• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতির খরায় ছোট দল


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ২৪, ২০১৯, ০১:৫৭ পিএম
রাজনীতির খরায় ছোট দল

ঢাকা : কিছুদিন আগেও চিত্র ভিন্ন ছিল। এখন অস্তিত্বে টান পড়েছে।  কদর হারাচ্ছে ছোট দলগুলো। ফিরতে হচ্ছে রাজনীতির আপন কক্ষে। নির্বাচনী বাজারে তাদের ছিল চড়া দাম। ক্রেতা ছিল জোট-মহাজোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। বাজারমূল্য বুঝে কোনো কোনো দলের মালিক রাজনৈতিক খোলসও পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু লাভ হচ্ছে না।   

নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার পর এখন শরিকদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে মহাজোটের প্রধান দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ২০-দলীয় জোটের প্রধান বিএনপি ক্ষমতার সীমানায় পা রাখতে না পেরে মিত্রদের খবরও রাখছে না। এ অভিযোগ দুই জোটের শরিক দলের।

এদিকে কাছাকাছি আদর্শের দুই জোটের বাইরে থাকা বাম দলগুলোর বিস্তৃতি কম।

তারাও হালে পানি পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে খরায় ভুগছে দেশের ছোট দলগুলো। এসব দলের শীর্ষ নেতাদের ভাষায়, ‘বাজার খারাপ, দাম কমেছে, ভাটার টানে পড়েছে তাদের রাজনীতি। দলের ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য, জোটবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে সুখ থাকলেও বাকি ইতিহাস সুখকর নয়।

এদেশের রাজনীতিতে দৃশ্যত ছোট ছোট দলের কদর বাড়ে আশির দশকের আগেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল হিসাবে নিবন্ধন পেতে আবেদন করে বেশ কিছু দল। দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত ১২০টির বেশি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব খুঁজে পায় ইসি। মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্টের বাইরে বাম-গণতান্ত্রিক জোট নামের নতুন জোটেরও দেখা মিলে। তারা নির্বাচনের মাঠেও ছিল।

সূত্র মতে, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে ‘চারদলীয় জোট’ গঠন করেছিল বিএনপি। পরে জাতীয় পার্টি নিয়ে এরশাদ সরে গেলে শূন্যস্থান পূরণ করে নাজিউর রহমান মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)।

০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১২টি মিত্রদলকে যুক্ত করে ১৮-দলীয় জোট করে বিএনপি। পরে চার শরিক নিয়ে খণ্ডিত হলেও কালের আবর্তে ১৮ দলে রূপ নেয় ২০-দলীয় জোটে। গত নির্বাচনে শরিক বাড়াতে ২০-দলীয় জোটের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামের নতুন প্লাটফর্ম গঠন করে বিএনপি, যার নেতৃত্ব দেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। ঐক্য মজবুত করার আশায় নতুন-পুরনো এমনকি ভিন্ন আদর্শের কারো কারো হাতে বিএনপি তুলে দেয় নিজ দলীয় প্রতীক ধানের শীষও।

আন্দোলন, নির্বাচন এবং সরকার গঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত এই জোটের শরিকদের দাবি-দাওয়া মেটাতে নিজের স্বার্থ উৎসর্গ করেছিল বিএনপি। দলের বাঘা বাঘা নেতাদের রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে সেখানে শরিকদের পুনর্বাসিত করা হয়।

এদিকে ২০০১ সালে ৪-দলীয় জোটের বিপরীতে গঠিত হওয়া ৮ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ যোগ দিয়ে ১১-দলীয় জোট গঠন করে। ওই জোট গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন বর্তমান ঐক্যফ্রন্টের নেতা গণফোরামের ড. কামাল হোসেন। ১১ দল পরে ১৪ দল হয়ে মহাজোটে রূপ লাভ করে।

৪-দলীয় জোট সরকারের শেষের দিকে বিএনপি এরশাদকে জোটে ভেড়ানোর জন্য চেষ্টা করলেও অজ্ঞাত স্থান থেকে এরশাদ পল্টনের মহাজোটের মঞ্চে উপস্থিত হয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ওই মঞ্চে বিকল্প ধারার বি. চৌধুরী, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদও যোগ দেন। কিন্তু নির্বাচন করেন পৃথকভাবে। এবারের নির্বাচনেও ছিলেন বি. চৌধুরী। তার দলের প্রেসিডিয়াম মেম্বার মাহি বি. চৌধুরী সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। আগেরবার শরিক দলের মালিকদের মন্ত্রিত্ব দিলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। তারা শরিক দলকে বিরোধী দলের আসনে দেখতে চায়। কিন্তু তাতে নাখোশ জোট শরিকরা। এ নিয়ে চলছে টানাপড়েন।

