• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে অগ্নিঝুঁকি দিন দিন তীব্র হচ্ছে


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ১০, ২০১৯, ০১:২৩ পিএম
রাজধানীতে অগ্নিঝুঁকি দিন দিন তীব্র হচ্ছে

ফাইল ছবি

ঢাকা : অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে পুরো ঢাকা মহানগরী। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে রাজধানী শহরের দু-একটি ভবন বাদে প্রায় সব ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে ঝরে যাচ্ছে মূল্যবান প্রাণ, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিপুল অর্থের সম্পদ।

এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা কমপ্লায়েন্স কমিশন গঠনের কথা বলছেন। তাদের মতে, যেসব কারণে রাজধানী বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ তার অন্যতম। নগরায়ণ পরিকল্পনা অনুযায়ী না হওয়ায় দুর্যোগ মোকাবেলায় যেসব অনুষঙ্গ প্রয়োজন, বিদ্যমান ভবনগুলোতে সেগুলো নেই। আর কোনো ট্র্যাজেডির পর কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না। এমনকি গড়ে ওঠা অবকাঠামোগুলোর পর্যবেক্ষণেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা লক্ষণীয়। ফলে সার্বিকভাবে রাজধানীতে অগ্নিঝুঁকির মাত্রা বেড়েই চলছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, রাজউক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাজধানীর অধিকাংশ বহুতল ভবনই অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে যেসব অগ্নিনিরাপত্তা সামগ্রী থাকা প্রয়োজন, নির্মাণ কাঠামো যেমন হওয়া প্রয়োজন তার অভাব রয়েছে। বরং অনেক ক্ষেত্রেই অনুমোদন ছাড়া এবং ঝুঁকি বিবেচনা না করেই ভবনের তলার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। অথচ প্রতিটি নগরেরই বৈশ্বিক মানদø থাকে। ঢাকা শহরে ওই মানদণ্ডের কিছুই নেই। যে সংস্থার যে দায়িত্ব, তারা তা ঠিকমতো পালন করছে না। এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে জবাবদিহির মধ্যেও আনা হয় না। কিন্তু অগ্নিদুর্ঘটনা কী কারণে ঘটছে, কার গাফিলতিতে ঘটছে, তা উদ্ঘাটন করা গেলে এবং দায়ি ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হলে ওসব দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও কমতো। কিন্ত জবাবদিহির বড় অভাব। ফলে এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে অবশ্যই শক্ত হতে হবে।

সূত্র জানায়, রাজধানীতে রাজউক আওতাধীন এলাকায় ২৫ লাখ স্থাপনা রয়েছে। তার মধ্যে ৬তলা পর্যন্ত স্থাপনা আছে ২১ লাখ ৫০ হাজার। ৭তলা থেকে ২৪-২৫ তলা ভবন আছে ৮৮ হাজার। সেগুলোর মধ্যে ১০ তলা এবং ১০ তলার বেশি উচ্চতাসম্পন্ন বহুতল ইমারত রয়েছে প্রায় ৪ হাজার। সেগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে অগ্নিঝুঁকিতে ৩ হাজার ৭৭২টি ভবন। ২০১৭ সালে ফায়ার সার্ভিস রাজধানীর শপিংমল, মার্কেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল ও মিডিয়া সেন্টারসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর ওপর পরিচালিত জরিপে ওই চিত্র উঠে আসে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, ওসব প্রতিষ্ঠানের অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত ফায়ারসেফটি প্ল্যান নেই। ওই সময় ৩ হাজার ৮৫৫টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়। তখন সরকারি-বেসরকারি ৪৩৩টি হাসপাতালের মধ্যে ১৭৩টিকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৪৯টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ৩২৫টি আবাসিক হোটেলের ৭০টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২৪৮টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২৬টি মিডিয়া ভবনের মধ্যে মাত্র দুটির অগ্নিনিরাপত্তা প্রস্তুতি সন্তোষজনক বলে জানা যায়।

