে বেশি অর্থ কামিয়েছেন মালেক। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মচারী সমিতি ও চালক সমিতির নিয়ন্ত্রণ তার হাতে ছিল। নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের যে কোনো অনুষ্ঠানের আলোকসজ্জা বা অন্যান্য ডেকোরেশনের কাজও তার পছন্দমতো হতো। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছিল টাস্কফোর্স। ওই সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের দুর্নীতিবাজদের তালিকায় মালেকের নাম ছিল। তখন কিছুদিনের জন্য তিনি গা-ঢাকাও দেন।

তদন্তসংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মালেক অষ্টম শ্রেণি পাস হলেও অত্যন্ত চতুর ও ধূর্ত। যে কর্মকর্তাকে যা দিয়ে খুশি করলে কাজ উদ্ধার হবে, সেটাই তিনি করতেন। অনেক সময় নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে ‘নারীদের’ ব্যবহার করতেন মালেক।

সূত্র জানায়, মালেক ১৯৮২ সালে সাভারে একটি স্বাস্থ্য প্রকল্পে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। দুই বছর পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলে তার চাকরি স্থায়ী হয়। এরপর প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরে গাড়িচালক হিসেবে বদলি হন। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত কাগজে-কলমে সেখানেই তিনি গাড়িচালক ছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক শাহ মনিরের আমলে মূলত তার উত্থান। নানা সময় বিভিন্ন ডিজির গাড়ি চালিয়েছেন।

সর্বশেষ চালিয়েছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েতের গাড়ি। এর আগে চালিয়েছেন সদ্য সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদের গাড়ি। দুজনের সঙ্গেই মালেকের বেশ সখ্য ছিল।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে মালেক জানান, সাবেক ডিজি শাহ মনিরের আমলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১০০ জনের বেশি জনবল তার সুপারিশে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিজনের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্য অধিদফতরে কর্মরত কোনো কর্মীর সন্তানের চাকরি দরকার হলে অনেক সময় তারা মালেকের শরণাপন্ন হতেন। তাকে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করতে পারলে চাকরি হয়ে যেত।

শুধু অন্যদের চাকরি নয়, মালেক তার নিজের মেয়ে, জামাতা, ভাই, ভাতিজাসহ স্বজনদেরও নানা পদে চাকরি দিয়ে পুরো অধিদফতরকেই যেন পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক ডিজি শাহ মনির সাংবাদিকদের বলেন, ‘১০ বছর আগে আমি মহাপরিচালক ছিলাম। তখন কেউ মালেকের দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো তথ্য আমাকে দেয়নি। তখন সে মতিঝিল কলোনিতে থাকত বলে জানতাম।’ সে সময় নিয়োগের ক্ষেত্রে মালেকের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে শাহ মনির বলেন, নিয়োগের জন্য কমিটি থাকে। মালেকের কোনো প্রভাবের কথা আমার জানা নেই। আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে কখনো তার কথাও হয়নি।

এর আগে রোববার স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত সাংবাদিকদের জানান, চার বছর ধরে মালেক তার গাড়ি চালিয়ে আসছেন। তবে তার অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর তার কানে আসেনি।

তদন্তসংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত তুরাগের দক্ষিণ কামারপাড়ায় রমজান মার্কেটের উত্তর পাশে ছয় কাঠা জায়গার ওপর সাততলার দুটি আবাসিক ভবন তৈরি করেছেন মালেক, যার নাম ‘হাজী কমপ্লেক্স’। এ দুটি ভবনে ২৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর একটি ভবনের তৃতীয় তলার এক আলিশান ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দিয়েছেন।

এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মালেকের আরো ১০ থেকে ১২ কাঠা জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে ধানমন্ডি মৌজার হাতিরপুল এলাকায় সাড়ে চার কাঠা জমিতে ১০ তলা ভবন নির্মাণাধীন। তার বড় মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়া এলাকায় ১৫ কাঠা জায়গার ওপর গড়ে তুলেছেন একটি গরুর খামার। ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে ওই খামারে অন্তত ৫০টি বাছুরসহ গাভি রয়েছে। শিগগিরই মালেকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা হচ্ছে। এরপর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে-বিদেশে মালেকের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করবে।

গত ২০ সেপ্টেম্বর দিনগত রাত সোয়া ৩টার দিকে রাজধানীর তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়া বামনার টেকের ৪২ নম্বর হাজী কমপ্লেক্স ভবন থেকে অস্ত্র-গুলি ও জালনোটসহ আবদুল মালেক ওরফে ড্রাইভার মালেককে (৬৩) গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-১। ওই বাসায় মালেকের শোয়ার ঘর থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, এক লাখ ৫০ হাজার টাকার জালনোট, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল ফোন জব্দ করে র্যাব।

পরদিন র্যাব বাদী হয়ে তুরাগ থানায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে। এরপর সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) গ্রেফতার মালেককে আদালতে উপস্থাপন করলে দুটি মামলায় সাতদিন করে মোট ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

গ্রেফতার আবদুল মালেক তার কর্মজীবনে অধিদফতরের সাবেক বেশ কয়েকজন মহাপরিচালকের (ডিজি) গাড়িচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মালেক সর্বশেষ স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তবে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর।

এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আশিক বিল্লাহ বলেন, মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। ফৌজদারি আইন লঙ্ঘনের কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মালেকের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের বিস্তর ফারাক রয়েছে। তবে তার সম্পদের বিষয়ে র্যাবের কোনো বক্তব্য নেই।

তিনি বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, গ্রেফতার মালেকের বিষয়ে দুদক, সিআইডি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রয়োজন বোধে যদি কোনো সহযোগিতা চায়, তবে র্যাব তাদের সহযোগিতা করতে বদ্ধপরিকর।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!