সংসদ নির্বাচনে ১৪ দল জোটগতভাবে অংশ নিলেও গত ১৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের উদযাপিত বিজয় সমাবেশে তাদের উল্লেখযোগ্য আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ছিল না। দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, তবে মঞ্চে নয়, অংশগ্রহণ থাকতে হবে স্রোতা হিসেবে। নির্বাচনের পর ১৪ দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠকও হয়নি আওয়ামী লীগের। নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৪ দলের নেতারা একসঙ্গে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান। এর বাইরে ১৪ দলের কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়নি। তাই আওয়ামী লীগের সমাবেশে যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ হয়নি। গত সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসন বণ্টন নিয়েও আওয়ামী লীগ শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করার অভিযোগ আছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘শরিকরা বিরোধী দলের ভূমিকায় গেলে ১৪ দলের ঐক্য থাকবে না। সরকারের প্রতি অনাস্থা বাড়বে। আবার বাজেট পাস করার ক্ষেত্রেও আমাদের সহায়তা লাগবে।’

জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘আমরা জোটের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই থাকব। এ মুহূর্তে আমরা জোটে আছি, এর ভিত্তিতেই দেশ পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বাত্মক সমর্থন দেব।’ সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া মনে করেন, ‘শরিকদের বিরোধী দলে ঠেলে দেওয়ার পেছনে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী চিন্তা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে একটা নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।’

জাতীয় পার্টির (জেপি-মঞ্জু) মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, তারা বিরোধী দলে যাবেন না। অন্যদেরও বিরোধী দলে যাওয়ার সুযোগ নেই।

এদিকে ক্ষোভে ফুঁসছে ২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্ট শরিকদের কেউ কেউ। বাংলাদেশ লেবার পার্টির ডা. ইরান বলেন, বিএনপি এখন কোনো খবরই রাখে না। ডিএল’র সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মনি বলেন, বিএনপি তাকে কোনো আসন দেয়নি। তবে নতুন ফ্রন্টের এমন নেতাকে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে যারা জামানত রক্ষা করতে পারেনি।

পেছনের কথা : স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলো কার্যকরভাবে জোটবদ্ধ হওয়া শুরু সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় থেকে। জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে ১০-দলীয় ঐক্যজোট করা হয়। তবে এই জোটটি তেমন সফল হতে পারেনি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর এই জোট ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিপরীতে একক প্রার্থীও দিতে পারেনি। এরশাদ জমানায় ১৯৮৩ সালের ৩১ জানুয়ারি বামপন্থিদের উদ্যোগে ১৫-দলীয় জোট গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এই জোটে যুক্ত হয় এবং পরে বড় দল হিসেবে এই জোটের নেতৃত্ব চলে আসে।

এই জোটে ছিল আওয়ামী লীগ (হাসিনা), আওয়ামী লীগ (মিজান), আওয়ামী লীগ (ফরিদ গাজী), জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (হারুন), কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশ (সিপিবি), সাম্যবাদী দল (তোয়াহা), সাম্যবাদী দল (নগেন), জাতীয় একতা পার্টি, শ্রমিক কৃৃষক সমাজবাদী দল এবং জাতীয় মজদুর পার্টি।

১৯৮৬ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৫ দলে ভাঙন দেখা দেয়। মেনন, ইনুর নেতৃত্বে পাঁচ দল বেরিয়ে যায়। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল গঠিত হয়। ওই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ এবং সিপিবি তাতে অংশ নেয়।

অপরদিকে ১৯৮৩ সালের আগস্ট মাসে গঠিত হয় ৭ দল। বিএনপির নেতৃত্বে ৭-দলীয় জোটে ছিল কাজী জাফর আহমেদের ইউপিপি, ন্যাপ, ভাসানী, ডেমোক্র্যাটিক লীগ (রউফ), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, জাগমুই ও বাংলাদেশ বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ। ৭ দলেও সব সময় সাতটি দল ছিল না। কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরীর মতে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৫ দলের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করতে চেয়েছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে ৪২টি আসন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু ৫ দল বেশি আসন দাবি করায় শেষ পর্যন্ত তাদের একসঙ্গে নির্বাচন করা হয়নি। জাসদের হাসানুল হক ইনুই ১০০টির বেশি আসন চেয়েছিলেন।

তিনি বলেন, আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদকে মূল প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে জোটগুলো গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের জোট গঠনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বৈরাচার এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে টানা-হ্যাঁচড়া।

এরপর থেকে রাজনীতিতে জোটের চর্চা হলেও আওয়ামী লীগ কয়েক দফায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন থাকায় তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করে তোলে। যার দরুন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দেশে ছোট দলগুলোর কদর কমতে থাকে। যে কারণে রাজনীতিতে চরম খরায় পড়ে দেশের ছোট দলগুলো।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!