• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
নিমতলী ট্র্যাজেডি শুধুই বার্ষিক স্মরণ

মৃত্যুকূপেই যাদের বসবাস


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৯, ০১:৫৭ পিএম
মৃত্যুকূপেই যাদের বসবাস

ঢাকা : পুরান ঢাকার ছোট কাটরার নিমতলী এলাকার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের নয় বছর পূরণ হবে আগামী ৩ জুন। স্মরণকালের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১২৪ জন মানুষ। ঘটনার পর থেকে প্রতিবছর স্থানীয় বাসিন্দারা ‘নিমতলী ট্র্যাজেডিতে’ নিহতদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। নিহতদের স্মরণে সেখানে তৈরি করা হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার।

স্থানীয় বাসিন্দারা ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনও অংশ নেয় সেসব কর্মসূচিতে। দিনটিতে জাতীয় পত্র-পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয় প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়। প্রতিবছর এমনভাবে নিহতের স্মরণ করা হলেও এখনো ‘মরণের’ মধ্যে বসবাস নিমতলী এলাকার বাসিন্দাদের। এমনই মন্তব্য পুরান ঢাকার বাসিন্দা সৈয়দ নিজাম উদ্দিনের। চানখাঁরপুল এলাকায় এক চায়ের দোকানে কথা হয় নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে।

স্থানীয় এ বাসিন্দা জানান, নিমতলী ট্র্যাজেডির মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই আবারো রমরমা হয়ে ওঠে রাসায়নিকের ব্যবসা। প্রথম দিকে প্রশাসনের অগোচরে বিভিন্ন ভবন গোডাউনের জন্য ভাড়া দেওয়া হলেও, কিছু দিনের মধ্যেই তা প্রকাশ্যে রূপ পায়।

এদিকে গত বুধবার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর নিমতলী এলাকার অধিকাংশ রাসায়নিকের দোকান, গুদাম ও ছোট ছোট কারখানা বন্ধ রাখা হয়।

শনিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিকালে চানখাঁরপুল এলাকা হয়ে নিমতলী, ছোট কাটরার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কোনো রাসায়নিকের দোকান খোলা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়, এখনো অধিকাংশ ভবনের নিচতলা, বেসমেন্ট ভাড়া দেওয়া হয়েছে রাসায়নিকের গুদাম হিসেবে। রয়েছে ছোট ছোট দোকানও।

নবাব কাটরা লেনে দেখা যায়, ছোট ছোট দোকানে চলছে পুরনো কাগজ, কার্টন, পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবসা। ৩৬ নবাব কাটরার রকি ইন্টারপ্রাইজ ও আল-আমিন এন্টারপ্রাইজ নামের দুটো দোকানের শাটার অর্ধখোলা অবস্থায় পাওয়া যায়। দুটো প্রতিষ্ঠানই পুরনো কাগজ, কার্টন ও পলিথিনের পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. আল-আমিন বলেন, নবাব কাটরা, নিমতলী লেনের যত দোকান আছে তার অর্ধেকই কাগজ, পলিথিন আর কেমিক্যাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ছোট ছোট দোকানে কেমিক্যাল বিক্রি হলেও তাদের গুদাম আশপাশেই কোনো না কোনো বাড়িতে। আল-আমিন বলেন, আমরা যে কাগজ আর পলিথিনের ব্যবসা করছি আমরাও রিস্কে আছি। কাগজ পলিথিনেও আগুন লাগলে তা সহজে নেভানো যায় না। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। জেনে শুনেই ব্যবসা করছি। কারণ আমাদের এ ধরনের ব্যবসার জন্য সরকার তো আলাদা মার্কেট করে দেয়নি, যে সেখানে করব।

১১৪ আগামসী লেনের বাড়ির নিচ তলার পুরোটাই দোকান ও গোডাউন হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। ভবনটির সামনে বড় করে ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া। উল্লেখ করা হয়েছে গোডাউন, কারখানা ও দোকান ভাড়া হবে। তবে এ ব্যাপারে বাড়ির কেয়ারটেকার আবদুল লতিফের সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি বলেন, টু-লেট অনেক আগের। এখানে কোনো গোডাউন, কারখানা নেই। ভবনের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, এই বাড়ির মালিক একজন না। কয়েকজন মালিক সবাই দেশের বাইরে থাকেন।

নিমতলী এলাকার মতো রাজধানীর পুরান ঢাকার বিশেষ করে, চকবাজার, বংশালের কিছু অংশ, মৌলভীবাজার, ফরাশগঞ্জ এলাকা, মিটফোর্ড রোড, আরমানিটোলা এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন রাসায়নিকের দোকান ও গুদাম। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া এ ব্যবসার ইতিহাস বেশ পুরনো হলেও ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় রাসায়নিকের ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় তা ছাড়তেও নারাজ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরও তার কোনো ছাপ লক্ষ করা যায়নি আশপাশের এলাকাগুলোয়। শনিবার বিকালে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, বংশাল এলাকায় ঘুরে দেখা যায় অন্যান্য দিনের মতোই চলছে রাসায়নিকের দোকানগুলোর বেচাকেনা।

মিটফোর্ড রোডে দেখা যায় ওষুধের দোকানের সঙ্গেই চলছে রাসায়নিক ও বিভিন্ন ফারমিউমারি দ্রব্যের বেচাকেনা। এই রোডের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সরু গলিগুলোয়ও রয়েছে ছোট ছোট খুপরি দোকান যেগুলোয়ও বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। আরমানিটোলা এলাকার প্রায় একই চিত্র।

তবে গণমাধ্যম কর্মী পরিচয় দিতেই কেউই কথা বলতে রাজি হননি। কয়েকজন ব্যবসায়ী ক্ষিপ্তও হয়ে ওঠেন প্রতিবেদকের ওপর।

কথা বলা হলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পাশাপাশি আমরা পরিবেশবাদীরাও আন্দোলন করেছি পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল ব্যবসা সরিয়ে নেওয়ার জন্য। আমাদের আন্দোলন কেমিক্যাল বা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে না। আমাদের আন্দোলন ছিল জনবসতিপূর্ণ এলাকায় শুধু কেমিক্যালই না, কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা থাকতে পারে না। আমরা তখন বলেছিলাম, কেমিক্যাল ব্যবসার জন্য আলাদা জোন করে দেওয়া হোক।

তিনি বলেন, রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় তো বড় বড় কারখানা রয়েছে, যেগুলো কেমিক্যাল-নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান। কখনো কি সেখানে এমন দুর্ঘটনার খবর শোনা যায়? যায় না, কারণ সেখানকার ব্যবস্থাপনাটাই ওইভাবে করা হয়েছে। সেখানেও তো আরো বড় বড় গুদাম রয়েছে। পেট্রোলপাম্পের পাশে যেমন হোটেল রেস্টুরেন্ট থাকতে পারে না, এটা যেমন আমাদের স্বাভাবিক জ্ঞানেই বলে দেয়। ঠিক তেমনি বাসাবাড়ির মধ্যেও কেমিক্যাল থাকতে পারে না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!