অথচ অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো দুর্যোগ ঝুঁকি এড়াতে একটি অবকাঠামো কীভাবে গড়ে উঠবে, সে ব্যাপারে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালাটিও আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। তারপরও বিদ্যমান নিয়মগুলো অনুসরণ করে ভবন তৈরি করা হলে এবং সে অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী থাকলে নগরবাসী অগ্নিঝুঁকি থেকে অনেকটাই নিরাপদ থাকতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে ভবনের বাসিন্দাদের সচেতনতা এবং ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণের প্রশিক্ষণও থাকতে হবে। কিন্তু এর সবকিছুরই অভাব রয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, গত ১০ বছরে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রায় ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোতে এক হাজার ৫৯০ জন প্রাণ হারিয়েছেন।  অথচ রাজধানী ঢাকায় অপরিকল্পিতভাবে ভবন গড়ে তোলা হচ্ছে। ভবনগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। আকাশচুম্বী ভবনগুলো একটি আরেকটার গা ঘেঁষে আছে। তাই দিন দিন আগুনের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে ঢাকা। অথচ রাজউকের দায়িত্ব রাজধানীতে ভবন নির্মাণের সময় নকশা অনুযায়ী বিদ্যুতায়ন ও এয়ারকন্ডিশন ব্যবস্থা, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম, বহির্গমনের পথ ও স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে কি-না তা নিশ্চিত করা। বর্তমানে ঢাকা শহরে একটি অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে।
শহরটির মাটির নিচেও আগুন, ওপরেও আগুন। মাটির নিচে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের লাইন; ওপরেও বিদ্যুতের লাইন, বিভিন্ন তারের লাইন। ওসব লাইনে যদি কোনো সময় আগুন লেগে গ্যাসপাইপের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়, তাহলে পুরো ঢাকা শহর অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে। তখন কোন ভবন বাদ দিয়ে কোনটার আগুন নেভাবে ফায়ার সার্ভিস? আসলে ঢাকা শহরের যে অবস্থা, তাতে প্রতিদিনই আগুন লাগার কথা।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অবস্থায় রাজধানীর ভবনগুলোয় সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি কমপ্লায়েন্স কমিশন গঠনের সময় এসেছে। যেভাবে রানা প্লাজায় দুঘটনার পর গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা হয়েছে, ঠিক একইভাবে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনেও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। কারণ পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকা সব জায়গাতেই অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে।

রাজধানীর ভবনগুলোতে কোনো অ্যাভোকেশন প্ল্যান এবং অ্যাভোকেশন রুট নেই। তাই কোনো দুর্যোগ এলে ভবনের বসবাসকারীরা বুঝতে পারেন না কী ঘটতে যাচ্ছে, কোন পথে বেরোতে হবে। ভবনগুলোতে ফায়ার অ্যালার্ম নেই। নেই ফায়ার স্টিংগুইশার। যেগুলো থাকে সেগুলোরও মেয়াদ থাকে না। থাকলেও বাসিন্দারা ব্যবহার জানেন না।

 ভবনগুলোতে ফায়ার প্রুফ দরজা থাকার কথা- যা তাপ ও দাহ্যতা থেকে মানুষকে নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু বাস্তবে তা নেই। এসব কারণে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। অবশ্যই ভবনগুলোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট ও স্ট্রিংলার সিস্টেম থাকতে হবে। কোনো তলার তাপমাত্রা ৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ক্রস করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেটর চালু হবে। সঙ্গে সঙ্গে জকিপাম্প চালু হবে। স্বয়ক্রিয়ভাবে স্ট্রিংলার সিস্টেমের মাধ্যমে পানি ঝরে পড়তে শুরু করবে। ধোঁয়া শনাক্তকারী যন্ত্র থাকতে হবে। একটি মাত্রার পর গেলে সেটাও সিগন্যাল দিতে থাকবে। কিন্তু রাজধানীর ভবনগুলোতে এসবের কিছুই দেখা যায় না।

অন্যদিকে এসব প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জানান, এখন রাউজকের ২৪টা দল প্রতিদিন মাঠ পর্যায়ে গিয়ে ভবনের সব ধরনের অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ করছে। ওসব রিপোর্ট পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেয়া শুরু হবে। অনিয়ম করে কোনো ভবন কেউ টিকিয়ে রাখতে পারবে না।

এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেয়া হয়েছিল তারা বিষয়টি আমলে নেয়নি। সর্বশেষ বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক মাঠে নেমেছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!