• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতিতে নতুন ঘটনাপ্রবাহের সূচনা


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২৮, ২০১৬, ১১:৩২ এএম
রাজনীতিতে নতুন ঘটনাপ্রবাহের সূচনা

গত মঙ্গলবার দলের সংসদীয় দলের সভায় সংসদ সদস্যদের জাতীয় নির্বাচনে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই নির্দেশ দিলেও এতে নড়েচড়ে বসেছে আগাম নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি। কারণ হঠাৎ সরকারপ্রধানের এই নির্দেশনাকে কোনো সাধারণ বক্তব্য হিসেবে দেখছেন না তারা। তারা ওই বক্তব্যকে রাজনীতিতে নতুন ঘটনাপ্রবাহের সূচনা হিসেবেই দেখতে চাইছেন। তারা মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য আসলে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের দাবি মেনে নেয়ার একটি লক্ষণ।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় দেশের প্রধান দুটি দলের একটি বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই জাতীয় সংসদে। আর ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় প্রটোকলবঞ্চিত দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের পর থেকেই বর্তমান সরকারকে অবৈধ বলে আসছে বিএনপি। তাদের দাবি, ওই নির্বাচনে দেশের বেশির ভাগ মানুষ অংশ নেয়নি। আর এই ‘অগ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা কোনো রাজনৈতিক দলের পূর্ণাঙ্গ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।

বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তির দিন ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের রাজপথ-রেলপথ অবরোধ ডাকে বিএনপি। তবে আন্দোলন জমাতে না পারায় ব্যর্থ হয় সে কর্মসূচি। আর দশম জাতীয় নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থতার পর আন্দোলনে সাফল্য না পেয়ে হতাশ বিএনপির ভেঙে পড়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম। ওই আন্দোলনে ব্যর্থতার পর গত দুই বছরে জাতীয় পর্যায়ে ঘোষিত কোনো কর্মসূচিই পরিকল্পনা অনুযায়ী সফল করতে পারেনি দলটি।

এই অবস্থায় বিএনপির আগাম নির্বাচনের দাবিতে পাত্তাই দিচ্ছে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তারা বলছে, সরকার পুরো মেয়াদই পার করবে। আর নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত।

এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সূচনা হিসেবেই দেখতে চাইছে বিএনপি।

বিএনপির সহসভাপতি সেলিমা রহমান জানান, ‘সরকার হয়তো আবার একটি নির্বাচন করে দশম সংসদ নির্বাচনের ক্ষতের ওপর প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। এজন্যই হয়তো তারেক রহমানকে সাজা দেয়া হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগপত্র গঠন হচ্ছে। হয়তো সবাইকে কারাগারে নিয়ে নিজেদের সুবিধামতো নির্বাচন দেয়ার চিন্তা করছে।’

সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থতার পর বিএনপির প্রকাশ্যে তৎপরতা তেমন না থাকলেও দলের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দেশ-বিদেশে তৎপরতা থেমে নেই। বিএনপির আশা, দেশ-বিদেশের চাপে শেষ পর্যন্ত সরকার নতি স্বীকার করবে এবং আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।

প্রধানমন্ত্রী দলের সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এও বলেছেন, সরকারের মেয়াদ আছে আড়াই বছরেরও কম। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তার মানে নির্বাচন হবে সরকারের মেয়াদ শেষেই। তবে বিএনপির নেতারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সরকারের কঠোর অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসার লক্ষণ হিসেবে দেখতে চান।

একজন নেতা বলেন, কোনো অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইলে হুট করে সরা যায় না। বর্তমান সরকারও জনগণের দাবি মেনে নিয়ে সবার অংশগ্রহণে জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। জনগণের এই দাবির কথা প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন। এ জন্যই হয়তো তিনি নির্বাচন নিয়ে এই কথা বলছেন।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বিলম্বে হলেও সরকার প্রধান নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। আর সত্যিকার অর্থে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের চিন্তা থেকে এমনটা বললে এখনই তিনি সবার সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেবেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি সহযোগিতা করবে।’

সেলিমা রহমানও বলেন, ‘সরকার প্রধানের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে তারা কোনো একটা চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছে। তবে সময় হলে হয়তো সবকিছু পরিষ্কার হবে।’

