• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে বঙ্গবন্ধু


হারুন-আর-রশিদ সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯, ১১:৪৩ এএম
মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে বঙ্গবন্ধু

ঢাকা : বঙ্গবন্ধু যখন একটি ইতিহাস, তখন তাকে সেভাবে লেখনীর মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হবে। তিনি নেতা হওয়ার জন্য রাজনীতি করেননি।

৬ দফা, ১১ দফায় জনগণের উদ্দেশ্য তুলে ধরে তা তিনি প্রমাণও করেছেন যে, তার রাজনীতি জনগণের স্বার্থে, ব্যক্তিস্বার্থে নয়। পূর্ববাংলার মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধু এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেননি। ৫৫ বছর জীবনে কারাবরণ করেছেন ১২ বছর। স্বপ্নের স্বাধীন দেশে তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। তিনি যোগ্যতার মাধ্যমে সফল রাষ্ট্রনায়কে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এ সময়।

আমার এখনো মনে আছে বঙ্গবন্ধু কীভাবে গণমানুষের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। সেই ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ববাংলার ৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগকে দুটি আসন ছাড়া বাকি সব আসনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস যুদ্ধ করার পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। সাতই মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক সমর্থন দিয়েছিল।

আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুব কাছ থেকে দেখেছি ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্রে কারামুক্তির পর চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। থাকতাম চট্টগ্রামে মহকুমা শহর পটিয়ায় বাবার সঙ্গে। বাসে চট্টগ্রাম শহরে আসতে সময় লাগত মাত্র ৩০ মিনিট। বাবা ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন। আমি রাজনীতিসচেতন মানুষ বলেই নামিদামি নেতাদের জীবনী পড়তাম। তাদের মিটিং-মিছিলে যেতাম বক্তব্য শোনার জন্য, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য শোনার সুযোগ ঘটেছিল একাধিকবার। একটি ভাষণের কথা আমি কখনো ভুলব না।

সম্ভবত ১৯৬৯ সাল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারা মুক্তির পর চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে ওই ভাষণটি তিনি দিয়েছিলেন। জনসভাটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ময়দানে জায়গা না পেয়ে আদালতসংলগ্ন পাহাড়ে, খুরশিদ মহল সিনেমার পার্শ্ববর্তী সড়কে, আন্দারকিল্লা, আসাদগঞ্জ, খাতুনগঞ্জ পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। এরকম দৃশ্য সত্যিই বিরল। বক্তৃতা সভামঞ্চের পাশে আমি বসেছিলাম। দুপুর ১১টার সময় আসতে পেরেছিলাম বলেই জায়গাটা পেয়েছিলাম। এই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। সাদাসিধা মানুষ, উচিত কথাগুলো স্পষ্ট ভাষায় তার মতো আর কেউই বলতে পারত না। বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, আমি দেখছি একটি সিনেমার পোস্টার, আপনার কি তা দেখতে পাচ্ছেন? সবাই বলছেন দেখছি। কী দেখছেন? খুরশিদ মহলে ‘আলি বাবা ও তার চল্লিশ চোর’।

এই ছবিটি চলছে। আপনারা জানেন— এই আলি বাবা কে? মোনায়েম খাঁ ও তার মন্ত্রিসভার সদস্য হলো ৪০ চোর। এসব মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের সকল মানুষের রক্ত শোষণ করছে, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। এই শোষিত মানুষের পক্ষে আমার যুদ্ধ। তারা শোষণমুক্ত হলে আমি আত্মায় সুখ খুঁজে পাব। আপনারা শোষণ থেকে মুক্তি পাবেন। জনগণকে উদ্দেশ করে বললেন, আপনারা কি মুক্তি চান? গগনবিদারী আওয়াজ শুনতে পেলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ...। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই— যদি তা না দেন তাহলে জনগণকে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তুলব।

আমরা যে বাড়িতে থাকতাম সেই বাড়িটি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে হানাদার বাহিনীর বিমান থেকে ফেলে দেওয়া বোমা বা অগ্নিবোমার শিকার হয়। টিনের বাড়ি, চারদিকে বেড়া দেওয়া ঘর। প্রথম শ্রেণির সরকারি অফিসাররা ওই বাড়িটিতে থাকতেন। বাবার সঙ্গে আমরাও থাকতাম। বোমা নিক্ষেপের কারণে নিমিষেই তা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমরা যে বাড়িটিতে থাকতাম সেটা খান সেনাদের টার্গেটে পরিণত হয়। এলাকার একজন ডাক্তার হাবিবুল ওয়াহেদ ওই বাড়িগুলোর মালিক ছিলেন। বেদনাদায়ক ঘটনা দেখে তিনি শিশুর মতো কাঁদছিলেন। এপ্রিল মাসের ওই ঘটনার কথা স্মরণ হলে বুকটা এখনো কেঁপে ওঠে। কীভাবে বেঁচে ছিলাম তা বর্ণনা করলে আরেকটি নিবন্ধ লাগবে। বাবার ৩০ বছরে চাকরি জীবনে যা ছিল, সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ওই যুদ্ধের সময় আমি ও আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গভীর রাতে আলাপ করতাম— কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, বিশেষ করে পটিয়া শহরকে কীভাবে মুক্ত করা হবে। আমরা এতটাই আশান্বিত ছিলাম যে দেশ অতিসত্বর শত্রুমুক্ত হবে। আমরা সাবধানতার সঙ্গে কাজ করতাম। রহমানিয়া হোটেলে গভীর রাত পর্যন্ত আমরা আড্ডা দিতাম এবং যাবতীয় খবরাখবর নিতাম। আমাদের এলাকায় কর্নেল অলি, মেজর রফিকের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও আমাদের সঙ্গে আলাপ করতেন। যুদ্ধের সময় আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ছাত্র ছিলাম। যেদিন শুনলাম বঙ্গবন্ধুকে অ্যারেস্ট করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তখন মানুষ ভাবছিল, আমাদের বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেটাই ঘটেছে, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম মাত্র নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে। এরকম দৃষ্টান্ত বিশ্বে বিরল ঘটনা বলা যায়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতা অর্জনের টার্নিং পয়েন্ট। সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানুষকে উজ্জীবিত রেখেছে।

