• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যে কারণে জরুরি বৈঠকে বসছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা


বিশেষ প্রতিনিধি জুন ৯, ২০১৯, ০৫:২৬ পিএম
যে কারণে জরুরি বৈঠকে বসছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা

ঢাকা : জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে স্বস্তি ফেরাতে চেষ্টা চালালেও সমাধানে যেতে পারেনি জোটটির প্রধান শরিক দল বিএনপি।  

জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব শনিবার (৮ জুন) একটি বিশেষ বৈঠক ডাকলেও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার অসম্মতিতে সেটি বাতিল হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন, আগে বিএনপিকে ঠিক হতে হবে।

জোটের ভেতর সৃষ্ট অস্বস্তি কাটাতে বিএনপির উদ্যোগ কতখানি ফলপ্রসূ হবে, তা নির্ভর করছে দলটির কাছ থেকে কিছু জিজ্ঞাসার ‘উত্তরপ্রাপ্তি’র ওপর।

খোদ বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যও বলছেন, বিএনপির নেতৃত্বকে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। আর দলটির নেতাদের উচিত এসব প্রশ্নের পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়া। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে বর্ধিত সভা ডেকে সবার অভিমত নিয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা যেতে পারে।

এদিকে, সোমবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক আছে। বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে বলেও জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের দায়িত্বশীল একজন নেতা।

শনিবার (৮ জুন) ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের চেম্বারে একটি বিশেষ বৈঠক ডেকেছিলেন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তার সঙ্গে ঈদের আগের রাতে দেখা করে এসেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

শনিবার সকাল ১১টার দিকে জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন ও নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান চেম্বারে গিয়ে জানতে পারেন বৈঠক বাতিল হয়েছে। আবদুল মালেক রতন জানান, ‘মাহমুদুর রহমান মান্নার কন্টাক্ট পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই বৈঠক হয়নি। ‘ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘আমি গিয়েছিলাম ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে। গিয়ে শুনি বৈঠক হবে না।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে এবং দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিকেই সমাধান করতে হবে। এর আগে দল হিসেবে রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করতে হবে। নাগরিক ঐক্যের প্রভাবশালী একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপিকে বাদ দিয়ে আ স ম রব যে বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে কোনও ফল বয়ে আনবে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘আসলে কিছুই অথেনটিক না, দুই জন একমত হলে তো দুই জন ভিন্ন মতে। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক নেতা জানান, অন্তত কয়েকটি প্রশ্নের ব্যাখ্যা আগে বিএনপিকে দিতে হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর না পেলে ঐক্যফ্রন্ট থাকা আর না থাকা একই সমান।

ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির প্রভাবশালী এই নেতার প্রথম প্রশ্ন হলো—নির্বাচনের আগে কেবল ঢাকাতেই অন্তত ৭/৮টি সমাবেশ করার কথা ছিল। কেন বিএনপি উদ্যোগ থেকে বিরত থেকেছে? দলটির শীর্ষ নেতা কোন অদৃশ্য শক্তির নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছেন?

দ্বিতীয়ত হলো—এখনকার স্থায়ী কমিটির সদস্যরা আন্দোলন চান না, তাহলে কি খালেদা জিয়ার প্রতি কমিটমেন্ট নেই?

তৃতীয়ত, বিএনপি বলে আসছে, নেতাকর্মীরা মামলায় পর্যুদস্ত, সংগঠন গুছিয়ে আন্দোলনে যাবে। গুছিয়ে-গাছিয়ে কারা আন্দোলন করে? সব সময় বাধা ছিল, বিএনপি কী বাধাহীন আন্দোলন প্রত্যাশা করে?

চতুর্থত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপ হলো, সংলাপে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো যে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হবে না, কিন্তু নির্বাচনের দিনেও নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হয়েছে। প্রতিবাদ কেন করা হলো না?

পাঁচ নম্বর প্রশ্ন—সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান শপথ নেওয়ার পর বিএনপির মহাসচিব তাদের বেইমান, বিশ্বাসঘাতক বলেছিলেন। এরপর জানালেন তার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কেন? এর ফলে আন্দোলনের স্পিরিট নষ্ট হয়েছে। এই সংসদকে কেন্দ্র করে বিএনপির আন্দোলনের কোনও চিন্তা নেই, এটাই প্রতীয়মান হয় না?

ছয় নম্বর প্রশ্ন—আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারেক রহমানের নেতৃত্ব, জামায়াতের সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক থাকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে দেশের নাগরিক সমাজের মধ্যেও। প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠীও এই দুটো বিষয় সহজে গ্রহণ করছে না, সেক্ষেত্রে সমাধান কী?

সাত নম্বর জিজ্ঞাসা—একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জয়ী হলে ড. কামাল হোসেনকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু ওই প্রস্তাব গোপনে দেওয়া হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে গোপনে প্রস্তাব কেন?

আট নম্বর প্রশ্ন—নির্বাচনের আগে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করেনি। যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত পরিষ্কারভাবে কামাল হোসেনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী হলে জোট থেকে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? এ নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কোনও সিদ্ধান্ত দেয়নি? না দিলে কেন?

