• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যে দলে ঘণ্টায় ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ২৪, ২০১৯, ০৩:২৭ পিএম
যে দলে ঘণ্টায় ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে

ঢাকা : রাজনৈতিক অঙ্গনে এরশাদের নাটুকেপনা দীর্ঘদিনের। তার নাটকীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত দেশবাসী। তার দল জাতীয় পার্টিও (জাপা) এই বৈশিষ্ট্যের বাইরে নয়। এই সময়ে টক অব দ্য কান্ট্রি জাপা। টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে বর্তমান সংসদের এই প্রধান বিরোধী দলে। দলটিতে ঘণ্টার ব্যবধানে নেতার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটছে। গুঞ্জন উঠেছে, জীবন সায়াহ্নে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ দলটির হাল ধরতে পারছেন না।

ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ আক্রমণের শিকার তার পার্টি। গত দুই দিন ধরে হঠাৎ চিঠি চালাচালি, প্রেস রিলিজ বিলি, বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলের স্ক্রল ও বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে নিয়োগ ও বহিষ্কারের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর শুধু জাপা নেতাকর্মীরাই নন, সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রশ্ন- এরশাদের জাপায় হচ্ছেটা কী। কার নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে জাপা। এ মুহূর্তে রাজনীতির হাওয়ায় দোল খাচ্ছে পার্টির নতুন মুখ ও সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার নাম।

এদিকে গতকাল শনিবার বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় গিয়েও এরশাদের সাক্ষাৎ পাননি সহোদর জিএম (গোলাম মোহাম্মদ) কাদের ও তার দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। শোরগোল উঠেছে, সময়ের আবর্তে ফের মহাসচিব পদে ফিরছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। গত শুক্রবার থেকে জাপায় চলছে নানামুখী নাটক।

পার্টির কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে সহোদর জিএম কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়ার মাত্র ১৮ ঘণ্টার মাথায় সংসদে বিরোধী দলের উপনেতার পদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

শনিবার (২৩ মার্চ) বিকালে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জিএম কাদেরের এ অব্যাহতির কথা জানান এরশাদ। গত শুক্রবার মধ্যরাতে আরেক সাংগঠনিক নির্দেশনায় জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকেও সরিয়ে দেন তিনি। নতুন সাংগঠনিক নির্দেশনা দিয়ে এই সময় স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে মনোনীত করেন। এর মধ্য দিয়ে জাপায় সেই পুরনো গৃহদাহ নতুন করে জ্বলে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দলটির সিনিয়র নেতারা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মহাসচিবের পদ থেকে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দিলে এরশাদের জাপায় শুরু হয় অস্থিরতা। এই অস্থিরতা নতুন মাত্রা পায় গত শুক্রবার মধ্যরাতের একটি প্রেস রিলিজকে কেন্দ্র করে। ওই রাতে জাতীয় পার্টির বনানীর অফিস থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘সাংগঠনিক নির্দেশ’ নামে যে প্রেস রিলিজ পাঠানো হয়, সেখানে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পার্টির কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে জিএম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়েছেন বলে জানানো হয়।

সাংগঠনিক নির্দেশে এরশাদের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো জানানো হয়, ইতঃপূর্বে এরশাদ তার ছোট ভাই জিএম কাদেরকে পার্টির ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন। এরশাদের অবর্তমানে পার্টির সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু জিএম কাদের তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে প্রেস রিলিজে উল্লেখ করেন জাপা চেয়ারম্যান। এজন্য কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে জানান এরশাদ।

কয়েক ঘণ্টা পরপর এমন খবরে জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত জাতীয় পার্টির অনেকেই প্রথমে এই প্রেস রিলিজকে ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিতে থাকেন। অনেকেই আবার এই প্রেস রিলিজকে সত্য উল্লেখ করে এর জন্য দলের অনেক নেতাকে দায়ী করেছেন।

এদিকে কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া প্রসঙ্গে জিএম কাদের শুক্রবার রাতে বলেন, আমার কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কারণ গত বৃহস্পতিবার রাতে এরশাদ সাহেব আমাকে বলেছিলন, ‘তুমি খুব ভালো করছো। আমি তো আর বেশি দিন বাঁচব না, তুমি দলটাকে বাঁচিয়ে রেখো। আমি জানি, তুমি তা পারবে।’ তবে শনিবার বিকালে উপনেতার পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়ে জানার জন্য জিএম কাদেরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, শুক্রবারের প্রেস রিলিজে এরশাদ স্বাক্ষর করেছেন। তবে কোন পরিস্থিতিতে তিনি এটা করেছেন তা নিশ্চিত করতে পারেননি কেউ। গত শনিবার সকালে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে অবস্থান করেও ভাই এরশাদের সাক্ষাৎ পাননি জিএম কাদের। এ সময় জিএম কাদেরের সঙ্গে মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে এরশাদের সাক্ষাৎ না পেয়ে অনেকটা নিরাশ হয়ে ফিরে যান।