তবে বিএনপি নেতাদের কোনো ধরনের স্বপ্ন না দেখার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন। তিনি বলেন, “হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি তো তার বক্তব্যে কোনো ফাঁক রাখেননি। তিনি দুই বছর তিন মাস পর নির্বাচনের বিষয়টি তো স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন। এখানে বিএনপির খুশি হওয়ার কী আছে? কেউ যদি একে আগাম নির্বাচনের আভাস হিসেবে দেখে কলাপাতায় ঘি খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাহলে তারা দেখতে থাকুক। এটা তাদের বিষয়। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো ভাবনা নেই।’

বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও ওঠে আসে আগাম নির্বাচনের প্রসঙ্গটি। বুধবার বিকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে অনেকটা হঠাৎ করেই বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। দলের সূত্র বলছে, ওই বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা কূটনীতিকদের জানিয়েছি সরকার বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ নেতাদের মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু দশম সংসদ নির্বাচনের মতো আবার সাজানো নির্বাচন করতে চাইলে দেশের পরিস্থিতি আবারো নাজুক হয়ে পড়বে।’

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর বিরোধের প্রধান কারণ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবে- এই প্রশ্নটি রয়েই গেল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর বিএনপির দাবি ছিল, নির্দলীয় কাউকে এই দায়িত্ব দেয়া হোক। কিন্তু অনির্বাচিত কাউকে দায়িত্ব নিতে নারাজ আওয়ামী লীগ।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আগামী নির্বাচনের আগে এই বিষয়টি নিয়ে আবারও রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থিতিশীল হতে পারে- মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক আর নেতারা।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন জানান, ‘সরকার গত নির্বাচনের মতো কিছু একটা করার চিন্তা করলে তা আমাদের কাছে এবারও গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি যে নামেই হোক নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা ভাবেন, তাহলে তার কথাকে আমরা স্বাগত জানাই।’

আওয়ামী লীগের নেতারা এটা বারবারই জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনও হবে শেখ হাসিনার অধীনে এবং এতে অংশ নিতে হলে বিএনপিকে সেটা মেনে নিতেই হবে।

তবে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনও বলা হচ্ছে ‘নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে মেনে নেয়ার প্রশ্নই উঠে না’। অবশ্য বিএনপিপন্থি একাধিক বুদ্ধিজীবী সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা পেলে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে বিএনপির শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে আপত্তি থাকবে না।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, সরকারের কাছ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ বেশ কিছু দাবি-দাওয়ার পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে শেখ হাসিনার অধীনে হলেও আগামী নির্বাচনে যেতে তাদের আপত্তি থাকবে না।

বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ একাধিকবার বলেছেন, শর্তসাপেক্ষ বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যেতে রাজি হবে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে এসেই তিনি এমন কথা বলেছেন এবং গণমাধ্যমে এই বক্তব্য আসার পর বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো বিরোধিতা করা হয়নি।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির প্রধান দাবি ছিল নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার। কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলনে দুই দফা ব্যর্থতা আর এতে দলের নেতা-কর্মীদের প্রাণহানি এবং সরকারের কঠোর মনোভাবের পর এই বিষয়টিতে না চাইলেও ছাড় দিতে রাজি বিএনপি। তবে নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য এবং স্বচ্ছ ব্যক্তিদের নিয়োগের দাবিটি জোরালভাবে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।

বিএনপি নেতারা বলছেন, বর্তমান ধাঁচের নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে না। এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। শিগগিরই আগামী কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

বিএনপির এক নেতা জানিয়েছেন, এখন তাদের অন্যতম শর্ত থাকবে নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানো। এখানে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের বিষয়ে কোনোরকম ছাড় দেয়া হবে না। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণের স্বতস্ফূর্ত সাড়া পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী বিএনপি।

এই বিষয়টি ছাড়াও নির্বাচন পরিচালনায় জড়িত আইন-শৃঙ্খলাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের বিষয়টিতেও জোর দেবে বিএনপি।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। বিশ্বাস করতে চাই তিনিও সত্যিকারার্থে নির্বাচনের প্রয়োজনীতা অনুভব করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি একটি ভালো নির্বাচনের জন্য উদ্যোগ নেবেন। আর ওই নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেবেন।’

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!