নয় নম্বর প্রশ্ন—নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করার পর ৫ মাস পার হয়ে গেলো। নির্বাচনি ফল প্রত্যাখ্যানের পর এতদিন পার হওয়ার পরও বিএনপির কোনও কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়নি কেন?

উল্লেখ্য,  বিএনপির কর্মসূচিতে না যাওয়ার বিষয়ে চার কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই বিএনপির একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা

ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির প্রভাবশালী এক নেতা এই প্রসঙ্গে বলেন, বিএনপিকে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। না দিলে পরের কাজ কীভাবে শুরু হবে? আ স ম আবদুর রব এ উত্তরগুলো না জেনেই উদ্যোগ নিয়েছেন, যার কোনও ফল আসবে না।

এই নেতা এও বলেন, ‘নির্বাচনের আগে প্রভাশালী একাধিক গোষ্ঠী ও পক্ষ বিএনপির নেতাদের পিছে-পিছে হেঁটেছে, জানতে চেয়েছে, কিন্তু কোনও উত্তর আসেনি শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। ভারতে সোনিয়া গান্ধী দলের মধ্য থেকে মনমোহন সিংকে দুই দফা প্রধানমন্ত্রী করতে পারলে খালেদা জিয়ার জীবদ্দশায় তারেক রহমান দলের নতুন কান্ডারি নির্ধারণ করতে কেন সমস্যাবোধ করছেন? তিনি তো নিজেই নানা ধরনের বাধার মধ্যে আছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী একনেতা, যিনি একজন খ্যাতিমান আইনজীবীও, তিনিও তাই মনে করেন। শনিবার সন্ধ্যায় খ্যাতিমান এই আইনজীবী-রাজনীতিবিদ বলেন, ‘বিএনপি কেন সংসদে গেলো, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রয়োজনে বর্ধিত সভা করতে হবে।

এছাড়া কামাল হোসেনকে বিএনপি নেতা মেনেছিল, এই ভেবেই যে, তিনি নির্বাচন করবেন এবং মাঠে থাকবেন। কিন্তু তিনি থাকলেন না। নির্বাচনও করলেন না। এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হবে।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই বিবাদ দূর করতে কাজ করছেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সমস্যা তো কিছু আছে। এগুলো এক বৈঠকেই ঠিক হয়ে যাবে আশা করি। আগামী সোমবার ফ্রন্টের বৈঠক আছে, সেখানে আলোচনা হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীলরা বলছেন, বৈঠক হলেই ঐক্যফ্রন্টের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবারের বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। প্রশ্ন উঠলে তিনি উত্তর দেবেন—এই প্রস্তুতি তার রয়েছে। এক্ষেত্রে বিএনপির হাইকমান্ডেরও সম্মতি আছে।

দলটির স্থায়ী কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জানান, ‘দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবশ্যই ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য অটুট রাখার পক্ষে। তিনি নির্বাচনের আগে যেমন ঐক্যের পক্ষে সম্মতি দিয়েছিলেন, সে পথ থেকে তিনি সরে যাননি। জোটটির স্টিয়ারিং কমিটির প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, ‘বিএনপির যে নিষ্ক্রিয়তা, তার পথ দেখিয়েছেন ড. কামাল হোসেন।

ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আগামী সোমবার আমাদের মিটিং আছে। সবকিছু মিটমাট হয়ে যাবে আশা করি। তবে নির্বাচনের সময় কামাল হোসেন নামেননি, এমন অভিযোগ কেউ করে থাকলে তা ঠিক নয়। বরং বিএনপি মাঠে নামেনি। তারা ঘরে বসে ছিল। পুরনো কাসুন্দি আর ঘাঁটতে চাই না, এখন তাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য।’

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিএনপির সমস্যার পেছনে যতখানি তারেক রহমানের দায়, তার চেয়ে বেশি স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। তারা তো তাকে কিছু বলছেন না। তারা বলুক। তারেক রহমান তাদের না চাইলে তারা পদত্যাগ করুক। দলের বর্ধিত সভা ডাকা উচিত। নেতাকর্মীরা গালি দিলেও শুনতে হবে। সমস্যা কী? গালি শুনলেই নেতৃত্ব পোক্ত হবে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তকে দলের রাজনীতির জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি তো মনে করি মির্জা ফখরুল খুব ভালো করেছেন, দলের রাজনীতি ঠিক রেখেছেন। তিনি তো বিএনপিকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। নেতা হিসেবে তিনি ঠিক কাজটিই করেছেন।

ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ঐক্যফ্রন্ট কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, বিষয়টি ঐক্যফ্রন্টের বড় দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে বিএনপির ওপর। পাঁচ মাস নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকলাম, সে নিষ্ক্রিয়তা ভাঙতে পারে বিএনপি। তারা কোনও কারণেই হোক উদ্যোগ নিচ্ছে না। আশা করি, বিএনপি দ্রুত এগিয়ে আসবে।

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী আশা প্রকাশ করছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট চাঙ্গা হবেই। তিনি বলেন, ‘একটি বৃহৎ ঐক্যের জন্য অপেক্ষা করছি। আশা করি, সেই ঐক্য আপনারা শিগগিরই দেখতে পাবেন।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দুজনেই কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!