• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
পোল্ট্রি শিল্পে ধস

মুরগিই এখন খামারিদের বিষফোড়া


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ৩, ২০২০, ১০:০২ পিএম
মুরগিই এখন খামারিদের বিষফোড়া

ঢাকা: প্রতিটি ডিমের দাম ৮ টাকা। পোল্ট্রির হ্যাচারিগুলো ওই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে প্রতিটি বিক্রি করছে মাত্র দুই টাকায়। শুধু বাচ্চা উৎপাদনের খরচ হিসেবে নিলে প্রতিটি বাচ্চায় হ্যাচারি মালিকদের লোকসান হচ্ছে প্রায় ৩০ টাকা। দেশের অন্যতম পোল্ট্রি শিল্পঘন এলাকা জয়পুরহাটে এ অবস্থা দেখা গেছে। শুধু সেখানেই নয়, নভেল করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারা দেশেই পোল্ট্রি শিল্পে ব্যাপক ধস নেমেছে। আক্রান্ত হয়েছে পুরো খাতই।

পোল্ট্রি শিল্পের হ্যাচারিগুলোর পাশাপাশি খামার, ফিড মিল, ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে দাম না থাকায় খামারে মুরগি এখন যেন হয়ে উঠেছে খামারির বিষফোড়া। পাইকারের অভাবে বিক্রি না হওয়ায় মুরগির খাবারের জন্য গুনতে হচ্ছে বাড়তি ব্যয়। অন্যদিকে

কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ফিড মিলগুলো। চাহিদা কমে গেছে পোল্ট্রির ওষুধসহ অন্যান্য উপকরণের। 

জয়পুরহাটের হ্যাচারি মালিক লিয়াকত হোসেন বলেন, করোনা আতঙ্কে খামারিরা মুরগি উঠাচ্ছে না। এতে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করা যাচ্ছে না। যাদের বাচ্চা রয়ে গেছে তারা বাচ্চাপ্রতি সর্বোচ্চ দাম পাচ্ছে দুই টাকা। যারা এখরো হ্যাচারি চালু রেখেছেন তাদের প্রতিদিন লাখ টাকা লোকসান হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে একসময় সব হ্যাচারি একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে এলাকার বেশির ভাগ হ্যাচারি উৎপাদন বন্ধ রেখেছে।

জয়পুরহাটের বিসিক শিল্প এলাকা ও পাশের জামালগঞ্জ এলাকায় প্রচুর পোল্ট্রির হ্যাচারি, খামার ও ফিডমিল গড়ে উঠেছে। কিন্তু গতকাল ওই এলাকাগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ খামারে মুরগি নেই। বেশির ভাগ হ্যাচারি ও ফিড মিল বন্ধ রয়েছে। নেই কর্মতৎপরতা। এসব মিলে যারা কাজ করতেন তারাও বেকার বসে দিন কাটাচ্ছে।

অন্যদিকে বাজারে পোল্ট্রির ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রীর দোকানপাটগুলো খোলা থাকলেও নেই ক্রেতা। জামালগঞ্জ বাজারে ওষুধ বিক্রেতা সোহাগ বলেন, আগে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার ওষুধ বিক্রি হলেও এখন তা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায় নেমেছে। এলাকায় বহু খামার বন্ধ হয়ে গেছে।

কয়েকজন ব্যবসায়ী ও খামারি জানিয়েছেন, বাজারে মুরগি ও ডিমের দাম খুব কমে গেছে। পাশাপাশি করোনায় খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় অনেকেই খামারে নতুন করে মুরগি তুলছেন না। ফলে বাচ্চা ও ফিডের চাহিদা নেই। পাশাপাশি ফিড মিলগুলো তাদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না। সব মিলিয়ে সবকিছু অচল হয়ে পড়েছে। 

এমতাবস্থায় করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে এ পর্যন্ত দেশের পোল্ট্রি শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। গত ২০ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত দিনেই এ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তারা।

বিপিআইসিসি তথ্যে, এর মধ্যে হ্যাচারি ও প্রসেসড পণ্যের ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৪৫৮ কোটি টাকা, ফিড ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৭৫ কোটি টাকা, বাণিজ্যিক পোল্ট্রিতে (ডিম, মুরগির মাংস) ৫০৩ কোটি টাকা, প্রসেসড ইন্ডাস্ট্রিতে ৩১ কোটি টাকা এবং প্রাণী ওষুধ খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে অন্তত ৮৩ কোটি টাকা। 

অন্যদিকে এমন অচলাবস্থা দীর্ঘমেয়াদি হলে আরো বড় ক্ষতির শঙ্কা করছেন সংগঠনটির সভাপতি মসিউর রহমান। তিনি বলছেন, চাল-ডালের মতো পণ্যের দর ক্ষেত্র বিশেষে বাড়লেও ব্যাপকহারে কমেছে ব্রয়লার মুরগি, একদিন বয়সি বাচ্চা ও ডিমের দাম। এমন পরিস্থিতি আরো এক সপ্তাহ দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এরপরও যদি অবস্থার উন্নতি না হয় তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও বাজার স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে আরো অন্তত এক মাস।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত দেশের একমাত্র পিআরটিসি ল্যাবটি বন্ধ থাকায় বন্দর থেকে ছাড়ানো যাচ্ছে না পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামাল। এ কারণে ব্যাহত হচ্ছে ফিড উৎপাদন। বর্তমানে পোল্ট্রি ও ফিশ ফিডের উৎপাদন প্রায় ৭০-৭৫ শতাংশ কমে গেছে। এছাড়া পোল্ট্রি প্রসেসড প্রোডাক্টসের বিক্রি ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।

এসব বিষয়ে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) সভাপতি এহতেশাম বি. শাহজাহান বলেন, ফিড মিলগুলো প্রতিদিন বন্ধ থাকলেও প্রচুর লোকসান গুনতে হয়। কর্মচারী ও শ্রমিকদের বসে বসে বেতন দিতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, এ পরিস্থিতিতে পোল্ট্রিকেন্দ্রিক সব খাতে ধস নেমেছে। এখন সরকারই পারে এ খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে। এ জন্য আমারা সরকারের কাছে সহায়তা চাইছি। বিশেষভাবে এ খাতকে নজদারি করা প্রয়োজন।

অন্যদিকে পোল্ট্রি শিল্পসংশ্লিষ্টদের সুদ আগামী ৬ মাসের জন্য মওকুফ, বন্দরে আটকে পড়া কাঁচামালের কারণে যে পোর্ট ডেমারেজ জমা হচ্ছে তা পুরোপুরি মওকুফ, সাধারণ মানুষের জন্য সরকার ঘোষিত খাদ্য সহায়তার অংশ হিসেবে ডিম ও মুরগির মাংস বিতরণ করা এবং পোল্ট্রির সবগুলো খাতের জন্য ৩০ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের জন্য সরকারের সহায়তা চেয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!