অপরদিকে দেশের প্রধান বিরোধী দলের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক ও মিডিয়াপাড়ায় আবারো আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা বিষয়টিকে এরশাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে মন্তব্য করেছেন। আবার অনেকেই বলেছেন, এ বিষয়ে মন্তব্য করাও সময় নষ্টের শামিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা একপ্রকার লেজেগোবরে হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলের কয়েকজন শীর্ষনেতার বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠাকে কেন্দ্র করে জাপায় ছিল অস্থিরতা।
নির্বাচনের আগ মুহূর্তে দলের দীর্ঘদিনের কাণ্ডারি হিসেবে পরিচিত মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দিয়ে হুট করে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে মহাসচিব মনোনীত করা, জোটগতভাবে নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আশানুরূপ আসন না পাওয়া, সংসদে নিজ দলের আসনসংখ্য ৪৬ থেকে ২৪-এ নেমে আসা, দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ দশম জাতীয় সংসদে এমপি হওয়া অনেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের মনোনয়ন না পাওয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের খোঁজখবর না নেওয়াসহ নানা কারণে নির্বাচনের পর থেকে দলের সাংগঠনিক অবস্থা একেবারে নড়বড়ে হয়ে পড়ে।

এর মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি দলের কো-চেয়ারম্যান আপন ছোট ভাই জিএম কাদেরকে দলের ভবিষ্যৎ চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করে সাংগঠনিক নির্দেশ দেন জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার এই সিদ্ধান্তে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সমর্থন থাকলেও বেঁকে বসেন দলের বেশিরভাগ সিনিয়র নেতা। তারা এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গার পাশাপাশি প্রকাশ্যে জিএম কাদেরের বিরোধিতা শুরু করেন। কিন্তু পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীরা ক্লিন ইমেজ ও এরশাদের ভাই হওয়ার কারণে জিএম কাদেরের পক্ষে অবস্থান নেন।

তবে গত দুই মাসের বেশি সময় দায়িত্বে থাকলেও মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার পাশাপাশি জিএম কাদেরও দলের সাংগঠনিক ভিত মজবুত করতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে দলের নেতাদের। পার্টির বনানী ও কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও নেতাকর্মীদের ভেড়াতে পারেননি তিনি। দুই কার্যালয়ই কর্মীশূন্য ছিল বিগত আড়াই মাস। এই সময়ের মধ্যে তিনি দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি সভাও করতে পারেননি। এছাড়া দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের সমন্বয় না করার মতো অভিযোগ রয়েছে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে।

অপরদিকে বিভিন্ন মিডিয়ায় বক্তব্য দেওয়ার সময় দলের চেয়ারম্যানের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েও সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি, এমন অভিযোগ রয়েছে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ কাজে লাগান দলের মধ্যে জিএম কাদেরবিরোধী অবস্থান নেওয়া সিনিয়র নেতারা।

পার্টিতে জিএম কাদের সমর্থকদের অভিযোগ, ওই সিনিয়র নেতারা এরশাদকে ভুল বুঝিয়ে জিএম কাদেরকে পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সংসদের উপনেতার পদ থেকে অব্যাহতি দিতে এরশাদকে বাধ্য করেছেন। তবে জাপার বর্তমান মহাসচিবকে বাদ দিয়ে আগের মহাসচিবকে স্বপদে ফিরিয়ে আনার যে দাবি তৃণমূলের ছিল তা না করে জিএম কাদের কো-চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তবে অপর সূত্রের দাবি, স্বপদে (মহাসচিব) ফিরছেন রুহুল আমিন হাওলাদার।

এ প্রসঙ্গে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, কে কোন পদে থাকবে সেটা এরশাদ সাহেব ভালো বলতে পারবেন। কেন তাকে (জিএম কাদের) সরিয়ে দেওয়া হলো সেটা এরশাদ সাহেবই ভালো জানেন।

তবে তিনি জিএম কাদেরের সমালোচনা করে বলেন, উনি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। পার্টির কোনো নেতার সঙ্গে দেখা করবেন না, কথা বলবেন না, তাহলে রাজনীতি কীভাবে হয়। নির্বাচনের আগে বা পরে একবারও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসেননি তিনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!