নেতা এখন কারাগারে, আমরা এখন যুদ্ধের ময়দানে— এমনই এক অবস্থায় আমরা যুদ্ধে বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করে যাব। কেউই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণটিকে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষণটিকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনেকেই বলেন জাতিকে একটি হাইভোল্টে মোটিডেশন— যার মাস্টার মাইন্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেমন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই একটি মাত্র বাক্য জনগণের রক্তকণিকায় বিপ্লবের স্রোতধারা প্রবাহিত করে। তরুণদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর একটি বাণী— ‘পড়ো, জানো, শেখো, বোঝো। তারপর বিপ্লবের কথা বলো। বিপ্লব রাতের অন্ধকারে গুলি করে, টেররিজম করে হয় না। মানুষ মরতে পারে কিন্তু নীতি বা আদর্শ মরে না কোনোদিন।’

বঙ্গবন্ধু যে একজন ভালো লেখক সেটা আমরা জনতে পারি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুটি পড়ে। তার এই বই দুটিতে দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে— পড়ো, জানো, শেখো, বোঝো’ এবং দ্বিতীয়টা হলো ‘সিনসিয়ারিটি অব অনেস্টি’। কোনো মানুষ যদি উল্লিখিত বাক্য দুটি নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারেন, তাহলে তার সাফল্য অবধারিত। বঙ্গবন্ধুর এই শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।

যারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ান তারা ভয়ানক রোগে আক্রান্ত। স্বাধীনতা অর্জনের নেপথ্য কারিগর যে শেখ মুজিবুর রহমান এটা অবিশ্বাস করা পুরো বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। বিচক্ষণ ব্যক্তিরা তা শিকার করেছেন। কোনো মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। সেই হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কিছু না কিছু দোষত্রুটি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মানুষ চায় তার সৎকর্মের পাল্লাটা যেন ভারী হয়। পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করলে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের অন্যতম দিকগুলো হলো তার অসাম্প্রদায়িকতা, কর্মপ্রিয়তা ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য রাজনীতি করা। বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে চিন্তা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। কোনো অঙ্ক দিয়ে বা তথ্য দিয়ে তা মিলানো যাবে না। এটা অসম্ভব। কিন্তু অসম্ভব এই বিষয় নিয়ে কিছু দেশি-বিদেশি কুচক্রীমহল ষড়যন্ত্র করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু তা টেকেনি, টিকবে না।

আমি একজন সাধারণ লেখক হিসেবে এটাই বলব, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনীতি না করে বরং তার অবস্থানকে সবাই স্বীকার করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বাংলাদেশ নামটি বঙ্গবন্ধুর দেওয়া নাম। ১৯৭১ সালের পূর্বেই এই নাম বঙ্গবন্ধু নির্বাচন করেন। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অবিনশ্বর থেকে যাবেন ইতিহাসের পাতায়। তা অমোচনীয় ও অম্লান।

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটুকু বলব, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রমরমা বাণিজ্যটা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বন্ধ করা উচিত। কারণ অনেক অমুক্তিযোদ্ধাও সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। এ টাকা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেওয়া হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যেমন ভিয়েতনাম তার মুক্তিযুদ্ধকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়নি। দেশের জন্য যুদ্ধ করার প্রয়োজনে এর চেয়ে বড় ত্যাগ বিসর্জন দেওয়া নাগরিক দায়িত্ব। পুরস্কারের জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। আমিও যুদ্ধকালীন সময়ে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছি। বাড়িঘর হারিয়েছি। এর বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধ সার্টিফিকেট গ্রহণ করিনি। সদ্য প্রয়াত বাম রাজনীতিক অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ২০১৫ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘পুরস্কারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি।’ দেশের জন্য যুদ্ধ করে কিছু পাওয়া বা নেওয়া কোনো দেশপ্রেমিকের কাজ নয়।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রন্থকার

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!